স্টাফ রিপোর্টার, কুলাউড়ার দর্পণ।। সিলেট বিভাগে কুলাউড়া ছিল একসময় বাম রাজনৈতিক আন্দোলনের ঘাঁটি। পাকিস্তান আমলে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন সেখানে বামপন্থি ধারায় উদ্ভাসিত হয়েছে। কৃষক, চা- শ্রমিক, পাহাড় কামলা, রেলশ্রমিক, আদিবাসীসহ মেহনতি জনগোষ্ঠী সেসব আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট হয়েছেন। এ ভূখণ্ডের মওলানা ভাসানী এবং তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিখ্যাত বামপন্থি নেতা মাহমুদুল হক কাসুরি, গাউস বখস ব্রেজেঞ্জো, মাহমুদুল হক ওসমানী প্রমুখ নেতা বিভিন্ন সময়ে কুলাউড়াকে মুখরিত করেছেন। ১৯৬৭ সালে কুলাউড়ায় অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সম্মেলন। এসব কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের অন্যতম প্রধান পুরুষ ছিলেন সৈয়দ আকমল হোসেন। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি কুলাউড়ার ভাসানী নামে পরিচিত ছিলেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ছাত্র ফেডারেশনের কর্মী হিসেবে রাজনীতিতে তার আত্মপ্রকাশ। আর সে সময়কার রাজনীতি ছিল ইংরেজ ও তার দালালদের হটানোর সংগ্রাম। ১৯৪৬ সালে যোগ দেন আসামের লাইন প্রথাবিরোধী আন্দোলনে। বিত্তবান চা বাগানের মালিকেরা আসামের চরের দরিদ্র মানুষকে সরকারের প্রায় ৫০ লাখ একর অনাবাদি জমি বন্দোবস্ত দিয়ে নামমাত্র মজুরিতে চা বাগানে কাজ করিয়ে নিত। এজন্য চা বাগানের মালিকরা আসাম সরকারকে দিয়ে এসব জমির চারপাশে সীমানার ব্যবস্থা করেছিল। এটিই ছিল নিন্দিত লাইনপ্রথা। তখন পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পরিশ্রমী চাষিরা আসামে গিয়ে স্থানীয় লোকদের সহায়তায় অনাবাদি জমি আবাদ করে এর মালিকানা পেতেন। চা বাগান মালিকরা লাইনপ্রথা চালু করে বাঙালিদের সঙ্গে আসামের অধিবাসীদের সম্পর্ক নষ্ট করার চক্রান্তে মেতে ওঠে। চরবাসী চা শ্রমিকদেরকে দিয়ে এভাবে বাঙাল খেদাও আন্দোলন শুরু করা হয়।
মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৪৬ সালে লাইনপ্রথাবিরোধী আন্দোলন প্রকট হয়। সৈয়দ আকমল হোসেন ছিলেন লাইনপ্রথাবিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। সংগ্রামের এক পর্যায়ে আসামের মুসলিম লীগ সরকার লাইনপ্রথা বাতিল করে। পরের বছর ১৯৪৭ সালের ২৪ এপ্রিল সিলেটের তৎকালীন ডেপুটি কমিশনারের অফিস থেকে ইউনিয়ন জ্যাক পতাকাকে অপসারিত করে সৈয়দ আকমল উড়িয়েছিলেন পাকিস্তানের পতাকা। এ সময় সব বাধা উপেক্ষা করে তিনি সভাসমিতিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের ডাক দিয়েছেন। সেই সৈয়দ আকমল হোসেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কৃষক শ্রমিকের ন্যায্য দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে জেলজুলুমের শিকার হন। তরুণরা কিশোর বয়স থেকে পাকিস্তানের জন্য জীবন উৎসর্গ করে দিলেও সেই স্বাধীনতার অসারত্ব তারা অচিরেই বুঝতে পারে। আর তাই আন্দোলন সংগ্রাম হয়ে পড়ে নিত্য সঙ্গী। কারান্তরাল আর হুলিয়া মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে দীর্ঘদিন। এরই মাঝে তিনি মিশেছেন মানুষের সঙ্গে, শুনেছেন তাদের কথা। স্থানে স্থানে গড়ে তুলেছেন ন্যাপ আর কৃষক সমিতির সংগঠন। দল বেঁধে মানুষ তাঁর কাছে শুনেছে মুক্তির কথা। মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় হয়েছেন তিনি সিক্ত। তার ডাকে সিলেটে অনেক আন্দোলনে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন। ১৯৬৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শ্রীমঙ্গল শহরের অদূরে অবস্থিত বালিশিরায় দরিদ্র কৃষকগণ জমিতে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। চা বাগানের শ্রমিক আর গ্রামের কৃষক মিলে মিছিল করে প্রশাসকের কার্যালয়ে যেতে চান। ঐ মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে মনু মিয়া নামে এক কৃষক নিহত হন এবং অনেকে আহত হন। পুলিশি এ জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে সৈয়দ আকমল হোসেন গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে মানুষকে সাহস দেন। এরপর শুরু হয় দুর্বার আন্দোলন। সিলেট বিভাগের ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি এবং কৃষক সমিতির নেতাদের সাংগঠনিক দক্ষতায় প্রায় ২০ হাজার মানুষ শ্রীমঙ্গলের সিন্দুরখাল থেকে মৌলভীবাজার শহর পর্যন্ত ১৫ মাইল হেঁটে মিছিল করেন। সৈয়দ আকমল হোসেন ছিলেন মিছিলের পুরোভাগে। অন্য যারা ছিলেন তাদের অন্যতম ছিলেন নওয়াব আলী সফদার খান রাজা সাহেব, নুরুর রহমান, পীর হবিবুর রহমান এবং মফিজ আলী। ঐ আন্দোলন চলেছিল এক বছর। প্রায় পতি সপ্তাহে সৈয়দ আকমল হোসেন ছিলেন তাদের সঙ্গে কোনো না কোনো কর্মসূচিতে যোগ দিতেন।
সৈয়দ আকমল হোসেন জন্মেছিলেন কুলউড়ার এক সম্পন্ন পরিবারে। ১৯৫৬-৫৭ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে তিনি তার পিতার ধানের গোলা থেকে উদ্বৃত্ত ধান দরিদ্র পরিবারগুলোর মধ্যে বন্টন করে দেন। এরপর সরকারি ব্যবস্থাপনায় লঙ্গরখানা খোলার দাবি আদায় করেন। কুলাউড়ার ভূখা- নাঙ্গা মানুষ ঐ লঙ্গরখানার খাবার খেয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে। তার তত্ত্বাবধান এত নিখুঁত ছিল যে, সেদিন দরিদ্র মানুষের বরাদ্দ থেকে একটি পয়সাও কেউ এদিক-ওদিক করতে পারেনি। দরিদ্র মানুষকে ক্ষমতায়নে তিনি কাজ করেছেন একজন কমিউনিস্ট হিসেবে। স্বাধীনতার পর সৈয়দ আকমল হোসেন মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে কাজ করেন। পরবর্তীতে মশিউর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত ভাসানী ন্যাপের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে প্রথমে ফ্রন্ট গঠন এবং পরবর্তীতে বিএনপিতে ন্যাপের বিলুপ্তিতে তিনিও তার অংশ হয়ে যান। দীর্ঘদিন বামপন্থি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার কারণে সরকারি দলের অংশ হয়েও তিনি আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যেই থেকেছেন। জিয়ার মৃত্যুর পর তিনি আর সক্রিয় রাজনীতিতে ছিলেন না। ১৯৮৫ সালের ৩০ জানুয়ারি ৫৮ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সম্পাদক: ময়নুল হক পবন, প্রকাশক: রিয়াজুল হক রেজা, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : মোহাম্মদ জয়নুল হক.
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়,কামাল প্লাজা (১ম তলা), কুলাউড়া, মৌলভীবাজার,ফোন: ০১৭১১-৯৮৩২৬৯
ঠিকানা: 𝐃𝐮𝐛𝐚𝐢 𝐈𝐧𝐯𝐞𝐬𝐭𝐦𝐞𝐧𝐭 𝐩𝐚𝐫𝐤 𝐃𝐈𝐏, 𝐀𝐥 𝐁𝐚𝐲𝐚𝐧 𝐁𝐮𝐢𝐥𝐝𝐢𝐧𝐠 𝟐𝟎𝟏𝟏, 𝐏.𝐎 𝟏𝟎𝟎𝟏𝟐𝟏- 𝐃𝐮𝐛𝐚𝐢. সংবাদ, ছবি ও বিজ্ঞাপন পাঠানোর ঠিকানা: Email: kulauradorpon@gmail.com ওয়েবসাইট: www.kulaurardarpan.com,
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত