স্মৃতিতে মহান মুক্তিযুদ্ধ- এম লুৎফুল হক
১৯৭১ সাল। বাংলার আকাশে তখন যুদ্ধের দামামা বাজছে। সর্বত্র দমবন্ধ করা নিপীড়ন, আর সেই নিপীড়নের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে লড়ছে বাংলার মানুষ। আমি তখন সেনাবাহিনীতে কর্মরত, আমার র্যাঙ্ক ছিল সার্জেন্ট। আমাদের ইউনিট মোতায়েন ছিল লাহোর কাসুর হুসাইনিওয়ালা সেক্টরে।
কিন্তু সেই সময়ে আমাদের, বাঙালি সৈন্যদের, অবস্থাটা ছিল ভিন্ন। পাকিস্তানি সেনারা আমাদের সন্দেহের চোখে দেখত। তারা জানত আমরা সুযোগ পেলেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চাইব। তাই আমাদের নিরস্ত্র করে রাখা হয়েছিল। আমরা সবসময় পাহারার মধ্যে থাকতাম, যেন কোনোভাবে পালাতে না পারি। প্রতিটি দিন আমাদের কাছে ছিল বন্দিদশার মতো।
তবুও মনে একটাই আগুন জ্বলছিল, কীভাবে না কীভাবে হোক, একদিন মুক্তির লড়াইয়ে যোগ দিতে হবে। দেশের জন্য, পরিবারের জন্য, নিজের অস্তিত্বের জন্য। দূরে বাংলাদেশের কথা মনে পড়লেই বুক ভেঙে আসত। মা বাবার মুখ, ভাইবোনদের হাসি, গ্রামের বাড়ির উঠোন…সবকিছু যেন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, অথচ বুকের ভেতর সেই স্মৃতিগুলো আরও তীব্র হয়ে উঠছিল।
সেই সময়ে আমাদের সঙ্গে ছিলেন লেফটেন্যান্ট মোজাম্মেল। তিনি গল্প করে আমাদের মন ভোলানোর চেষ্টা করতেন। একদিন তাঁকে কোথায় যেন নিয়ে যাওয়া হলো। তারপর আর তাঁর কোনো খোঁজ মেলেনি। আমরা বুঝে গিয়েছিলাম বাঙালি বলে তাঁকেও হয়তো গুম করা হয়েছে। এই হারিয়ে যাওয়া আমাদের মনকে আরও ক্ষতবিক্ষত করত।
ভেদিয়া উসমান গ্রামের পাশ দিয়ে রাভী নদী বয়ে গেছে। ওপারে ভারতের মাটি কসুরেহিন্দ আর ফিরোজপুর। আমরা প্রায়ই তাকিয়ে থাকতাম ওপারের দিকে। মনে হতো, যদি পার হয়ে যাওয়া যেত! যদি মুক্তির লড়াইয়ে অংশ নিতে পারতাম!
একদিন দুপুরে আমি আর দেরি করলাম না। সমস্ত ভয়, দ্বিধা উপেক্ষা করে সিদ্ধান্ত নিলাম আজ নদী পেরোতেই হবে। প্রাণ ভরে শ্বাস নিয়ে ঝাঁপ দিলাম পানিতে। স্রোত ছিল প্রবল, কিন্তু বুক ভরা ছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন। নদীর মাঝপথে যখন পৌঁছেছি, মনে হচ্ছিল হয়তো এবারই মুক্ত হব, হয়তো ওপারে পা দিয়েই আবার নিজের দেশ, নিজের মানুষের হয়ে লড়তে পারব।
কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। আমাকে ধরে ফেলা হলো এবং নিয়ে যাওয়া হলো ক্যাপ্টেন রানার কাছে। পরে মেজর তালহা বিন জারিফ গাড়িতে করে হেডকোয়ার্টারে নিয়ে গেলেন। সিওর সামনে দাঁড়িয়ে জবানবন্দি দিতে হলো। সেই সময় আমার দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন একজন বাঙালি অফিসার, ক্যাপ্টেন আব্দুল খালিক। তিনি চোখে চোখ রাখতেন না, শুধু জানতাম তিনি নিজেও আমাদের মতো একই যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন।
আমি জানতাম পুরো এলাকায় অসংখ্য স্থলমাইন পোঁতা আছে। তবু সেই ঝুঁকি নিয়েছিলাম। কারণ স্বাধীনতার টান এতটাই প্রবল ছিল যে মৃত্যুকেও তুচ্ছ মনে হচ্ছিল। ধরা পড়ার পর মনে হয়েছিল স্বপ্ন ভেঙে গেল। বুকের ভেতর শূন্যতা তৈরি হলো।
বন্দিশিবিরের দিনগুলো ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। ক্ষুধা, যন্ত্রণা, অপমান, সবকিছু সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু এর চেয়েও কষ্টের ছিল দূর থেকে দেশের খবর শোনা, আর কিছু করতে না পারা। প্রতিদিন ভাবতাম কখন আবার মায়ের মুখ দেখব, কখন বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে মুক্তির নিশ্বাস নেব।
অবশেষে ১৯৭৪ সালে, দীর্ঘ দুঃসহ বন্দিজীবন কাটিয়ে স্বদেশে ফেরার সুযোগ হলো। সেই মুহূর্তে মাটির গন্ধ শুঁকে মনে হয়েছিল এই তো আমার দেশ, আমার স্বপ্ন, আমার সবকিছু। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি গড়াচ্ছিল, কিন্তু বুক ভরে উঠেছিল এক অদ্ভুত শান্তি আর গর্বে।
লেখক: এম লুৎফুল হক, সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার/টিএ (অবঃ) অর্টিলারি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
সম্পাদক: ময়নুল হক পবন, প্রকাশক: রিয়াজুল হক রেজা, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : মোহাম্মদ জয়নুল হক.
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়,কামাল প্লাজা (১ম তলা), কুলাউড়া, মৌলভীবাজার,ফোন: ০১৭১১-৯৮৩২৬৯
ঠিকানা: 𝐃𝐮𝐛𝐚𝐢 𝐈𝐧𝐯𝐞𝐬𝐭𝐦𝐞𝐧𝐭 𝐩𝐚𝐫𝐤 𝐃𝐈𝐏, 𝐀𝐥 𝐁𝐚𝐲𝐚𝐧 𝐁𝐮𝐢𝐥𝐝𝐢𝐧𝐠 𝟐𝟎𝟏𝟏, 𝐏.𝐎 𝟏𝟎𝟎𝟏𝟐𝟏- 𝐃𝐮𝐛𝐚𝐢. সংবাদ, ছবি ও বিজ্ঞাপন পাঠানোর ঠিকানা: Email: kulauradorpon@gmail.com ওয়েবসাইট: www.kulaurardarpan.com,
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত