৭১ এর স্মৃতি পর্ব-১৬-( জয়পাশা-১)
সৈয়দ শাকিল আহাদ
৭১ এ কেমন ছিল কুলাউড়ার জয়পাশা সাহেব বাড়ী ?
অনেক বার মনে হয়েছে এই ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি সম্পর্কে কিছু লিখি , কিন্তু লিখতে গিয়ে বার বার পিছিয়ে যাচ্ছি , কিছু তথ্যের প্রয়োজন ছিল যা এই বংশের অন্যতম সদস্য সৈয়দ ইশতিয়াক লন্ডন থেকে ও সৈয়দ হাদী সুদুর আমেরিকা থেকে আমাকে ইমেইলে আমার বাবার লেখা ১৯৬০ সালের একটি বই সহ কিছু ছবি পাঠিয়ে সহযোগীতা করায় তা সম্ভব হতে চলেছে ।
জয়পাশা জমিদার বাড়িটি মুলত আমার আব্বার নানার ভায়রা খন্দেগার সৈয়দ হেদায়েত উল্লাহর বাড়ি ।আমার আব্বা মরহুম সৈয়দ আব্দুল আহাদ মশকুরের এবং আমার জন্ম হয়েছে তার নানা, বাংলার বার ভুইয়া খ্যাত মসনদে আলা ঈশাখার বংশধর কিশোরগন্জর কিংবদন্তী ,হয়বতনগর দেওয়ানবাড়ির দেওয়ান মান্নান দাদ খানের বাড়িতে তবে আমাদের পুর্বপূরুষের আদি অবস্তান সিলেটে ,শহরের কুমারপাড়া ঝরনার পাড়ে হযরত শাহাজালালের (রঃ) সহযাত্রী হযরত সৈয়দ হামজা ( রঃ) শেরসোয়ারী আমাদের পুর্বপুরুষ , সিলেট থেকে আমার আব্বার পিতামহ সৈয়দ আব্দুল হাফিজ বা টিলা সাহেব কিশোরগন্জের সেকান্দর নগরে বৈবাহিক সুত্রে আবদ্ধ হন এবং তারপর আমার পিতামহ সৈয়দ আব্দুল হাকাম ওরফে বুলবুল মিয়া হয়বতনগরে দেওয়ান বাড়িতে বৈবাহিক সুত্রে আবদ্ধ হন এবং বাড়ী সংলগ্ন পশ্চিমে নিজ বাড়ী তৈরী করে অবস্থান করেন , এই বাড়ির সর্বশেষ জমিদার দেওয়ান মান্নান দাদ খানই আব্বার নানা , তিনি একে একে পাঁচটি বিয়ে করেন , ১) দেওয়ান মান্নান দাদ খান প্রথম বিয়ে করেন নওয়াব ফয়জুননেছার ভাই ইয়াকুব আলী চৌধুরীর ছেলে সেকান্দর আলী চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে নান্নী বিবিকে , সেই পক্ষের দুই মেয়ে ছিল
ক)দেওয়ান মাকসুদা বিবি যিনি আমার দাদী আর আমার দাদা ছিলেন সেকান্দর নগরের সৈয়দ আব্দুল হাকাম বুলবুল মিয়া সাহেব ,আমাদের পুর্বপুরুষ সিলেট শহরের কুমারপারা ঝরনার পারের ,আমার আব্বা সৈয়দ আব্দুল আহাদ ও আমার চাচা সৈয়দ আব্দুল হাদী রা দুই ভাই এই পক্ষে আমার বাবা চাচার কোন বোন ছিল না
অন্য মেয়ে
খ) দেওয়ান হালিমা আক্তারের বিয়ে হয় ইটনায় দেওয়ান আব্দুল আলীম সাহেবের সাথে ।এই পক্ষে কোন সন্তানাদি ছিল না
দেওয়ান মান্নান দাদ খানের এই পক্ষের একমাত্র ছেলে দেওয়ান মাহতাব দাদ খান নিঃসন্তান থেকে ২২ বছর বয়সে মারা যান ।
দেওয়ান মান্নান দাদ খানের প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন বৌলাই জমিদার বাড়ীর সৈয়দ আজিজুল হকের কন্যা ,সৈয়দ হাবিবুল হকের একমাত্র বোন সৈয়দা খুজেস্তা বেগমের সাথে , এই পক্ষের দুইটি ছেলে হয়েছিল তারা অল্প বয়সে মারা যানএবং তার এই স্ত্রীর মৃত্যুর পর তার মাতা হয়বতনগর স্টেইট এর অধিকারী জমিদার, কর্তিৃ সাহেবা হিসাবে সবাই যাকে চিনতো সেই আয়শা আক্তার খাতুন তাকে তৃতীয় বিয়ে করান , হবিগঞ্জের দাউদ নগর সাহেব বাড়ীর সৈয়দ আবদুর রহমান সাহেবের কন্যাকে ।ঐ পক্ষের ছেলে দেওয়ান সাত্তার দাদ খান বা সাইয়ারা মিয়া কেই দেওয়ান মান্নান দাদ খানের বড় ছেলে হিসাবে সবাই জানতো , তার একমাত্র বোন হলো দেওয়ান বারিরা আক্তার বা আনজুমান বিবি আন্জুমান বিবির বিয়ে হয় সুলতানশী সাহেববাড়ির ফিরুজ মিয়া সাহেবের ছেলে সৈয়দ আব্দুল কাদির ওরফে সুরুজ মিয়ার সাথে। উনাদের আম্মা মারা যাবার পর দেওয়ান মান্নান দাদ খান চতুর্থ বিয়ে করেন , সিলেটের মজুমদারীতে সায়রা খাতুন মজমাদারকে এই পক্ষের জুনায়েদ মিয়া ও জানে জানান মিয়ার ( এরা আমার দাদীর ভাই ) এক বোনের নাম দেওয়ান সাওদা আক্তার , যার বিয়ে হয় বানিয়াচং জমিদার বাড়িতে স্যার ফজলে হাসান আবেদের চাচার সাথে আর এক বোন হচ্ছে মরিয়ম বিবি উনার বিয়ে হয়েছিল বৌলাই সাহেব বাড়ীর সৈয়দ মাজহারুল হক নুর মিয়ার সাথে , আমার এই নুর দাদা শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের ঈমামতি করেছিলেন কোন এক ঈদের জামাতে , উনার মেয়ে আক্তারী ফুপু ঢাকাতেই থাকেন ।
আর দেওয়ান মান্নান দাদ খান সর্বশেষ বিয়ে করেন হযরত সৈয়দ নাসিরউদদিন সিপাহসালারের উত্তরসুরী সুলতানশী সাহেব বাড়ীর ফিরুজ মিয়া সাহেবের কন্যা সৈয়দা মনিরুন্নেছা খাতুনকে , এই পক্ষের ছয় সন্তানের মধ্য পাঁচ সন্তান যেমন দেওয়ান সবুর দাদ খান বিশরাফী দাদা , দেওয়ান খালেক দাদ খান আবু আইয়য়ুব দাদা ,দেওয়ান হাফসা আক্তার ,হাফসা দাদী ,দেওয়ান হোসনা আক্তার ,হোসনা দাদী ও দেওয়ান হাসনা আক্তার ,হাসনা দাদী এখনও জীবিত আছেন ওদের সবার ছোট ভাই আমাদের প্রানপ্রিয় দেওয়ান ওয়াদুদ দাদ খান সোয়েব দাদা ও তার স্ত্রী বেবী আপা আমাদের ছেড়ে ইহলোক ত্যাগ করেছেন
।দেওয়ান মান্নান দাদ খান যে তৃতীয় বিয়ে করেন হযরত সৈয়দ নাসিরউদ্দিন সিপাহসালার (রঃ) এর বংশধর হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগন্জের দাউদনগর সাহেব বাড়ীর সৈয়দ আব্দুর রহমানের মেয়ে এবং গাজি মিয়া সাহেবের বোনকে ,সৈয়দ আবদুর রহমানের পাঁচ মেয়ের এক মেয়েকে , অন্য আর এক মেয়েকে বিয়ে করেন জয়পাশা জমিদার বাড়ির জমিদার সৈয়দ হেদায়েত উল্লাহ , মান্নান দাদ খানের ভায়রা ভাই ছিলেন খন্দেগার সৈয়দ হেদায়েতউল্লাহ , আবার
এই খন্দেগার সৈয়দ হেদায়েত উল্লাহর বড় বোনকে বিয়ে করেন দেওয়ান মান্নান দাদ খানের প্রথম পক্ষ লাকসাম নওয়াব বাড়ীর সেকান্দর আলী চৌধুরীর ছেলে আইয়ুব আলী চৌধুরী অর্থাৎ নান্নী বিবির ভাইয়ের কাছে ,
ছোটবেলা থেকেই আমার আব্বা তার নানীর বোনের বাড়ীতে, অর্থাৎএই জয়পাশা জমিদার বাড়ীতে নানীর মতই আদর স্নেহ পেতেন, পুরো পরিবারের সকলেই ছিল তার কাছে অত্যান্ত মর্যদাসম্পন্ন এবং তিনিও ছিলেন এই জয়পাশা জমিদারবাড়ির সকলের কাছে প্রিয়পাত্র ও সর্বক্ষেত্রে গ্রহনযোগ্য ব্যক্তিত্ব ।সেই সুবাদেই এই বাড়িতে অবস্তান কারী যারা যারা থাকতেন সবাইকে অত্যান্ত আপনজন এবং ঐতিয্যবাহী এই বাড়িটিকে আমার আব্বার মামার বাড়ী বা আমি আমার দাদা বাড়ি হিসাবে জানি ও জেনে এসেছি।
যতদুর মনে পরে , যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই আম্মার সাথে প্রায়ই যেতাম কুলাউড় জয়পাশার সেই বিখ্যাত খন্দেগার বাড়িতে ,আমাদের নানাবাড়ি উছলাপারা খান সাহেবের বাড়ী থেকে বেরিয়ে মাঠ পেরিয়ে পুর্বদিকে রেল লাইনে উঠতাম , রেল লাইন ধরে উত্তর দিকে এগুলেই একটু সামনে গেলে পুর্বদিকে ছিল রেলওয়ে থানা , তার পাশদিয়ে গিয়ে বেশকিছু ঘনবসতিপূর্ণ বাড়িঘর পেরিয়ে সাহেববাড়ির দক্ষিনদিকের মাটির দেওয়ার বা বাউন্ডারী ওয়াল পেরিয়েই পড়তো ছোট দাদা অর্থাৎ সৈয়দ হবিবউল্লাহ দাদার অংশ সেই অংশের আতিথেয়তা ছিল মনোমুগ্ধকর দাদি ছিলেন অনেক সুন্দরী এবং বিরামচরের জমিদার কন্যা ,বিরামচরের সেই দাদী ছিলেন অনেক বিনয়ী ও সদালাপী , তারপর সৈয়দ অলীউল্লাহ দাদার অংশ যেখানে ভাটিপারার আরএক জমিদার কন্যা আমার ঐ দাদী খুউব পান খেতেন এবং গান শুনতে পছন্দ করতেন , আমরা গেলে পরে চাচা ফুপুরা ঘিরে থাকতো , তারপর যেতাম অত্যান্ত পরহেজগার সবসময় বসে থাকতেন বিশাল বারান্দার ইজি চেয়ারে , সেই প্রিয় মাখন দাদার অংশে , যিনি স্বাধীনতার আগে কুলাউড়া ইউনিয়ন পরিষদে দীর্ঘদিন জনপ্রতিনিধিত্ব করেছেন এই দাদার অংশে আসলে অনেক সময় পেরিয়ে যেত , দাদী ছিলেন সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জের কানিশাইল (উত্তর বাড়ীর )নামকরবাড়ির জনাব সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সাহেবের মেয়ে ,তিনি ছিলেন বৃটিশ আমলের তৎকালীন সিলেট জেলার তিনজন শিক্ষিত ব্যক্তির একজন , সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী পাকিস্তানের শুরুতে বগুড়ার ডি.সি. ছিলেন , এই দাদীর নাম ছিল হোসনা আরা চৌধুরী,কোনদিন তাকে ঘোমটা ছাড়া দেখেছি বলে মনে পড়ে না আমার এই দাদীর ও পানের বাটা সাথে থাকতো তিনিও পাকিস্তান আমলের মেট্রিক পরীক্ষাতে জিওগ্রাফীতে লেটার পেয়ে পাশ করা একজন শিক্ষিত মেয়ে এবং উত্তরদিকে সবার বড় ভাই মাহবুবউল্লাহ দাদা বা মবুব মিয়ার অংশ এই বড় দাদী ছিলেন অত্যানত্য সুন্দরী এবং চাঁদপুরের রুপসা জমিদার বাড়ীর একজমিদার কন্যা, সবকটি ঘর ঘুরা শেষে সামনে পুর্বদিকে বাংলোঘরে আর যাওয়ার সময় পেতাম না ।তবে দু এক বারগিয়েছি ,সুন্দর সুন্দর অনেক গুলো রুম ছিলো ঐ বাংলাঘরটিতে , শতবর্ষী এই বাংলাতে অনেক নামী দামী নেতা নেত্রীর আগমন হয়েছে , আত্বীয় স্বজনের পদচারনায় সর্বদা মুখরিত থাকতো, এলাকাবাসীর অনেক বিচার সালিশ ও আন্ন্দধন পরিবেশ ও পরিস্তিতির অগ্নিস্বাক্ষী স্মৃতি বিজরীত এই বাংলোঘর ।
জয়পাশা সাহেববাড়ীর ইতিহাস ঐতিয্য অনেক বিশাল ও সম্বৃদ্ধ, সারাদেশের সকল সম্ভ্রন্ত পরিবারের সাথে ছিল এই পরিবারের পারিবারিক যোগাযোগ ও কমবেশি আত্বীয়তা ।কিছু কথা প্রসংগক্রমেই এসে যায় । ৬০ এর দশকের শুরুতে আমার আব্বা সৈয়দ আব্দুল আহাদ মশকুর রচিত গ্রন্থ “জয়পাশার খন্দেগার পরিবার “থেকে জানা যায় হযরত সৈয়দ নসরুল্লাহ “ যিনি হযরত সৈয়দ শাহজালাল ( রঃ) এর সাথে ইয়েমেন থেকে সাথী হয়ে সিলেটে আসেন ,হযরত শাহজালালের মৃত্যুর পর তিনি একবার এই অন্চলে অন্যান্য সাথীদের সাথে দেখা করতে আসেন ।ফেরার পথে জয়পাশার পাহাড়ী ভুমিতে অবস্তান করে কিছুদিন ইসলাম প্রচার করেন ।সৈয়দ নসরুল্লাহ তৎকালীন সিলেটের শাসনকর্তার মেয়েকে বিয়ে করেন , তাদের পুত্র সৈয়দ মামুদ হাফেজ একজন বিখ্যাত ধার্মিক ও জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন ।
সৈয়দ মাহমুদ হাফেজের অধঃস্তন পুরুষ স্বীয় প্রতিভাবলে ১৫৯৯ খৃষ্ঠাব্দে দিল্লির সম্রাট আকবরের অমাত্য মজঃফর খাঁর স্বান্নিধ্য লাভ করেন ।মজঃফর খা সৈয়দ মুসার শিক্ষা রাজনীতি জ্ঞান এবং কার্যকুশলতা দেখে স্বীয় কন্যাকে তার সাথে বিবাহ দানের দ্বারা সম্পর্ক মজবুত করেন ।
সৈয়দ মুসার অধঃস্তন পুরুষ
সৈয়দ শাহ মোমরেজ দিল্লিশ্বর আওরঙ্গজেবের দরবারে কার্যদক্ষতা দেখিয়ে “ শেখ উল উলামা “উপাধি প্রাপ্ত হন ।পরবর্তীতে তিনি সিলেটে এলে সিলেটের শাসনকর্তা তাকে দেওয়ানের পদে নিযুক্ত করেন । সৈয়দ শাহ মোমরেজ দেওয়ানের পদ থেকে অবসর নেবার সময় নবাব কর্তৃক লংলা পরগনার কিছু জমির স্বত্ত লাভ করেন ।এই জমিই বর্তমানে মোমরেজপুর গ্রাম ,তৎপুত্র সৈয়দ আজিজ উল্লাহ ও সৈয়দ মুতি উল্লাহ বহু শ্বাস্রে সুপন্ডিত ছিলেন ।তারা তৎকালীন দিল্লী সম্রাটের দরবারে পান্ডিত্য দেখিয়ে “খোদা ওন্দেগার “উপাধী এ মদদ মাস স্বরুপ বিস্তর ভুস্বম্পত্বি প্রাপ্ত হন । এর পর থেকে ঐ বংশের একাংশ খোন্দ গাঁর বা খন্দকার শব্দটি নামের সাথে ব্যবহার করে আসছেন ।সৈয়দ মুতি উল্লাহ “তুফেজে আজিজি “ নামের একটি গ্রন্থের লেখক ছিলেন ।সৈয়দ আজিজুল্লাহর পুত্র সৈয়দ আতাউল্লাহ ও বিশিষ্ট লেখক ছিলেন , তার লেখা “ইস্রাফুল আরেফিনি এ বুরহানুল আসকিনি “নামক গ্রন্থ দুইটি উর্দু ভাষায় লেখা ।তিনিও নবাবের কাছ থেকে কিছু জমি পেয়েছিলেন ।সৈয়দ আতাউল্লাহ শাহ হেলিম উদ্দিন কুরেশীর বংশীয় দেওয়ান মান আনসারের কন্যাকে বিয়ে করেন , সৈয়দ আতাউল্লাহর অধঃস্তন পুরুষ সৈয়দ কেফায়েতউল্লাহ একজন ব্যক্তিত্ববান পুরুষ ছিলেন ,তার পুত্র হেদায়েত উল্লাহ ও একজন সুপুরুষ ছিলেন ।এই সৈয়দ হেদায়েত উল্লাহর পাঁচছেলের মধ্যে বড়ছেলেই হচ্ছেন সৈয়দ মাহবুবউল্লাহ বা মবুব মিয়া ।
সৈয়দ মাহবুব উল্লাহ ওরফে মবুব মিয়া ছিলেন বর্ষীয়ান রাজনীতি বিদ , আওয়ামী লীগের সভাপতি , তার সাথে সাধারন সম্পাদক ছিলেন স্টার এজেন্সির জয়নাল সাহেব , পরবর্তীতে তিনি এ কুলাউড়া আওয়ামী লীগের সভাপতি হন ।
সদাহাস্সোজ্জল অত্যন্ত বিনয়ী , ফর্সা ধবধবে সাদা মবুব সাহেবকে দেখা মাত্র যে কেউ তার প্রতি আসক্ত ও শ্রদ্ধাশীল হতো ।
কখনও তিনি কারো সাথে কটুকথা বা দুর্ব্যবহার করেছেন কিনা সন্দেহ আছে ।এই মবুব দাদা আব্বাকে ভীষন আদর করতেন ,উনার বড় ছেলে মাসুম চাচা ও আর এক ভাগিনা লাকসামের লনী দাদীর ছেলে বেলায়েত চাচার মধ্যে ছিল ভীষন মিল ও দারুন সখ্যতা , এরা তিনজন সব সময় মবুব দাদার কাছাকাছি থাকতেন , বর্তমানে সবাই প্রয়াত ।
পাকিস্তানিরা তাদের বাড়ীতে মর্টারের আঘাত হানে ফলে উনাদের তৃতীয় ভাই জনাব অলিউল্লাহ সাহেবের ঘরের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয় ।
সৈয়দ অলিউল্লাহ সাহেব ও সাদাসিধে ভাবে চলাফেরা করেছেন , বড় তিন ভাইই পরলোক গত হয়েছেন তবে সবার ছোটভাই সৈয়দ হাবিবউল্লাহ সাহেব যিনি ৭১ সালে কুলাউড়া স্টেশন রোডে আরোগ্য নিকেতন নামে একটি ফার্মেসী খুলেছিলেন ,বর্তমানে ভাই বোনদের মাঝে একমাত্র তিনিই পরিবার পরিজন নিয়ে আমেরিকাতে অবস্তান করছেন এবং অপর একবোন মাধবপুরে জীবিত আছেন।
সৈয়দ হেদায়েতউললাহ সাহেবের পাচ মেয়ে ছিল তাদের কথা না লিখলে অর্থাৎ আমার সেই দাদীদের কথা না উল্লেখ করলে আমার এই স্মৃতি কথা লেখা অপূ্র্ণ থেকে যাবে , পাঁচ মেয়ের মধ্যে বড়মেয়ে
১) সৈয়দা নাজমুন্নেছা (লনী) বিবির কে বিয়ে দেন লাকসামের নওয়াব ফয়জুননেছার ভাই ইয়াকুব আলী চৌধুরীর নাতি আইয়ুব আলি চৌধুরীর ছেলে “বু আলী চৌধুরীর সাথে , অপর এক মেয়ে
২) সৈয়দা হোসনা আফরোজকে বিয়ে দেন লাকসামের বু আলী চৌধুরীর ভাই মসি আলী চৌধুরীর সাথে ।একই বাড়িতে দুইবোনের বিয়ে হয় দুই ভাইয়ের সাথে ।
আর এক মেয়ে ,
৩) সৈয়দা দিল আফরোজকে বিয়ে দেন বগুড়া নবাববাড়ির সাতানী অংশের খান বাহাদুর হাফিজুর রহমান চৌধুরীর ছেলে আবিদুর রহমান চৌধুরী টুকু মিয়ার সাথে ।
আর এক মেয়ে,
৪) সৈয়দা রুহ আফরোজকে বিয়ে দেন সিলেট দরগামহল্লার মুফতি বাড়ীর মুফতি রোকনউদ্দিন সাহেবের সাথে ।
এবং এক মেয়ে ,
৫) সৈয়দা ছালেহা বেগমকে বিয়ে দেন , হবিগঞ্জের মাধবপুর বহরা সাহেববাড়ির জনাব মনিরুল বারী চৌধুরীর সাথে আমার এই দাদীর এখন ও জীবিত এবং মাধবপুরেই আছেন।
।( চলবে)
৭১ এর স্মৃতি — কুলাউড়া -৫
সৈয়দ শাকিল আহাদ
১৯৭১ সালে কুলাউড়াতে ছিলাম তাই কুলাউড়ার কথাই ঘুরে ফিরে আসছে , ছোট্ট একটি এক রাস্তার শহর , একটি রেলওয়ে জংশন ,রেলষ্টেশন থেকে বেরিয়ে পশ্চিমদিকে মাথায় আসলেই ডানদিকে ছিল মোবারক সাহেবের আজম বোডিং ,একটি বাস স্ট্যান্ডও ছিল , সেখান থেকে জুড়ি , দক্ষিণভাগ ,ফুলতলা বড়লেখা , বাড়ইপাড়া শাহবাজপুর যাবার দুই তিনটি মুড়ির টিন মার্কা বাস থাকতো , ঐ দিকটা কিছুটা উন্নত উন্নত মনে হতো ,সি এন্ড বি অফিস ,সি. ও অফিস , সাব রেজিষট্রি অফিস , উত্তর বাজার মসজিদ ,রাবেয়া স্কুল , তহশিল অফিস , টেলিগ্রাফ অফিস , হাসপাতাল ,ইত্যাদি
আর বামদিকে মোড় নিলে ছিল ইউনিয়ন অফিস , ডাকবাংলো সংলগ্ন মোটর ষ্ট্যান্ড থেকে ছেড়ে যেতো মৌলভীবাজার যাবার গাড়ি ,ঐ রাস্তায় ডানে থানা , আর একটু এগুলে দক্ষিন বাজার , বশিরুল হোসেন প্রাইমারী স্কুল , কালীবাড়ী, মসজিদ , পোস্ট অফিস , পশু ডাক্তার খানা , গার্লস স্কুল ,খেলার মাঠ , পেট্রোল পাম্প , ঈদগাহ ,নবীন চন্দ্র হাই স্কুল , কুলাউড়া কলেজ , ফানাই গাং ,তা ছাড়া দোকানপাট , ফার্মেসি , লাইব্রেরি হোটেল রেস্তোরা ইত্যাদি ও ছিল হাতে গোনা , রেল ষ্টেশনের পূর্বদিকেই ছিল জয়পাশা সাহেব বাড়ি , সৈয়দ শাহ কামালের মাজার ,দক্ষিনপুর্বে গাজিপুর চা বাগান ,গগনটিলা ,চৌধুরীবাজার ,নর্তন রেজওয়ান পীর সাহেবের সৈয়দ বাড়ী ,রবির বাজার ,পৃথ্থীমপাশা নবাব বাড়ি ইত্যাদি ।
আশে পাশে অনেকগুলো চা বাগান ছিল ,বাগানে চলাচল করতো জীপ ও ট্রাক্টর , সাধারনেরা চলতো রিক্সাযোগে , চা বাগান গুলো এখনও আছে , সারা কুলাউড়ায় পাকা রাস্তা ছিল অল্প , বাকি সবই ছিল ইট সোলিং ও পাথরের নুরী দিয়ে তৈরী , কাঁচা রাস্তা , এখনকার মত এত গাড়ি, সি এন জি , কিম্বা ট্রাক বাস অটোর নাম গন্ধ ও ছিল না ,
সর্বত্র কারেন্ট ই ছিল না , সুপেয় খাবার পানির ব্যবস্থা অর্থাৎ টিউবঅয়েল ও ছিল হাতে গোনা কয়েকটি জায়গায় ও সমভ্রান্ত কিছু বাড়িতে । সিলেট অন্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত পাহাড়ি জনগন সম্বলিত , বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সম্প্রীতিতে আবদ্ধ একটি বড় থানা এই কুলাউড়া ।
১৯৭০ সালের ৭ ই ডিসেম্বর তৎকালিন পাকিস্তান সরকারের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে কুলাউড়া থেকে ব্যারিষ্টার আব্দুল মোন্তাকিম চৌধুরী এবং ১৭ ই ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে পৃথ্থিমপাশার নবাব আলী সারোয়ার খান নির্বাচিত হয়েছিলেন ।
ঐ নির্বাচনে সারাদেশে আওয়ামী লীগ নিরংকুষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে । কিন্তু পাকিস্তানী শোষকেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করেই ২৫ যে মার্চ রাতে হায়েনারা নিরস্র বাঙ্গালীর উপর ঝাপিয়ে পড়ে , গনহত্যা , নির্যাতন, ধর্ষন ইত্যাদি শুরু করে |
প্রসংগত উল্লখ্য ১৯৭১ এর ২৮ শে ফেব্রুয়ারি কুলাউড়ার ডাক বাংলোর সামনে এক বিশাল জনসভায় তৎকালীন ডাকসুর ভি পি আ.স.ম. আবদুর রব এসে ঘোষনা দেন পাকিস্তান হিসাবে এটাই তার শেষ জনসভা , স্বাধীনতার চুড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য তিনি কুলাউড়ার সর্বস্তরের জনগনকে আহ্বান জানান ।
১লা মার্চ আহুত জাতিয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হলে ,পরদিন সারাদেশের মত কুলাউড়ায় ও স্থানীয় নেতৃবৃনদের সাথে স্বতস্ফুর্ত সহায়তায় সর্বাত্বক হরতাল পালিত হয়।৩রা মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে সারাদেশের ন্যায় কুলাউড়া ও গর্জে উঠে ,৭ ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স মাঠে জাতীরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান ঐতিহাসিক এক বিশাল জনসমুদ্রের মাঝে আনুষ্ঠানিক ভাবে বজ্রকন্ঠে বাংলার স্বাধীনতা ও যার যা কিছু আছে তা নিয়েই শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য আহ্বান জানান ।
পাকিস্তানী ঔপনিবেশকদের শৃঙ্খল ছিন্নকরে , দেশকে স্বাধীনকরার শপথে বাংলার ঘরে ঘরে তখন সাজ সাজ রব , বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষনের পরেই অহিংস অসহযোগ আন্দোলন চুড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয় ।সারাদেশের ন্যায় কুলাউড়ার বিভিন্ন সংগঠনের নেতর্বৃন্দ ও কর্মীরা সভা সমিতির মাধ্যমে কুলাউড়াবাসীদেরকে চুড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে উৎসাহিত করতে থাকেন ।
ইতিমধ্যে তৎকালিন ছাত্রলীগ নেতা গিয়াসউদদিন আহম্মেদ ৮ই মার্চ সকালে ঢাকা থেকে কাগজের তৈরী স্বাধীন বাংলার পতাকা কুলাউড়া য় নিয়ে আসেন ।
সেদিনটি ছিল পাকিস্তান দিবস ,
২৩ শে মার্চ , সেদিন কুলাউড়ার বেশ কিছু ঘরে সৈয়দ জামালউদ্দিনের নেত্বৃত্বে উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা , গঠিত হয় সংগ্রাম কমিটি , ঐ সংগ্রাম কমিটির আহব্বায়ক ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা জয়নাল আবেদিন , সদস্য ছিলেন আব্দুল জব্বার , ব্যরিষ্টার মোন্তাকিম চৌধুরী ,জুবেদ চৌধুরী , সৈয়দ জামাল উদ্দিন , মোঃ আজির উদ্দিন খান , আব্দুল মালিক , নূর আহম্মেদ ,আব্দুস সালাম , মমরোজ বক্স,মুকিম উদ্দিন ও আরো অনেকে ।(চলবে )
৭১ এর স্মৃতি -২২ (কানিহাটি)
সৈয়দ শাকিল আহাদ
আমার নানী ছিলেন প্রচন্ড সাহসী, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কুলাউড়ার উছলাপাড়া খান সাহেবের বাড়িতে নানা এ এম আশরাফ আলী সাহেব যখন বললেন “ আমি সরকারী অবসর প্রাপ্ত কর্মকর্তা আমি বাড়িঘর ছেড়ে অন্যবাড়ীতে যাবো না , অন্যদেশে রিফুজী হবো না , মরতে হলে নিজের মাটিতে , নিজের দেশেই মরবো , তুমরা যদি যেতে চাও , যাও “। তিনি যান নি , সাথে নানীও নানাকে ফেলে অন্য কোথাও যাননি ।
নানীকে সর্বদা বড়াই করে বলতে শুনতাম-
“ আমি ভানু নারায়নের বংশধর ,এই তল্লাটে আমার গুষটি গাড়া ভরা , কথায় কথায় তিনি , কৌলা, ইটা,পাল্লাকান্দি,ঘরগাও,পৃথ্বিমপাশা, তরফীবাড়ী,কানিহাটি ইত্যাদিতে তার আত্বীয় জমিদার দের , চৌধুরীদের উদাহরণ দিতেন , অনেকের কথা বলতেন , ভানু নারায়নের কথা বলতেন ,তখন বুঝিনি ,কে এই ভানু নারায়ন ?
পরবর্তীতে জেনেছি , বিশেষ করে এই কুলাউড়ার একজন গবেষক মোহাম্মদ ওয়াহিদ মুরাদ এর লেখা বই থেকে অনেক তথ্য পেয়েছি , শ্রদ্ধা জানাই তাকে কুলাউড়ার অতীত ইতিহাস নিয়ে উনি অনেক কাজ করেছেন ।যিনি তার লেখা ‘ইতিহাসের দর্পনে কুলাউড়া”বইতে উল্লেখ করেছেন -
ভানু নারায়ন ছিলেন একজন প্রতাপশালী রাজা , তিনি এওলাতলীর কাছে রাজধানী স্থাপন করে তার নাম রাখেন “রাজনগর”।তিনি ১৫৪৪ খৃষটাব্দ থেকে ১৫৮০ সাল পর্যন্ত ৩৬ বছর রাজত্ব করেন ।তার মৃত্যুর পর তার পাঁচ পুত্রের মধ্যে বড় ছেলে সুবিদ নারায়ন রাজা হন ।সুবিদ নারায়ন সুশিক্ষিত , সংস্কারপন্থী ও সাহসী রাজা ছিলেন , ত্রিপুরার রাজা অমর মানিক্য বাহাদুর রাজা সুবিদ নারায়ণকে চৌধুরী উপাধীতে ভুষিত করেন । রাজা সুবিদ নারায়ণ ১৫৮০ থেকে ১৫৯৮ খৃষটাব্দ পর্যন্ত ইটা রাজ্যের রাজা ছিলেন । তিনি ইটা রাজ্যের শেষ হিন্দু রাজা । পরবর্তীতে তার বংশের চৌধুরীগন বিভিন্ন এলাকায় ছরিয়ে পড়েন । এই বংশের অন্যতম ভানুগাছের করিম পুর চৌধুরী বাড়ীর কমরুল হাসান চৌধুরীর মেয়ে মনিরুন্নেছা খাতুন কুটি বিবি ই হলেন আমার নানী ।
নানীর সাথে যুদ্ধের সময় বেশ অনেক গুলো জমিদার বাড়ীতে গিয়েছি , তাদের মধ্যে অন্যতম , কানিহাটী চৌধুরী বাড়ী , এই ঐতিয্যবাহী কানিহাটী সম্পর্কে অনেক তথ্য দেওয়ার আছে , কিছু তথ্য না দিয়ে এগুতে পারছি না ।
সুদুর ইয়েমেন থেকে আগত হযরত শাহজালাল (রঃ) সিলেট জয়ের সময় তার সাথে সফরসঙ্গী ছিলেন আরো ৩৬০ জন আওলীয়া ।
তার নির্দেশে বেশ কিছু আওলিয়া ইসলাম প্রচারের লক্ষ্যে তৎকালীন সিলেটের আশেপাশে ছড়িয়ে পড়েন ।
এদের মধ্যে একজন হচ্ছেন -হযরত শাহ হেলিমউদ্দিন নারলুলী।তিনি ভারতের মধ্যপ্রদেশের মুসলমান অধ্যুস্বিত নারউলী অন্চল থেকে আগত সাথীদের একজন ।
‘ তোয়ারিখ হেলিমী ও জালালাবাদের কথা ‘ এবং ‘হযরত শাহ হেলীম উদ্দিন নারলুলী‘ নামের দুইটি বই থেকে জানা যায় ভারতের মধ্যপ্রদেশের নারলুল অন্চলের বাসিন্দা ছিলেন হযরত শাহ হেলিমউদ্দিন (রঃ) তিনি হযরত শাহ জালালের নির্দেশে ইসলাম প্রচারের লক্ষ্যে ত্রিপুরা রাজের নিকটাত্নীয় ও সামন্ত রাজা অসম রায়ের রাজ্যে এসে হাজির হন ।অসম রাজ্যের কাছাকাছি বর্তমান ‘ অসম রায়ের বেরী’ নামক জায়গায় আস্তানা গাড়েন ।কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে মধ্যে রয়েছে ,
রাজা অসম রায় খুউব বাঘ শিকার পছন্দ করতেন , একবার বাঘ শিকারের উদ্দেশ্য বহু লোক ল্ষকর সাথে নিয়ে গহীন জংগলের অনেকটা অংশে জাল দিয়ে বেষ্টনী তৈরী করে বাঘ শিকারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন ।
অনেক ক্ষন অপেক্ষা ও দিন ব্যাপী চেষ্টা করেও বাঘের দেখা না পাওয়াতে রাজা অসম রায় ভীষন
মর্মাহত হন এবং আক্ষেপরত অবস্থায় ছিলেন এমন সময় বনের মাঝথেকে দরবেশরুপী ফকির শাহ হেলীমউদ্দিন নারলুলী বেরিয়ে এসে রাজাকে বললেন ,
“ যে পশুকে রিক্ত হস্তে ধরা যেতে পারে রাজা হয়ে তুমি তাকে অস্ত্রের সাহায্যে শিকার করতে পারলেনা ?”এই কথা বলেই ফকির বনের মধ্যে প্রবেশ করলেন ।কিছুক্ষন পরে খালি হাতে একটি বাঘের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সবার সামনে আসেন ।
পোষা কুকুরের মত বাঘকে সবার সামনে বসিয়ে বাঘকে উদ্দেশ্য করে বললেন “ আর কখনও এদিকে এসোনা ।” বলে বাঘকে তাড়িয়ে দিলেন ।অসম রায় দরবেশের এহেন কান্ড দেখে অভিভুত হয়ে দরবেশকে তার রাজ্য দিতে চাইলেন ।
দরবেশ রাজ্য গ্রহনে অসম্মতি জানালে রাজা অনেক অনুনয় , বিনয় করতে থাকলে একপর্যায়ে এক তীর পরিমান জমি গ্রহন করতে সম্মত হন ।’অসম রায়ের বেরী’ নামক স্থান থেকে তীর নিঃক্ষেপ করা হইলে তীরটি অনেক দুর গিয়ে একটি গাছের মধ্যে আটকে যায় ।যে স্থানে ঐ তীরটি আটকে যায় ঐ স্থানটিই ‘তীরপাশা ‘বা ‘তেরাপাশা’ নামে খ্যাতি পায় ।
ঐ সময়ে ফকির বাবাজি বা দরবেশকে দান করা সম্পত্তির
মধ্যেই রাজা অসম রায় একটি ঘর তৈরী করে দেন যাকে ,ঐ অন্চলে ‘হুজরা’ বলা হয়ে থাকে ।
হুজুর হযরত শাহ হেলিমউদ্দিন নারলুলী (রঃ) সেই হুজরায় বসেই আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী , জিকির আসগার ও ইসলাম প্রচারে মগ্ন থাকতেন ,তখন ঐ অন্চলের লোকেরা দলে দলে ইসলাম ধর্মগ্রহন করতে আরাম্ভ করে সেখানে প্রতিরাতেই দরবেশের হুজরার পাশ্বে লাল লাল বাঘকে বসে থাকতে দেখা যেত ।
সংগত কারনেই ঐ এলাকাটি ‘লালবাঘ ‘নামে পরিচিতি পায় ।একদিন রাতে রাজা অসম রায় একটি প্রদীপ কে দেখেন আপন গতিতে চলতে চলতে হুজুরের হুজরায় চলে আসে এবং এখানে এসে স্থিত হয় , তিনি দরবেশ হুজুরকে আল্লাহর আরাধনায় ধ্যানমগ্ন দেখে অপেক্ষা করতে থাকেন ।দরবেশের ধ্যান ভাঙ্গলে রাজা দরবেশকে বলেন “হে মহান হুজুর ,আমি আর এই রাজ্যে থাকবোনা , আমি আজ ঘুমের মধ্যে দেখলাম আমার লক্ষ্মীর প্রদীপটাকে বেরিয়ে যেতে ,ঘুম ভাংলে দেখি সত্বিই প্রদীপটি স্বগতিতে হেটে যাচ্ছে আমার ঘর ছেড়ে , আমিও তার পিছু নেই , পিছু পিছু আসতে থাকি , এতদুর এসে আপনার আস্তানায় পৌঁছেই সেটি নিভে যায় ।আমি নিশ্চিত বুঝতে পারছি আমার লক্ষ্মীর প্রদীপ আজ আপনার ঘরে , আজ থেকে আপনি এই রাজ্যের রাজা , বলেই তখন তিনি ঐ দরবেশ হুজুরকে পূ্র্বে মনু নদী,পস্চিমে লাঘাটা নদী ,উত্তরে মনু নদী ও তীর পাশা এবং দক্ষিনে কৈলাশহর এই সীমানার মধ্যবর্তী স্থান সমুহকে দান করে নিজে সংসার ত্যাগী হন ।উল্লেখ্য পরবর্তীতে রাজার স্ত্রী কনক রানী ও রাজকন্যা কমলা দেবী ও ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন ।দরবেশ হযরত শাহ হেলিম উদ্দিন নারলুলী (রঃ) কনক রানী ও তার মেয়ে কমলার সুন্দর সচ্ছল জীবন যাপনের জন্য কিছু জমি আলাদা করে দেন যা কনক হাটী বা কানিহাটী নামে পরিচিত । ইতিহাস ঘেটে নিশ্চিত হয়েছি কানিহাটী পরগনাটি এই কনকরানীর নামেই নামকরন করা হয়েছে ।
উল্লেখ্য হযরত শাহ হেলীমউদ্দিন নারলুলী (রঃ) তার পরিবারের কাউকে না জানিয়েই হযরত শাহাজালাল ( রঃ) এর সাথে চলে আসেন ।পরবর্তীতে তার ছেলে দৌলত মালিক পিতার সন্ধানে অসম রাজ্যের লালবাঘে এসে পিতার সাথে দেখা হবার পর তিনিও দেশের কথা ভুলে এখানেই ইসলাম ধর্মপ্রচারে মনোনিবেশ করেন ।কিছুদিন পর দৌলত মালিকের সাথে কনক রানীর মেয়ে কমলার দেখা হলে তিনি তার রুপে মুগ্ধ হয়ে তার পিতার সম্মতিতে কমলা কে বিয়ে করেন । হুজুরের নির্দেশে দৌলত মালিক কনকরাণীর বাড়ির উত্তর পশ্চিমে বাড়ি তৈরী করে সেখানে বসবাস করতে থাকেন ।
তাদের বংশের পরবর্তী পুরুষ সুলতানের নাম অনুসারে সুলতানপুর,ভুঁই মিয়ার নাম অনুসারে ভুইগাও ,দাউদের নাম অনুসারে দাউদপুর,হাজী মিয়ার নাম অনুসারে হাজীপুর ইত্যাদি গ্রামের নামকরন হয়েছে বলে প্রাচীন জনশ্রুতি রয়েছে ।
শাহ হেলিম উদ্দিন নারলুলী (রঃ) হাজীপুরের পরবর্তী বংশধরদের কয়েক জন বিখ্যাত ব্যক্তি জন্মগ্রহন করেছেন , তাদের মধ্যে অন্যতম কয়েক জনের বর্ননা দিচ্ছি ঃ-
তজম্মুল আলী চৌধুরী ছিলেন বৃটিশ আমলে ডি. সি ।
তার ছেলে ব্যারিষ্টার আব্দুল মুন্তাকিম চৌধুরী ছিলেন পাকিস্তান আমলে এম . এল.এ ,তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে ভুয়সী ভুমিকা পালন করেন , দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশ আমলে তিনি ছিলেন এম.পি ।পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রদুত হিসাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গুরু দায়িত্ব পালন করেন ।
তজম্মুল আলী চৌধুরী রা ছিলেন পাঁচ ভাই , তার অপর ভাইয়ের ছেলে আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী বাংলাদেশ সরকারের সচীব , বিভিন্ন প্রতিষঠানের উচ্চপদে দায়িত্ব পালন এবং তত্বাবধায়ক সরকারের সম্মানিত উপদেষ্টা ছিলেন ।একই পরিবারের আব্দুল মুমিন চৌধুরী ও তুফেল হায়দার চৌধুরী ও রাষ্ট্রদুতের দায়িত্ব পালন করেন ।এই পরিবারের অন্যতম বংশধর আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী দীর্ঘদিন হাজিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন ।
তজম্মুল আলী চৌধুরীর অপর ভাই মকবুলুর রহমান চৌধুরীর ছেলে ছিলেন আব্দুল মান্নান চৌধুরী তার ছেলে জুনেদ চৌধুরী , মুক্তাদির চৌধুরী ও আবেদ চৌধুরী যিনি অন্যতম জিন বিজ্ঞানী হিসাবে ধানের নতুন নতুন উদ্ভাবনী গবেষনার মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবী ব্যাপী বিশাল সারা ফেলেছেন ।মুক্তাদির চৌধুরী বা জুবেদ চৌধুরী ছিলেন সংগ্রামী স্বাধীনতা যুদ্ধে অন্যতম সংগঠক । তার ছেলেদের মধ্যে রাশেদ চৌধুরী হেশাম বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্তান করছেন এবং কুলাউড়ায় হাজীপুর সোসাইটি নামক সংগঠনের পরিচালনায় ন্যাস্ত রয়েছেন । অপর ছেলে এমদাদুল চৌধুরী তাহরাম যুক্তরাজ্যে অবস্তান করেও স্থানীয় ক্রীড়াঙ্গনে বিশাল ভুমিকা পালন করছেন , তিনি” জুবেদ চৌধুরী ফুটবল একাডেমী” গঠন করে ঝিমিয়ে পড়া কুলাউড়ার ক্রীড়াঙ্গনে গতির সন্চার করে চলেছেন , তার অপর ভাই সেনাবাহিনীর অবসর প্রাপ্ত মেজর নুরুল মান্নান চৌধুরী হাজীপুর সোসাইটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি একজন লেখক, কবি ও মুক্তিযুদধ গবেষক ।এই বংশের অন্যতম আত্বীয় শফিউল আলম চৌধুরী বা নাদেল চৌধুরীর নাম ও বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য , তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক পরিচালক বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে গুরুদায়িত্ব পালন করে চলেছেন , এই বংশের আরো অনেক অগনিত পুরুষ এবং অনেক মেয়েরাও দেশেবিদেশে অনেক সুনাম অর্জন করেছেন, আগামীতে তাদের নিয়েও আলোচনা করার আশা রাখি ।(চলবে)
৭১ এর স্মৃতি ৩২ -
(কাদিপুর ও রাউৎ গাঁও)
সৈয়দ শাকিল আহাদ
আমরা বর্তমান সময়কে আধুনিক সময় বলছি , বিজ্ঞানের উন্নত প্রযুক্তির ছোয়াতে দেশ ও বিশ্ব অনেক উন্নতি সাধন করে চলেছে , এই চাকচিক্যময় স্বপ্নীল পরিস্থিতিতে ৫২ বছর আগের ঘটে যাওয়া কিছু লোমহর্ষক ঘটনার বহিঃপ্রকাশ , স্মৃতিচারণ , যোগযোগের স্বল্পতার কথা স্বরণ,জ্ঞানী ও গুনী লোকদের অনুপস্থিতি ও স্থানের পরিবর্তন এদেশের আপামর জনগন এমনকি এই লেখা পাঠের দ্বারা এদেশের যেকোন স্থান থেকে বা বিশ্বের যেকোন প্রান্ত থেকে এই লেখাটি পড়ে যে কোন শ্রেণীপেশার পাঠক কিন্চিত পুলকিত হতে পারেন সেটা কোন বড় বিষয় নয় , বিষয় হচ্ছে লেখার বক্তব্য অনুধাবন করে ৭১ সালের ঘটে যাওয়া ঘটনা সমুহের অদেখা বর্ননা পড়ে মনের ভিতর মৃদু অনুভুতিতে আবেগ আপ্লুত হবেন যে কেউ এটাই স্বাভাবিক ।
বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই আধিপত্য বিস্তারে ব্যস্ত - বাড়িঘর , আবার দালানকোঠা তৈরি কিম্বা শিল্পায়ন ও ব্যবসার মত কেবল সম্পদ বৃদ্ধি করতে মত্ব আছেন কোন কোন বোদ্ধা তাদের সাথে টক্কর দেবার মানসিকতা নেই আমাদের কারোরই , আমরা শুধু আমাদের অহংকারের বিষয় ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছি , তাও আবার তৎকালিন সিলেট জেলার কুলাউড়া অন্চলের কথা বলে ।কুলাউড়া তখন সিলেট জেলার অন্তর্গত একটি পরিচিত থানা , রেলযোগাযোগের অন্যতম রেলওয়ে জংশন স্টেশনের একটি গুরুত্বপুর্ন স্টেশন ছিল এই কুলাউড়া থানা , পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে মৌলভীবাজার মহকুমা কে জেলায় উন্নীত করায় কুলাউড়াকে সিলেট জেলা থেকে আলাদা করে মৌলভীবাজার জেলার অন্তর্ভুক্ত করে থানাকে উপজেলায় রুপান্তরিত করা হয় এবং উন্নয়নের পথে পরিচালিত হয়ে কুলাউড়া এগিয়ে যেতে থাকে ।পরবর্তীতে সীমারেখা কমিয়ে জুড়িকে আলাদা উপজেলা করায় কুলাউড়ার পাঁচটি ইউনিয়ন জুড়িভুক্ত হয়ে যায় ।
এই কুলাউড়ার ইউনিয়ন সমুহ ছিল নিম্নরূপ ঃ ১) ভাটেরা
২) বরমচাল
৩) ভুকশিমইল
৪) জয়চন্ডি
৫) ব্রাম্মনবাজার
৬)কাদিপুর
৭) কুলাউড়া
৮) রাৎগাও
৯) পৃথিমপাশা
১০)টিলাগাঁও
১১) শরীফপুর
১২) কর্মধা
১৩) হাজীপুর
১৪) জায়ফরনগর
১৫) জুড়ী
১৬)গোয়ালবাড়ী
১৭) সাগরনাল
১৮) ফুলতলা
এই ইউনিয়ন সমুহের মধ্য উল্লেখযোগ্য একটি ইউনিয়ন হলো কাদিপুর , এই কাদিপুর ইউনিয়নের ডাঃ ফটিক সোমের কথা হয়তো অনেকেই ভুলতে বসেছেন ।তখন পাকিস্তানী আর্মিরা কুলাউড়া ও পৃথিমপাশাতে অবস্তান নেওয়ার পর কাদিপুর ইউনিয়নের অধিকাংশ হিন্দুরা পরিবার পরিজন সহ ভারতে চলে যান কিন্তু এই কাদিপুর গ্রামের ডাঃ ফটিক সোম তিনি তার স্ত্রী ছেলে মেয়ে দের ভারতে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে থেকে যান সবুজে ঘেরা নির্মল গ্রাম কাদিপুরের নিজ বাড়ীতেই ।বিপুল সহায় সম্পত্তি ও বিত্ব বৈভবের অধিকারী ডাঃ ফটিক সোম ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক ডঃ মন্জুশ্রী চৌধুরীর চাচাতো ভাই । আশেপাশের গ্রামের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী রাজাকারর লোভ পরে তার সম্পত্তির উপর , রাজাকারেরা ডাঃ ফটিক সোম ও তার ভাই অযিত সোমকে ভারতীয় স্পাই আখ্যায়িত করে অভিযোগ দেয় পাক সেনা দের কাছে । তাদের ঐ অভিযোগের উপর ভিত্বি করে পাকিস্তানী আর্মিরা দুই ভাইকে ধরে নিয়ে এসে কুলাউড়া নবীনচন্দ্র হাই স্কুলের যমঘরে আটকে রাখে এবং চরম নির্যাতন করে । নির্যাতনের এক পর্যায়ে কয়েক দিন পর ভাই অযিত সোমকে ছেড়ে দেয় পাকিরা এবং ডাঃ ফটিক সোমকে নির্মম ভাবে হত্যা করে । যা স্বরন করে এখন ও অনেক বেশী ব্যাথিত করে তৎকালীন সময়ের অনেক ব্যাথাতুর কুলাউড়া বাসীর হ্রদয়কে । কাদিপুর এর অনেক মুক্তিযোদ্ধার কথা আলোচনা করার ভাবছি আগামীতে বড়পরিসরে আরো অনেকের কথা লেখার ইচ্ছা রয়েছে । চিকিৎসক হিসাবে আরো একজনের নাম এখনও অনেকের মনে আছে তিনি ছিলেন রাউৎগাও এর ডাঃ অক্ষয় কুমার চৌধুরী তিনি ছিলেন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার ।গ্রামের সহজ সরল লোকদের সাথে ছিল তার নিবির সখ্যতা , তার ছেলে অনুপম কান্তি চৌধুরী দেশকে শত্রুমুক্ত করার তাগিদে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে অন্যান্যদের সাথে চলে যায় ভারতে , পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা পাকিদের ভয়ে নিরাপদ আস্রয় ভারতে চলে যায় । দেশের টানে এদেশের মানুষের মায়ায় থেকে যান ডাঃ অক্ষয় কুমার , ভেবেছিলেন তিনি জনগনের সেবা করেন , ডাক্তারী পেশায় আছেন বলে হয়তো তার কিছু হবে না কিন্ত তারপর ও নিস্তার মেলেনি , ২৭ শে মে ১৯৭১ সালে সকালে পাশের গ্রাম দেওগাঁও এর একজন চিন্হিত রাজাকারের নেত্বৃত্বে একদল রাজাকার তাকে পাক মেজরের তলব বলে ধরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে । মুহুর্তেই খবর ছড়িয়ে পড়ে সারা গ্রামে ,খবর পেয়ে ছুটে আসে গ্রামবাসীরা ,তাকে ছাডিয়ে নেবার চেষ্টা করে এমন কি তখন গ্রামবাসীরা ঐ গ্রামের রাজাকারদের নেতা চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করেও ব্যর্থ হয় , তিনি সেদিন কর্নপাত করেন নি , তারা ডাঃ বাবুকে ধরে নিয়ে যায় সদপাশা স্কুলে , সারাদিন ইচ্ছামত শারীরিক নির্যাতন শেষে সন্ধার পর তাকে ব্রাস ফায়ার করে দেহ ঝাঝড়া করে ।তাকে হত্যার পর ঐ চেয়ারম্যান সাহেব তার সকল সম্পত্তি কুক্ষিগত করে ।
রাৎগাওয়ের আরো অনেক হ্রদয় বিদারক ঘটনা রয়েছে এই মুক্তিযুদধ কালিন সময়ে যা বলে শেষ করার মত সময় বে বলে মনে হয় না , তবে কিছু স্মৃতি , কিছু কথা , কিছু নাম বার বার স্বরনে আসে তেমনি ছিলেন প্রবির চন্দ্র ধর , রাধা বিনোদ প্রমুখ ,তিলাশিজুড়া গ্রামের অনেক হিন্দু পরিবার বাপদাদার ভিটাবাড়ী জমি জিরাত ছেড়ে ভিন্নদেশে আশ্রয় নিতে যান নি , বুকে সাহস নিয়ে থেকে গিয়েছিলেন , ৭১ এর কোন একদিন সকালে গ্রামের চৌকিদার একদল লোক নিয়ে এসে ঐ রাজাকার চেয়ারম্যানের নির্দেশে প্রবির চন্দ্র ধর, পুলিন বিহারী ধর প্রল্লাদ ধর ও তাদের এক তালতো ভাই পাশ্বের রাজনগর থানার গন্ডরী গ্রামের বিনোদ ধরকে এক সাথে ধরে নিয়ে যায় চেয়ারম্যানের অফিসে , সেখানে দীর্ঘক্ষন জেরার পর ছেড়ে দেওয়া হয় পুলিন বিহারী ও প্রহল্লাদ ধরকে ,এবং প্রবির চন্দ্র ধর ও রাধা বিনোদকে পাকিস্তানী হানাদার দের কুলাউড়ার নবীন চন্দ্র হাই স্কুল ক্যাম্প পাঠিয়ে দেওয়া হয় ।প্রবির ধরতে পাকিদের হাতে তুলে দিয়ে ঐ রাজাকার চেয়ারম্যান একদল রাজাকার বাহিনীকে সাথে নিয়ে প্রবির বাবুর বাড়ী লুট করে । উল্লেখ্য প্রবির বাবু ও বিনোদ বিহারীকে পাকিস্তানী হানাদারেরা নির্মম অত্যাচারের পর হত্যা করে ।
ঐ সময় আরো একজনের নাম মনে হচ্ছে , তিনি হলেন মনরাজ গ্রামের ক্ষীরোদ মোহন দাসের ছেলে , হরেন্দ্র কুমার দাস । তার বাড়ীঘর এ পাকিরা আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে এবং তাকে নির্মম ভাবে বেয়নেটের খোঁচায় জখম করে রবিরবাজারের কুমুদ রন্জন ডাঃ সহ আলী আমজদ স্কুলের উত্তর পশ্চিম কোনে গর্ত করে , গর্তে ফেলে চরম অত্যাচার করে হত্যা করে ।
অবর্ননীয় অত্যাচারে নিপীড়িত সাধারন দেশপ্রেমিকের আত্মত্যাগ ও রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয় ১৯৭১ সালে । গৌরবময় এই মহান মুক্তিযুদ্ধে আমার তেমন উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহন বা ভুমিকা ছিল না , তা ছাড়া তখন এত ছোট বয়সে তেমন কোন অংশগ্রহন করার মত গ্রহনযোগ্য ও ছিলাম না তবে স্বাধীনতার স্বপক্ষে যারা ছিল তাদের অনেকের স্বান্নিধ্বে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল স্বাধীনতার পর আস্তে আস্তে যখন বড় হতে শুরু করি তখন অনেক কিছুই ভুলে যেতে থাকি ইদানিং সিলেট অন্চলের অনেক উল্লেখযোগ্য স্থানসমুহে বেড়ানোর সুবাদে এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সিলেট অন্চলে ভ্রমন করার বদৌলতে এবং অত্যান্ত সুন্দর এই “আমরার সিলটী আড্ডা”তে লিখতে লিখতে ৭১ এর অনেক সংগ্রামের স্মৃতি নিজের মনের মনিকোঠায় ভেসে উঠতে থাকে এবং বলা যায় তা একে একে অনেক শুভাকাংখী আত্বীয় ও বন্ধুদের অনুরোধে কিছুটা অগোছালো ভাবে লিখতে থাকি এবং ঘুরে ফিরে বার বার সেই কুলাউড়ার কথাই উঠে আসতে থাকে এবং তা ক্রমশ পাঠকদের কাছে গ্রহনযোগ্য হতে চলেছে বলে আমার বিশ্বাস ।
শত্রুমুক্ত করার জন্য জীবন ও রক্তের বিনিময়ে যারা দেশকে স্বাধীন করেছেন , মা , বাবা স্ত্রী, সন্তান এমন কি বাড়ীঘর জায়গাজমির মায়া ত্যাগকরেছিলেন সেই সকল হারিয়ে যাওয়া ত্যাগী প্রিয় মানুষদের কথা বর্তমানে কেউ আর তেমন একটা নেয় না তবে তাদের নাম এখন না নিলে পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো এই নাম গুলো শুনতে চমকে উঠতে পারে তাই তো একটু চেষ্টা করে চলেছি ।
পুরোনো স্মৃতিচারনে রং ছড়ানো ৭১ এর চর্চা সত্বিই অনেক দুরহ কাজ যা করার সাহস দেখিয়ে কতটুকু আমি সফল হবো জানিনা তবে আমার বিশ্বাস আগামী প্রজনম আমার এই লেখা পড়ে কিন্চিত পুলকিত হবে এবং তখনই হবে এই লেখার সার্থকতা । ( চলবে )
৭১ এর স্মৃতি ,পর্ব-২৯ (রাউৎগাও )
সৈয়দ শাকিল আহাদ
অনেক দিন পর আবারও আজ
কি মনে করে জানি লিখতে বসলাম , কত কথাই না মনে পরছে , লিখতে ইচ্ছা করছে কিন্তু ঐ একটাই সমস্যা কোনটা রেখে কোনটা লিখি ? আল্লাহ পাক রাব্বুল আলাআমিন এর কাছে লক্ষ কোটি শুকরিয়া তিনি আমাকে এই সময়েও লেখার ধৈর্য ও স্মৃতি শক্তি প্রখর করে দিয়েছেন যার আলোকে সংগ্রামের ৫২ বছর পরও কিছুটা স্বরন করে ,আবার কিছুটা নানা জনের কাছ থেকে জেনে ,নিজের জানা অংশটুকু সাথে পরখ করে এবং বিভিন্ন সুত্র ও গবেষকদের তথ্য স্মবলিত প্রকাশিত বই থেকে জেনে এর সত্যতা যথার্থভাবে যাচাই করে
আবার আমার মত করে লিখছি ,
“একাত্তরের স্মৃতি “
অনেকটা নেশার মত ।
এ নেশায় মত্ত হওয়া মানেই হচ্ছে নিজেকে ঐ একাত্তর সালে নিয়ে যাওয়া এবং যুদ্ধ কালীন সময়ের ঘটে যাওয়া ঘটনাসমুহ যা এখন ‘গল্প’ তাই চোখের সামনে স্পস্টাকারে ভাসিয়ে তোলা ।
বার বার ঘুরে ফিরে কুলাউড়ার কথাই মনে পড়ে , স্মৃতির পটে চলে আসে ‘কুলাউড়া ‘ ।
কুলাউড়া থেকে দক্ষিন দিকে পৃথ্থিমপাশা কর্মধা হাজিপুর শরীফপুর ইত্যাদি হয়ে ভারতের কৈলাশটিলা যাবার পথটির কথা এই মুহুর্তে একটু বেশীই মনে পড়ছে ,ঐ পথটাই চোখের সামনে চলে আসছে ।
কুলাউড়ার স্কুল চৌমুহনী পেরিয়ে রেল ক্রসিংয়ের পর একটু এগুলেই পড়ে চৌধুরী বাজার ।এই বাজারের দোকান পাঠ বা জনগন এখন আর আগের মত নেই , আধুনিকতার ছোয়ায় আমুল পরিবর্তন এসেছে এই বাজারে ও আশে পাশের এলাকা সমুহে , অতি সম্প্রতি চোখে পড়লো একটি মসজিদ ,যা এই বাজারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সুদুর আমেরিকাতে অবস্তান কারী কৌলার জুবেদ চৌধুরীর ছেলে বড় ছেলে রাসেদুল চৌধুরী হেশাম , কুলাউড়ার লিটন আহমেদ ওরফে ডাকবাংলোর লিটন এবং লন্ডন প্রবাসী তাহরাম চৌধুরী সহ আরো বেশ কয়েক জন কুলাউড়ার প্রবাসী কৃতিসনতানের এবং বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কৌলার মরহুম জুবেদ চৌধুরীর ছোট ছেলে যিনি দেশে অবস্তান করছেন ,সেই মেজর নুরুল মান্নান চৌধুরী ( অবঃ) সহ স্থানীয় অনেকের সমন্বিত প্রচেষটায় ও তাদের সাথে দেশে বিদেশের আরো অনেক স্বজনের অর্থনৈতিক ও সার্বিক সহযোগীতার ফলে এই মসজিদটি নান্দনিক হয়ে উঠছে । অভিনন্দন ও সাধুবাদ জানাই এই প্রচেষটাকে ।
তাদের এই জাতীয় সমন্বিত উদ্দোগ এর ফলে এবং আরো অনেক উদার মনের মানুষের নানামুখী প্রকল্প বাস্তবায়ন এর পরিকল্পনার ফলে সমগ্র কুলাউড়ার পূরোনো মসজিদ সমুহের সংষ্কার ও উন্নয়ন এবং ঐতিয্য সংরক্ষনের চিত্র পরিবর্তন হওয়ার ব্যপারে আমি ভীষন ভাবে আশাবাদী ।
উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশ ও এখন উল্লেখযোগ্য ভাবে বৈদেশিক বানিজ্য ,যোগাযোগ ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিস্তর এবং অকল্পনীয় উন্নতি লাভ করছে যার সুফল গ্রাম পর্যায়ে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করছে ।
এই যেমন একাত্তরে এই রাউৎগাও এর উপরদিয়ে বয়ে যাওয়া রাস্তা অর্থাৎ কুলাউড়া রবির বাজার রোড পাকা ছিল না , পাথরের নুড়ী বিছানো ছিল , এলাকাতে বিদ্যুৎ ছিল না আর এখন গ্রাম পর্যায়ের অধিকাংশ ঘরেই , টিভি , ফ্রিজ. ও এসির ব্যবহার হচ্ছে আগে এসি কি জিনিষ তা কেউ চিনতো না তবে স্বাধীনতার পর দেখেছি কুলাউড়া রেল ষ্টেশনে মেইল ট্রেনের মাঝে একটা বগী থাকতো যার গায়ে বাইরে লেখা থাকতো “ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত” এবং প্লাটফর্মে ঐ বগী টিতে যখন কেউ উঠতো বা নামতো তখন তার চারপাশে ভীড় লেগে যেতো কারন ঐ বগীর যাত্রীরা থাকতেন কোন বিশেষ শ্রেনীর মর্যাদাসম্পন্ন ।
তাকে নিয়ে সবাই কৌতুহলী থাকতেন ।
এই চৌধুরী বাজারেই রয়েছে একটি হাফিজিয়া মাদ্রাসা যেখান থেকে নিয়মিত ছাত্ররা কোরআন শরীফ মুখস্ত করে হাফিজে পরিনত হচ্ছে ।
চৌধুরী বাজার মুলত রাউৎগাও ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত , আমার ফুপুর বিয়ে হয়েছিল রাউৎগাও এর নর্তন সৈয়দ বাড়ীতে , ফুপুর দুই ছেলের মধ্যে অত্যান্ত পরহেজগার ছিল ছোটভাই সৈয়দ এ বি এম মান্নান ,অনেক আদরের সেই প্রয়াত ফুপাতো ভাই মান্নান এর বাড়ীতে যাওয়া আসার সময় রাস্তায় পরতো এই রাস্তাটি ,চৌধুরী বাজারটি । তাছাড়া এই রাস্তা ধরেই যাওয়া আশা করেছি আমাদের সম্ভ্রান্তআত্বীয় স্বজনদের বাড়িতে, বিশেষ করে পৃথ্থিমপাশা, ঘরগাও,পাল্লাকান্দি,আমানীপুর ,কানিহাটি,কৌলা ইত্যাদিতে । এই রাউৎগাও ইউনিয়নের আশে পাশের অনেক গ্রামেরই বাজার সদায়ের কেন্দ্রস্থল ছিল এই ছোটখাটো বাজার , চৌধুরী বাজার তথা রাউৎ গাঁও ইউনিয়ন , এই ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত গ্রাম গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ,
কৌলা,নর্তন , মুকুন্দপুর মৈশাজুড়ি,মনরাজ, হাসামপুর,মিনারমহল , আব্দুলপুর ,একিদত্তপুর, লালপুর,কালিজুড়ি ,বনগাও, আবদা, সজরকান্দি ,নজাতপুর,কৃষ্নপুর , পাল গ্রাম ,বাগাজুড়া,রুস্তমপুর, কবিরাজি, বড়বাড়ী,ভবানীপুর, বনগাও,ভাটুগ্রাম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ।
শিক্ষাক্ষেত্রে কুলাউড়ার অন্যান্য ইউনিয়নের তুলনায় এই রাউৎগাও ইউনিয়ন অনেকটা এগিয়ে এখানকার “ রাউৎগাও হাই স্কুল “ নামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি নির্মিত হয় ১৯২৮ সালে এই অন্চলের অনন্য দানবীর জনাব আব্দুর রহিম চৌধুরী এই স্কুলের জন্য ২৮ বিঘা জমি ওয়াকফ করে দেন তখন এই শিক্ষা প্রতিষঠানটির নাম ছিল “ রাউৎগাও এম ই মাদ্রাসা , ১৯৫৩ সালে তা জুনিয়র স্কুলে রুপান্তরিত হয় এবং পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে যখন আব্দুর রহিম চৌধুরী সাহেবের ছেলে জনাব আ ফ ম ইয়াহিয়া চৌধুরী কুমিল্লার জেলা প্রশাসক ছিলেন তখন তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই স্কুলটি হাই স্কুলে রুপান্তরিত হয় এবং বর্তমানে কলেজ শাখা ও চালু আছে ।জনাব ইয়াহিয়া চৌধুরী প্রশাসনিক দক্ষতায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার জেলা প্রশাসক হিসাবে অত্যন্ত্য সুদক্ষতার সাথে কর্তব্য পালন করে সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচীব হিসাবে অবসর গ্রহন করেন এবং পরবর্তীতে বর্তমান প্রধান মন্ত্রীর একান্তসচীব হিসাবে ছিলেন ১৯৯৬-২০০১ সেশনের পুরোটা সময় ধরে । বর্তমানে তিনি অবসরে আছেন ,তিনি একজন সংগঠক, কবি , লেখক ও অত্যানত উঁচু মানের সাহিত্যিক ।
লংলা আধুনিক মহাবিদ্যালয় নামে একটি কলেজ ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই ইউনিয়নে , তা ছাড়া শাহাজালাল উচ্চ বিদ্যালয় নামে আরেকটি উচ্চ বিদ্যালয় ও স্থাপিত হয়েছে ১৯৯০ সালে ।চৌধুরীবাজার হাফিজিয়া মাদ্রাসা , রাউৎগাও গৌছিয়া সুন্নিয়া দাখিল মাদ্রাসা , ভবানীপুর এবতেদায়ী মাদ্রাসা উল্লেখযোগ্য ।
৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে এই রাউৎগাও ইউনিয়নের অনেক দামাল ছেলেদের অনবদ্য সাহসীকতার কথা শোনা যায় , যারা দেশকে শত্রুমুক্ত করতে জীবন বাজি রেখে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন যুদ্ধে , এদের অন্যতম একজন হলেন রাউৎগাও গ্রামের শহীদ ডাঃ অক্ষয় কুমার চৌধুরীর ছেলে “ অনুপম কান্তি চৌধুরী , মুক্তিযাদ্ধা তালিকা নং ০৫০৪০৪০০০৫ ।তিনি ১৯৭০ সালে কুলাউড়া কলেজে ছাত্রাবস্তায় থাকাকালীন সময়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে যোগদিয়ে ট্রেনিং নেন ।তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে জানিয়েছেন পরবর্তীতে নবাব আলী সারোয়ার খান চুন্নু ,আলাউদ্দিন চৌধুরী ও আব্দুল জব্বার মিয়ার উৎসাহে এবং অনুরোধে উন্নত ট্রনিংয়ের জন্য ভারতের পানিভরা ইয়থ ক্যাম্পে ২১ দিন ও লোহারবনে দীর্ঘ একমাস অস্রচালনা ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফিরে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে , গাজিপুর, আলীনগর , কর্মধা,মুরইছড়া,পাইকপাড়া , শিলুয়া , চাতলাপুর সহ মৌলভীবাজারের বিভিন্ন স্থানে সম্মুখ যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহন করেন ।শিলুয়ার সমিমুখ যুদ্ধে পাক বাহিনীর নিক্ষিপ্ত শেলের আঘাতে পায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে প্রথমে ধর্মনগরে এবং পরবর্তীতে ভারতের কৈলাশহরে হাসপাতালে একমাস চিকিত্সাধীন ছিলেন ।
ক্রমেই সুস্ত হয়ে দেশে ফেরার পর জানতে পারেন অনুপম কান্তি যুদ্ধে যাবার দরূন তার বাবা ডাঃ অক্ষয় কুমার চৌধুরীকে তৎকালীন চেয়ারম্যান এর নেতৃত্বে একদল লোক এসে তাকে তুলে নিয়ে হত্যা করে ।
কিন্তু শহীদ দের নামের তালিকায় তার বাবার নাম নেই ।
উল্লেখ্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পরবর্তীতে দেশ স্বাধীনের পর ,অনুপম কান্তি চৌধুরীর মাতা সুরুচী রানী চৌধুরীকে শহীদ পরিবার হিসাবে তখন দুই হাজার টাকার চেক আর্থিক সাহায্য হিসাবে প্রদান করেন ।
অপর আর এক মুক্তিযাদ্ধা এই রাউৎগাও ইউনিয়নের তিলাশিজুরা গ্রামের মোঃ ফজলের পুত্র আব্দুল মতিনের জন্ম ১৯৫২ সালে ,তিনি ১৯৭১ সালে মৌলভীবাজার কলেজে দ্বাদশ শ্রেনীতে পড়তেন । দেশকে শত্রূমুক্ত করতে তিনিও যুদ্ধে সক্রীয় ভাবে অংশগ্রহন করেন । তার মুক্তিযোদ্ধা ক্রমিক নং -০৫০৪০৪০১১৬ ।
১৯৭১ সালের মার্চমাসে প্রতিরোধ সংগ্রামীদের দ্বারা শেরপুরে ডিফেন্স গঠন করা হলে তিনি তখন সেখানে খাদ্য সরবরাহের মত গুরুত্বপুর্ন কাজের সাথে সম্পৃক্ত হন ।এপ্রিল মাসের প্রথমদিকে এসে তখন যখন ঐ প্রতিরোধ বাহিনী বিভিন্ন ভাবে জেলার বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পরে এক কথায় ভেংগে যায় ।আব্দুল মতিন তখন কুলাউড়ায় চলে আসেন এবং এই অন্চলের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শীর্ষসংগঠক আলী সফদর খান রাজা সাহেব , এবং আলাউদ্দিন চৌধুরী , জুবেদ চৌধুরী সহ আরো বেশ কয়েক জনের সাথে যোগাযোগ করেন এবং পাকিস্তানীরা কুলাউড়া আসার ঠিক তিন দিন পর তাদের নির্দেশে মুরইছড়া সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের টিলাবাজার হয়ে কৈলাশহরে চলে যান ।ভারতের কৈলাশহরের টাউন হলে তখন মুক্তিসেনাদের ট্রেনিং ক্যাম্প , সেই ক্যাম্পে আব্দুল মতিন নিজের নাম লেখান , সেখানে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জনাব ফারুক আহমদ চৌধুরী , ঐ ক্যাম্পে ১৮ দিন ট্রেনিং নেবার পর আসামের লোহারবনে আরো দেড়মাস উন্নত প্রশিক্ষন শেষে
৮ নং সেক্টরাধীন টিলাবাজার ক্যাম্পে ফিরে আসেন ।
সেখানে এসে সময়ে সময়ে বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেন ।
অল্প কিছুদিন পর তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কৈলাশহর ক্যাম্পে ।মুক্তিযুদধের কথা বলতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে জানিয়েছেন তার স্বরনীয় ঘটনার মধ্যে একটি হলো সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে কর্মধা ইউনিয়নে পান্জাবীদের ক্যাম্প আক্রমন ।কোন এক শুক্রবারে এই অন্চলের আর এক সাহসী বীর আব্দুল গফুরের নেতৃত্বে ২৫ জন যোদ্ধা নিয়ে , যাদের মধ্যে সেই দলে ছিলেন মুকিত আহমেদ চৌধুরী , বাদশা , হারুন , মখলিছ সহ আরে অনেকেই ।
সেদিন আকছরাবাদ চা বাগান হয়ে কর্মধা ইউ পি অফিসে স্থাপিত পান্জাবীদের ক্যাম্পে হামলা চালানো হলে , পান্জাবীরা অতর্কিত আক্রমনে বিপর্যস্ত হয়ে গুলি করতে করতে পৃথিম পাশার দিকে পালিয়ে গিয়ে প্রান বাঁচায় ।
আব্দুল মতিন আরো জানান সেদিন পাক সেনাদের ফেলে যাওয়া ৯টি রাইফেল ও কিছু বহনযোগ্য জিনিষ ছাড়া বাকি সবই পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল এবং সবাই আবার কৈলাশহরে ফিরে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন ।
আব্দুল মতিন মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক গুলো আক্রমনের মধ্যে বিশেষ করে মনু ব্রীজ আক্রমন সহ বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলেন বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন সুত্রের কাছে ।
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মতিনের দেওয়া তথ্যমতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই রাউৎগাও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুক্তিকামী মানুষের ও তাদের পরিবারের উপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছিলেন তৎকালীন দূর্যোগময় সময়ে ।
উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে সর্বত্র স্বরনীয় যে ,ঐ বাউৎগাও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ভাটগাওয়ের নিরঅপরাধ আব্দুল গফুরের ছেলে মোঃ ছগির আলীকে নিজ হাতে খুন করেন , ছগির আলীর অপরাধ ছিল তিনি মুক্তিবাহিনীকে সহযোগীতা করেছিলেন ।আরো একটি ঘটনা ও মুক্তিযুদধের ঘটনাবলীর মধ্যে অন্যতম , ঐ চেয়ারম্যান কোন একদিন মনরাজ গ্রামের বশির মিয়াকে নিজ হাতে হত্যা করে ,হত্যার পর ফতোয়া জারি করেন যে , এই লাশ ছোবল না ,
এই কবরস্থানে দাফন করলে কবর অপবিত্র হয়ে যাবে ।
অনেক অনেক মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন এই রাউৎগাও এ যাদের কথা লিখে শেষ করা যাবেনা , তবে দুই একজনের কথা না লিখলেই নয় তাই একটু চেষ্টা করলাম কিছুটা জানাতে । এই ইউনিয়নের অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের নাম এ তাদের অবদানের কথা বিভিন্নভাবে , বিচ্ছিন্ন ভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে উঠেছে , যেমন এই মুহুর্তে রাউৎগাওয়ের অনেকের কথাই মনে পড়ছে , তেমনিএকজন হচ্ছেন আলাউদ্দিন চৌধুরী ,তার পিতার নাম আব্দুল বারী চৌধুরী , মুক্তিযোদ্ধা ক্রমিক নং ০৫০৪০৪০১৩৫ অন্যজন হলেন সৈয়দ আমজদ আলী , পিতা সৈয়দ রমুজ আলী , যতদুর জেনেছি তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার । এরা দুজনেই রাউ্ৎগাওয়ের এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এসে সরাসরি যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন এবং অনবদ্য ভুমিকা রাখেন ।
রাউৎ গাঁও এর আলাউদ্দিন চৌধুরীর অবদান ও ত্যাগ অনস্বীকার্য , পাক বাহিনী এদেশে আসার পর আলাউদ্দিন চৌধুরী ভারতে গিয়ে অস্রচালনা ট্রেনিং নেন ও ফিরে এসে সরাসরী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন । এবং তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সফল সংগঠক ও স্বেচছাসেবক ছিলেন তিনি , তার স্ত্রী জোহুরা আলাউদ্দিন বর্তমান জাতীয় সংসদের এই জেলার মহিলা সংসদ সদস্য।
আরও একজনের কথা বিভিন্ন জনের কাছে বহু শুনেছি , তিনি ও একজন সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধা , তার নাম মোঃ আজহার আলী পিতা মৃত আমজদ আলী , তিনি ১৯৭০ এর নির্বাচনে আএয়ামীলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন ।তার বাড়ী কৌলা , তিনিও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্নস্থানে সরাসরি যুদ্ধ করেন , তার মুক্তিসেনা নং ০৫০৪০৪০১৩৭।
অনেক অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের কথা মনে পড়ছে , যাদের কথা আগামীতে ব্যাপক ভাবে আলোচনা করার ইচ্ছা আছে ।
কিছু ঘটনার সত্যতা মিলিয়ে দেখেছি এই কুলাউড়ার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক মোহাম্মদ ওয়াহিদ মুরাদের লেখা মুক্তি যুদ্ধ ভিত্তিক বই “ মুক্তিযুদ্ধে কুলাউড়া” বই এর সাথে । কৃতজ্ঞতা জানাই মোহাম্মদ ওয়াহিদ মুরাদকে , তিনি অনেক পরিশ্রম করেছেন সুন্দর একটি গবেষনার মাধ্যমে , তা না হলে হয়তো আমরা বা আমাদের আগামী প্রজন্ম কুলাউড়া অন্চলের মুক্তিযুদধের অনেক তথ্য পাওয়া থেকে বন্চিত হতো ।
তথ্য ও ছবি সংগ্রহে কৃতজ্ঞতায় ,
১) আ. ফ.ম. ইয়াহিয়া চৌধুরী
২)মেজর (অবঃ ) নুরুল মান্নান চৌধুরী
৩) ফাতেউল আলম সোহেল
৪) মোহাম্মদ ওয়াহিদ মুরাদ
( চলবে)
৭১ এর স্মৃতি :~ পর্ব ৩৭ (কুলাউড়া-৩)
সৈয়দ শাকিল আহাদ
স্বাধীনতার সেই ভয়াল স্মৃতি , আতংকিত সময় , অনিশ্চিত জীবনের অতিবাহিত দিন রাত সমুহের চিত্র ফুটিয়ে তোলার কিছু নেই যাঁদের মনে আছে তারা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করবেন “ খুউবই কষ্টের সময় কেটেছে সেই সময় আমাদের কুলাউড়ায় “ ।
৬ ই মে যখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কুলাউড়াতে আসে তখন সেদিন থেমে থেমে দুই একটি গুলির শব্দ হয়েছিল পাকিদের অতর্কিত হামলায় সমগ্র কুলাউড়ার জনগন সেদিন স্তম্ভিত হয়ে পড়ে । । গোটা শহরে আতংক ছড়িয়ে পড়ে, সন্ধার পর আলো আঁধারে মানুষের মধ্যে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য যে যেদিকে পারে ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছিল ।অধিকাংশরাই সবকিছু ফেলে প্রান বাঁচানোর জন্য শহর থেকে দুরে পাকিদের ত্রিসীমানার বাইরে কোন আত্বীয়ের বাড়িতে বা ওপারে অর্থাৎ দেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতীয় আশ্রয় শিবিরে গিয়ে দিনাতিপাত শুরু করেন ।
কুলাউড়ার তথা কথিত চিন্হিত মুসলীম লীগ ও স্বাধীনতা বিরোধীদের পাকিদের সাথে একাত্বতা প্রকাশ করে বীরদর্পে নিজের এলাকার লোকজনদের সাথে যমঘরে ধরে এনে খারাপ ব্যবহার করা , বাড়ীঘর লুটপাট করে তাদের সর্বস্বান্ত করে দেওয়া , বাড়িতে আগুন দেওয়া ইত্যাদি জঘন্য কাজে লিপ্ত হওয়ার সাথে যারা যারা জড়িত ছিলেন তাদের প্রতি তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি সাথে তাদের কৃতকর্মের জন্য ঘৃনা প্রকাশ করছি ।
কুলাউড়া থানা বরাবরই রাজনীতি সচেতন ছিল অর্থাৎ সেই স্বাধীনতার পুর্বেই ষাটের দশকের শুরুতে যারা শহরটিকে সরগরম করে রাখতেন তাদের কয়েক জন ছাত্রনেতার নাম এখানে দেওয়ার তাগিদ অনুভব করছি এরা হলেন ,
১) সৈয়দ জামাল উদ্দিন
২) গিয়াসউদ্দিন আহম্মেদ
৩) নুরুল ইসলাম ভুইয়া
৪) আব্দুল মন্নাফ
৫) শেখ ফখরউদ্দিন আহম্মেদ
৬) জানে আলম ভুইয়া
৭) খালেদুর রব
৮) গিয়াস উদ্দিন ( কাছুর কাপন )
৯) সৈয়দ আছমাতুর রহমান
১০) আব্দুল মতিন মিকি
১১) মইনুল ইসলাম মনু
১২) মো: সুলেমান
১৩) আব্দুর রকিব খালেদ
১৬) আব্দুল মতলিব
১৭) হায়দর আলী
১৮) মনির আহমেদ চৌধুরী ও আরো অনেকেই ।
৭০ এর নির্বাচনে নৌকার পক্ষে সবচেয়ে বেশী ভোট পড়েছিল রেলওয়ে কোলনী এলাকায় তাই রেলওয়ে কোলনীর প্রতি বিরুপ মনোভাব ছিল ততকালীন স্বাধীনতা বিরোধী নেতাদের , রাজাকারেরা সহযোগীতা করেছিল পান্জাব থেকে ছুটে আসা হানাদার বাহিনীর অধিনায়ক মেজর আব্দুল ওয়াহিদ মুঘল ও ক্যাপ্টেন দাউদ ও তার সহোযোগীদেরকে । রেলওয়ে কলোনীর বাসিন্দা ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা নুরুল ইসলাম ভুইয়া ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতা এখলাসুর রহমান ও কর্মী হানিফ, হানাদার বাহিনীর সদস্যরা এদের ধরে আনে এদের সাথে রাজনগর থেকে ধরে আনা হামিদ ও সিরাজ উদ্দিনকেও এক সাথে গুলি করে হ্ত্যা করে । কুলাউড়া বালিকা উঁচ্চ বিদ্যালয় , নবীনচন্দ্র হাই স্কুল , সদর হাসপাতাল ও পৃথিমপাশা নবাব বাড়ীর একটি অংশ ছিল পাকিস্তানী ক্যাম্প ।
এই সমস্ত ক্যাম্পে কুলাউড়ার নিরীহ মানুষদের ধরে এনে অমানুষিক অত্যাচার করতো , এখানে এনে যাঁদের নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছিল তাদের মধ্যে রেল কর্মচারী আব্দুল আলীম , মফিজ আলী , আব্দুল হামিদ প্রমুখের নাম না নিয়ে পারছি না ।প্রতিদিনই স্থানীয় কিছু রাজাকার ও কথিত শান্তি কমিটির সদস্যদের দ্বারা প্রস্তুত তালিকা থেকে কুলাউড়া শহর এলাকা ও প্রত্যনত্য গ্রাম থেকে লোকজনদের ধরে এনে
যমঘরে রেখে অত্যাচার করতো ও রেলের পাশে নিয়ে পাখীর মত গুলি করে মারতো ।
কি পরিমান লোক যে তারা মেরেছে সেই সময়ের নিহতের সংখ্যা যে কত ছিল ?
তার সঠিক সংখ্যা কারো পক্ষেই নির্নয় করা সম্ভব হয়নি আর তা কবে হবে তা কেউই বলতে পারি না । বিচ্ছিন্ন ভাবে এক এক জায়গায় এক এক জন এক এক ভাবে লিখে রেখেছেন । কেন্দ্রিয় ভাবে তা লিখে রেখে সংরক্ষন প্রয়োজন ।
কতজনকে হত্যা করলো তা লিখে রাখার মত দায়িত্ব কেউ নেয়নি কারন তখন সবার মনের মধ্যেই ত্রাহী ত্রাহী অবস্তা । কখন কাকে হ্ত্যা করে বসে সেই চিন্তায় অস্থির ছিলো সকলেই । তবে ক্যাম্প সমুহে শহীদ হওয়া অনেকের নাম বিভিন্ন লেখক , গবেষকেরা তাদের লেখায় বিভিন্ন ভাবে উল্লেখ করেছেন আমিও তাদের একটি অংশের কথা উল্লেখ করছি :~
বিশেষ করে
উত্তর কুলাউড়ার সালামত উল্লাহ ,সোনাপুরের নানু মিয়া , চাতলগাওয়ের আব্দুল কুদ্দুস , রাংঙ্গিরকুলের হারিছ আলী দরছ উল্লাহ , কর্মধার মকবুল হোসেন , আতর আলী , গাজীপুরের মজই মিয়া , পৃথিমপাশার ডাঃ সুশীল , নগেন্দ্র দাশ , রেলওয়ের আব্দুল আলিম , আব্দুল হামিদ এর নাম উল্লেখ যোগ্য ।
কুলাউড়ার অন্যতম ছাত্রলীগ নেতা গিয়াসউদ্দিন আহমেদ বা গিয়াস ভাইয়ের অবদানের কথা মিকি ভাইয়ের অবদানের বলে শেষ করার মত নয় যদিও গিয়াস ভাই পরবর্তীকালে জাসদের রাজনীতিতে যুক্ত হন ।
তার লেখা” পুর্ব পাকিস্তান ও ছাত্রলীগের কথা “এবং “কেন ছয় দফার প্রয়োজন “
নামে দুইটি বুকলেট হানাদার বাহিনীর হাতে পড়ে এবং তারা মরিয়া হয়ে উঠে গিয়াস ভাইকে ধরার জন্য । তার সাথে নির্যাতন ক্যাম্পে ধরে আনা হয়েছিল কমিনিষ্ট নেতা নুর আহমেদ সহ আরো ৭/৮ জনকে । সেদিন অত্যাচারের এক পর্যায়ে নুর আহমেদের পা ভেংগে দিয়েছিল পাকিরা ।
ততকালীন ছাত্রনেতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রামী জীবনের কথা বলছি কারন বর্তমানে কুলাউড়ার অনেক হোন্ডা বাহিনী , গুন্ডা বাহিনী গড়ে উঠেছে যারা জমি দখলের মহড়ায় ব্যস্ত যারা জানে না গিয়াস ভাই , মিকি ভাইদের কথা , রাজনীতির ময়দানে কিম্বা ফুটবল খেলার মাঠে কোথাও বীরের বেশে এগিয়ে যেতে কার্পন্য করেন নি যারা ,
ইদানিং লক্ষ্যনীয় হাইব্রীড নেতাদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত আমাদের প্রজন্মেরা ,মিছিলে মিটিয়ে উপস্থিত থেকে নিজেদের মুল্যবান সময় ও ভবিষ্যৎ নষ্ট করায় ব্যস্ত তাও আবার কিছু সংখ্যক মোটর সাইকেলে কয়েকটি টাকার তেল ভরার জন্য সদা চিন্তিত , মোটাতাজা নেতার সাথে থেকে সেলফী তুলে নিজেদের নেতা পরিচয় দিতে পারলে আনন্দিত বোধ করেন , তাদের দেখলে মায়া হয় এরাও যে আমাদেরই পরবর্তী প্রজন্ম , নৈতিক শিক্ষা বর্জিত , তারা কাউকে তোয়াক্কা করার কথা ভাবে না , সুশিক্ষা এবং স্বশিক্ষা থেকেও বন্চিত হচ্ছেন উনারা উনাদের জন্য কি কেউ কিছু করবে না ?
( চলবে)
৭১ এর স্মৃতি -১২
সৈয়দ শাকিল আহাদ
সংগ্রামের সময় কেমন ছিল কুলাউড়া?
দোকান পাঠ ও রাস্তা ঘাট কেমন ছিল ?
যতদুর মনে পড়ে ,এক রাস্তার শহর কুলাউড়ার উছলাপারায় আমাদের নানা ছিলেন অবসর প্রাপ্ত জেলা রেজিষ্টার জনাব এ এম আশরাফ আলী , আমি সেখানেই ছিলাম , সেই খান সাহেবের বাড়ি থেকে বের হয়ে বটগাছের নিচে এসে বড় রাস্তায় অর্থাৎ কুলাউড়া মৌলভীবাজার রোডে উঠে উত্তর দিকে এগুলেই একটু সামনে আসলে প্রথমেই ছিল আমাদের বাড়ির আর একটি রাস্তা যা ছিল মুলত চটই মামু ও সত্তার মামুর ‘ বাড়িতে যাওয়ার জন্য বড় রাস্তা থেকে আইল মার্কা রাস্তা , বৃষ্টির সময় ঐ রাস্তা কর্দমাক্ত থাকতো যা দিয়ে চলাচল অত্যান্ত দুর্বিসহ ছিল ।তার পরে খাই , ঐ খাই এর পাশে রশি টাংগানো থাকতো ,যেখানে রশি গুলো কাপর ধুয়ে শুকানোর জন্য ব্যবহৃত হতো , আরএকটু এগুলেই পশ্চিমদিকে ছিল কনা নানার বাড়ী , তিনি কাদিপুর ইউনিয়নের করণিক ছিলেন , সেটাকে কেরানী সাহেবের বাড়ি বললেই সবাই চিনতো ,কনা নানার একটি সাইকেল ছিল , মুলত সেই সাইকেলে চড়ে তিনি কাদিপুর যাওয়া আসা করতেন ,নানী ছিলেন ভীষন সুন্দরী , নাম জানতাম না বলে তাকে “সুন্দরী নানী” বলেই ডাকতাম ,কনা নানার এক ভাই ছিল নাম ‘গেদন’, গেদনের একটি ‘তরজার বেড়ার ‘ মুদির দোকান ও ছিল , গেদনকে নানা রকম অপকর্মের জন্য অনেকেই এক নামে চিনতো , মতি মিয়া নামের তাদের এক ভাগিনা গেদনের অনুপস্থিতিতে ঐ দোকানটি চালাতো ,পাশেই ছিল ছানা নামের কুলাউড়ার একমাত্র ধোপার দোকান , ছানাকে সবাই চিনতো কারন তার দায়িত্বে থাকতো ময়লা কাপর পরিষ্কার করার বিষয়টি ,তাকে সারা কুলাউড়ার অধিকাংশ লোকের কাপর ধোয়া ও ইস্ত্রির কাজে লিপ্ত থাকতে দেখা যেতো, ছানা নিজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাপর সংগ্রহ করে ধোলাই করে দুই দিন পরে সুন্দর করে ইস্ত্রি করার পর ফেরত দিয়ে আসতো , তার ইস্ত্রিটিও ছিল লোহার একটু বড়সর , কয়লা গরম করে সেটাকে উত্তপ্ত করে কাপর ইস্ত্রি করতে দেখা যেত।
কনা নানার বাসার পরেই ছিল পশু ডাক্তারখানা , এখানে একটি সুপেয় পানির চাপ কল ছিল । বিপরীতেই ছিল একমাত্র সিনেমা হল , যার নাম পুবালী সিনেমা হল , এর পাশেই স্বাধীনতার পর পরই আর একটি সিনেমা হল হয়েছিল যেটি ছিলো লিলি সিনেমা হল , পরবর্তীতে লিলি সিনেমা হলটি স্টেশন রোডে স্নানান্তরিত হয় ।একটু এগুলেই পশ্চিমে ছিল তারিণী বাবুর বাড়ী ও বাড়ির সামনে ছোট্ট একটি পুকুর , রাস্তার সামনেই ছিল একটি কামারের দোকান ,ঐ খানে দাড়িয়ে লোহা গরম করা দেখতাম , ভাল লাগতো দেখতে দুই তিনজন মিলে কয়লা পুড়িয় লোহা গরম করে পিটিয়ে দা কুড়াল , খন্তি বানানো দেখতে , কামারের দোকানের পরেই ছিল বিমলদের ঝুপরি মার্কা একটি চায়ের দোকান দোকানটি খোলার ব্যবস্তা ছিল অনেক মজার, এক পাশ্বে তরজার দুই পার্ট ওয়ালা ডালা , ডালাটি একটি বাঁশ দিয়ে ঠেক দিয়ে রাখা হতো আর ফ্লোরটি ছিল মাটির , ঐ দোকানটিতে তিনটি টুল ও দুইটি উঁচু বেন্চ ছিল ,
ঐ চায়ের দোকানে চা য়ের সাথে লুচী এবং সুজীর হালুয়া ও বিক্রি হতো ,
এর পরেই ছিল মটর স্ট্যান্ড,হাতে গোনা কয়েকটি মোটর গাড়ি কুলাউড়া হতে মৌলভীবাজার রোডে চলাচল করতো, বিপরিতে অর্থাৎ পূর্বদিকে ছিলো জব্বার মিয়া নামক এক লোকের খালুয়ার ঘর বা চামরার গুদাম , ভীতরে একটি ডোবা আকৃতির পুকুর ও ছিল, যা কচুরী পানায় আবৃত থাকতো । যে পুকুরে গরুর চামরা ও মটর গাড়ির চাকা ইত্যাদি ধোওয়ার কাজে ব্যবহৃত হতো , ঐ পুকুরের ভিতরে পূর্বদিকে ঘাটলা ছিল , ঘাটলাটি কালো সুন্দর ঝাঝের মত চার কোনা পাথরের দ্বারা বাধাই করা ছিল ।মটর স্ট্যান্ডের কথাটি বেশ মনে হতো ।
সম্ভবত সংগ্রামের পর পরই বা আগেও হতে পারে সেই মটর য্ট্যান্ডে আলালপুরের হাফিজ সাহেবের ছেলে ‘লেদু মিয়া’ মামার একটি চায়ের দোকান ছিল । সেখানেও ভাল চা নাস্তা পাওয়া যেতো , বিপরীতেই ছিল হাজি ইয়াকুব আলীর দালান । মোটর স্ট্যান্ডের পরই ছিল কুলাউড়া পোস্ট অফিস , পোস্ট অফিসটি ছিল অত্যান্ত্য সুন্দর , বৃটিশদের ডিজাইনে তৈরী করা সুন্দর একটি অফিস হাফ বিল্ডিং , এর পরই ছিল একটি খাই বা ডোবা , এই ডোবার পাশ দিয়ে সফাত মাস্টরের বাসা র পাশ দিয়ে দক্ষিন বাজার পেরিয়ে বি এইচ স্কুলে যাওয়া আশা করতাম ।তার পরেই ছিল কুলাউড়া জামে মসজিদ , ঐ মসজিদের ই মক্তবে ফজরের নামাজের পর ইমাম সাহেব , হুজুর সৈয়দ রাশিদ আলীর কাছে আমি ও এলাকার আশেপাশের অনেক কোমলমতি শিশু কিশোরেরা নিয়মিত আরবি পড়তাম , তিনি অনেক লম্বা ছিলেন ও পাগড়ী পড়তেন ও কাঠের খড়ম পড়তেন বলে আমরা সবাই তাকে পাগড়ী ওয়ালা হুজুর এবং কেউ কেউ খড়মঅয়ালা হুজুর ও বলতাম , উনার ছেলের নাম ছিল জুবায়েদ আলি ,মসজিদের পিছনে ছিল অজু করার জন্য ছোট্ট একটি পুকুর ,পুকুরের পশ্চিমে ছিল লাবু পালের বাসা ,তিনি পরবর্তীতে ঐ বাসা মসজিদের নিকট বিক্রয় করে অন্যত্র চলে যান ।
এই মসজিদের উন্নয়নের জন্য পথচারীদের কাছ থেকে পালা করে টাকা , মুঠির চাল ঊঠাতেন যে দুই তিন জনের কথা এত বেশি মনে পড়ছে যাদের কথা না বললেই নয় , উনারা হচ্ছেন একজন আমাদের পিছনের বাড়ির মনাউল্লাহর ছেলে ‘চটই মিয়া’ও অন্য জন ‘আতই মিয়া’,সাথে নাজমা হোটেলের মালিক ছিলেন মনসুর গ্রামের ‘কনা মিয়া ‘তাকেও মসজিদের উন্নয়ন কাজে বলিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত থাকতে দেখা গেছে ,মসজিদের সামনে কয়েকটি দোকানের মধ্যে ছিল,
কারি সাহেবের ভুষিমালের দোকান,আবুল মামার লেপ এর দোকান,আতই মিয়ার হোমিও হল।
মসজিদের একটু আগে বিপরিতে একটি আমগাছের অস্তিত্বের কথা স্পষ্ট মনে আছে , ঐ আমগাছের নিচেই ছিল লষ্কর পুরের লুলু মিয়া মহরীর ভাগিনা মতিন ভাইয়ের সাইকেলের দোকান । পাশেই ছিল জহির আলী হাজি মামার ছেলে মুহিব ভাইয়ের মাইকের দোকান ( সম্ভবত স্বাধীনতার পরে হয়েছে ) আরও ছিল “ আহমেদ ক্লথ ষ্টোর” নামে একটি কাপরের দোকান।
ঐ আমগাছের নিচেই একটি মুচী বসতো , তার একটু পিছনেই একটি লেম্প ও হারিক্যান এর চিমনী ও নানা রকম লোহার সামগ্রী
ও তারকাটা ও পিতল ,লোহার দ্রবাদি বিক্রির একটি দোকান এবং একটি নিমকি ও মিষ্টির দোকান ও ছিল ।
মসজিদ সংলগ্ন বিল্ডিং এ তিনটি দোকান খুউব বিখ্যাত ছিল ,লষ্করপুরের আবুল চৌধুরীর ‘রিয়াজ শার্ট ‘ , আলাউদ্দিন চেয়ারম্যান সাহেবের ভাই ,বাচ্চু মামার “ বিলাস বিপনি ও “ রামগোপাল ফার্মেসী ,
ঐ বিল্ডিং এর উপরে জুবেদ মামার অফিস এবং নীচে সিড়ির কোনায় একটি ঘড়ি মেকানিকস এর দোকানের কথা এ মনে পড়ছে , উনার বাড়ী সম্ভবত মনসুর এলাকায় ছিল এবং এই ঘড়ির দোকানটি পরবর্তীতে কাদিপুর রোডে ইরফান আলী মামার বাড়ীর বিপরীতে চলে যায় ।
মাগুরা হয়ে এই রাস্তাটিকে মনসুর রোড বা কাদিপুর রোড ও বলা হতো, মুখেই ছিল মোমিন মিয়ার বড় মুদি দোকান ও তার পর একটি চাউলের দোকান , এই পাড়ে ছিল একটি পানের আড়ৎ ও একটি চুল কাটার সেলুন , চুল দাড়ী সাধারণত বাজারের ভিতরেই দক্ষিন পুর্বকোনে কাটতে দেখতাম , ছোট বড় সবাইকেই ।এই রাস্তায় ছিল কালীবাড়ি ও বশিরুল হুসেন বা বি. এইচ প্রাইমারী স্কুল , এই এলাকা আগে কৌলার জমিদার বশিরুল হুসেন জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ছিল ।তার নাম অনুসারেই এই স্কুলটি স্থাপিত হয় ।
দক্ষিন বাজার থেকে থানায় যাবার পথে ছিল মক্তোদির নানার রেশনের দোকান তার পাশ দিয়ে একটি টিপা রাস্তা রেল কোলনি ভেদ করে স্টেশনে পৌছেছে ,
একটু পাশেই ছিল ঢাকাইয়া তারা মিয়ার “রেইনবো বেকারী “, তাদের এক ছেলের নাম ছিল কাদির ,,একটু সামনে এগুলেই বাম দিকে ছিল কুলাউড়া থানা , রাস্তায় দাড়িয়ে থানার কার্যক্রম দেখা যেত , থানার এক পাশে ওসি সাহেবের রুম ,অন্য পাশ্বের রুমে অন্যান্য দারোগার বসার জায়গা ও তিন চারটি টেবিল ছিল , টেবিলের উপর থাকতো মোটা মোটা চারকোনা বড় বড় খাতা , মাঝখানের রুমটি ছিল হাজত খানা , কেউ আটকা পড়লে তাকে দেখার জন্য রাসতায় কৌতুহলী লোকের লাইন পরতো, থানার বিপরিত দিকে ডাকবাংলো , ডাক বাংলোর কোনায় ছিল ফুটবলার লিটন দের বাসা , লিটন বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী , ইন্টারনেট এর কল্যানে কথা বলার সময় কুলাউড়ার বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে লিটনের কাছে থেকে অনেক অতীত তথ্য ও ইতিহাস পাওয়া যায় ।
ডাক বাংলা পেরুলেই ছিল ইউনিয়ন অফিস , আওয়ামীলীগ অফিস , এখানে একটি খাবার পানির কল ছিল , সারাক্ষন পানি পরতো এবং আমরা অবাক হতাম এত পানি কোথা থেকে আসে ?
স্টেশন রোডে ছিল পুরোনো হাসপাতাল , জয়পাশার কাদির মিয়া ও সিকান্দর ভাইয়ের পরিচালনায় “ সিকান্দর ক্লথ ষ্টোর “ দক্ষিন ভাগ চা ষ্টল “ জেলা পরিষদের ডাকবাংলো,লাবু কাকার মিষ্টির দোকান,
ময়না হাজির চাউলের দোকান , মোস্তাক মিয়ার “রহমানিয়া ষ্টোর ,”শফিক হাজীর রড সিমেন্টের দোকান ,জয়পাশার একটি লাইব্রেরী ও সাহেব বাড়ীর সৈয়দ হাবিবুল্লাহের আরোগ্য নিকেতন নামের ফার্মেসী , কয়েকটি কাপরের দোকান ও সত্তার মিয়ার অফিস ইত্যাদি উল্লেখ যোগ্য,
চৌমুহনী মোড়ে আলাউদ্দিন হাজী সাহেবের “ কুলাউড়া রেষ্ট হাউজ “
মোবারক মিয়ার “ আজম বোডিং এবং উত্তর বাজারের দিকে যাবার পথে “জয়নাল আবেদিন সাহেবের স্টার এজেন্সী, কালামিয়ার লেপের দোকান , বিপরীতে ডা: রিয়াজ উদ্দিনের চেম্বার ,তিনি হাজি ফরমুজ আলীর বাসায় ভাড়া থাকতেন ।
সনু মেম্বারের ফ্যাশান কর্নার , মজিদ মিয়ার বিওসি তেলের পাম্প ,সাধনা ঔষধালয় , শক্তি ঔষধালয়,রায় কুঠি বিল্ডিং , “ মর্ডার্ন ফার্মেসি , প্রবন বাবুর হোমিও হল , রোডস এর অফিস ,ডাঃশিশির বাবুর ‘ শিশির হোমিও হল , পপুলার লাইব্রেরি ,উত্তর বাজার জামে মসজিদ ,সাব রেজিষট্রী অফিস ( মজার ব্যপার হলো এই অফিসের সাব রেজিষ্টার সাহেবের মাথার উপরে হাতে টানা পাখার ব্যবস্তা দেখতে ভীর করতাম আমরা অনেকেই )উত্তর বাজার ,সি ও অফিস রোড , আলাউদ্দিন হাজী সাহেবের বাড়ি , তাজু হাজীর রাইস মিল ,রাবেয়া স্কুল ,দুএকটি টং দোকান,কয়েকটি মূহরীর গদি , এনাম ভাইদের ঔষধের দোকান , কুলাউড়া হাসপাতাল সহ আরো কত কিছু ?
সারা কুলাউড়ায়ে সম্ভবত দুইটি স্টুডিও ছিল
ষ্টুডিও নটরাজ ও অজন্তা ।
(চলবে)
পৃথিমপাশার ঐতিহাসিক নবাববাড়ী
সৈয়দ শাকিল আহাদ
১৯৭১ সালে এই অন্চলের একজন অন্যতম বিশ্বস্ত ব্যাক্তিত্ব ছিলেন ‘রাজা সাহেব ‘। রাজা সাহেব কে আমি দেখি নাই তবে তার সম্পর্কে আমার বড় মামা আমির আলী ও পরিবারের অন্যান্য সকলের কাছে এত শুনেছি যার বদৌলতে শুনতে শুনতে তার অস্তিত্ব মনের মাঝে গেথে আছে এবং তার সেই পৃথিমপাশা নবাব বাড়ি সম্পর্কে এত বেশি ভাল শুনেছি যা বলে বা লিখে শেষ করতে পারবো না তারপর ও একটু চেষ্টা করে দেখি ,
কথায় আছে ,
“বেটা থাকলে আলী আমজাদ
আর সব পুয়া
হাওড় থাকলে হাকালুকী
আর সব কুয়া !”
সিলেটের এই বিখ্যাত প্রবাদ দিয়েই এই পর্ব শুরু করছি ,
মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে ২৫ একর বিস্তৃত সাজানো-গোছানো জমিদার বাড়ির অবস্থান ৪৭ কিলোমিটার পূর্বে। পুরোনো কয়েকটি স্থাপনার সঙ্গে রয়েছে জমিদার নির্মিত শিয়া সম্প্রদায়ের একটি চমৎকার নকশা খচিত ইমামবাড়া।
প্রত্যেকটি স্থাপনাতেই আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট।
পাশেই রয়েছে চমৎকার শান বাঁধানো ঘাটসহ সুবিশাল দীঘি।
পৃত্থিমপাশা জমিদার বাড়ি
যা পৃথিমপাশা নবাব বাড়ি নামেও
পরিচিত , সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলায় জমিদারী আমলের স্মৃতি বিজড়িত এক ঐতিহাসিক এবং অপূর্ব স্থাপনার নাম পৃত্থিমপাশা জমিদার বাড়ি। পৃত্থিমপাশায় রয়েছে দু’টি জমিদার বাড়ি। এই জমিদার বাড়ির মতো জীবন্ত জমিদার বাড়ি বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়টি নেই ।
ইরানের রাজা রেজা শাহ পাহলভি এই বাড়ি সফরে আসেন তখন তার সফরকে নিরাপত্তা দিতে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার প্রধান হুকুম জারি করলে আইয়ুব খান কে পাঠানো হয়।
পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে এই আইয়ুব খান মার্শাল'ল জারি করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হোন।
এই এলাকাটি এক সময় ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। এখানকার পাহাড়ি এলাকায় নওগা কুকি উপজাতির বেশ প্রতাপ ছিল। শ্রীহট্ট সদরে যা বর্তমানে সিলেট ,সেই সময় একজন কাজী ছিলেন যার নাম মোহাম্মদ আলী। ১৭৯২ সালে ইংরেজ শাসকদের পক্ষ হয়ে নওগা কুকিদের বিদ্রোহ দমনে মোহাম্মদ আলী গুরত্বপূর্ন ভূমিকা রাখেন।
ইংরেজ সরকার এতে খুশি হয়ে মোহাম্মদ আলীর পুত্র গাউস আলী খাঁনকে ১২০০ হাল বা ১৪,৪০০ বিঘা জমি দান করেন।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় চট্টগ্রাম থেকে হাবিলদার রজব আলীর নেতৃত্বে একদল বিদ্রোহী সৈন্য সিলেট আসলে তার সমর্থন চান।
তিনি সরাসরি সাহায্য না করে তাদেরকে পাহাড়ী এলাকায় অবস্থান করার পরামর্শ দেন।
যুদ্ধ শেষে গাউস আলী খানকে বিদ্রোহে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করে ,তবে প্রমানের অভাবে ছেড়ে দেয়া হয়।উত্তরাধিকার সূত্রে এউ জমিদারীর মালিক হন তার ছেলে আলী আহমদ খান।
আলী আহমদের সময়ে জমিদারীর আয় ব্যাপক বৃদ্দি পায় এবং তিনি ব্রিটিশ আনুকুল্যও লাভ করেন। তার সময়ে চাদনীঘাট এবং সুরমা নদীর তীরে সিলেট শহরের গোড়াপত্তন হয়। ১৮৭২ সালে ছেলে আলী আমজাদ খানের নামে একটি ক্লক টাওয়ার স্থাপন করেন যা এখন আলী আমজাদের ঘড়ি নামে বিখ্যাত। নবাব আলী আমজাদ খাঁন তখনকার সময়ে বৃহত্তর সিলেটের মধ্যে সবচেয়ে স্বনামধন্য এবং প্রভাবশালী জমিদার ছিলেনে। । সিলেটের বিখ্যাত সুরমা নদীর তীরে চাঁদনীঘাটের সিঁড়ি সমাজসেবায় তার একটি অন্যতম দৃষ্টান্ত। ঐ সময় পৃত্থিমপাশা জমিদার বাড়িতে ত্রিপুরার মহারাজা রাধা কিশোর মানিক্য বাহাদুরসহ বহু ইংরেজ ভ্রমণ করে গেছেন। ইরানের রাজাও ভ্রমণ করে গেছেন। জমিদার বাড়ির ঐতিহ্য ধরে রাখতে আলী আমজাদ খাঁন মৌলভীবাজার ও কুলাউড়ায় বিভিন্ন স্কুল-কলেজ এবং সুপেয় পানির জন্য দীঘি খনন করেন।
উল্লেখ্য,
সিলেটের সুপরিচিত রাজপরিবার তরফের অন্যতম শাখা ,সিপাহসালার হযরত সৈয়দ নাসিরউদদিন (রঃ) এর উত্তরসুরী নরপতি সাহেব বাড়ির অন্যতম জমিদার সৈয়দ আমিনউদ্দিন সাহেবের পুত্র ।
সৈয়দ ময়েজ উদ্দিনের বোনের নাম সৈয়দা ফাতেমা বানু , এই সৈয়দা ফাতেমা বানুর বিয়ে হয় পৃথিমপাশা র জমিদার নবাব আলী আমজাদ খানের সাথে ।যিনি ছিলেন নবাব আলী আমজাদ খানের প্রথম পত্নী ।জনশ্রুতি রয়েছে তিনি অত্যান্ত রুপসী ও বিদুষী মহিলা ছিলেন ।
নবী বংশীয় এবং রাজ পরিবারের ঐতিয্য থাকার কারনে পৃথিমপাশার জমিদার নবাব আলী আমজাদ খান নরপতি র পশ্চিম হাবেলীতে এই পরিবারে সম্পর্ক স্হাপনে আগ্রহী হন ।নবাব আলী আমজাদ খান বাংলার শ্রেষ্ট পরাক্রমশালী জমিদার দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন । বৃটিশ শাসনআমলে তার ষ্টেটের ম্যানেজার ছিল একজন বেতনভুক্ত ইংরেজ ।পাহারাদার ছিল নেপালী ,সবসময় বাড়িতে ১০০ টি বন্দুক ছিল এবং বন্দুকধারী বাহিনীরা পাহারায় থাকত ।তিনি যখন নরপতি পশ্চিম হাবেলীতে সুন্দরী কন্যা সৈয়দা ফাতেমা বানুর সাথে বিয়ের প্রস্তাব দেন তখন নরপতির সৈয়দ রা সেই প্রস্তাবে প্রথমে রাজি হন নাই যেহেতু নবাবেরা ছিলেন শিয়া সম্প্রদায় , পরবর্তীতে রাজি হন এবং মহাধুমধামে বিয়ে সম্পন্ন হয় । ঐ বিয়েতে অতিথী হয়ে বরযাত্রীর বহরে ছিলেন বহু ইংরেজ , উপমহাদেশের বিভিন্ন গন্যমান্য পরিবারের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গ এবং ত্রিপুরা রাজ্যের মহারাজা “ রাধা মানিক্য বাহাদুর “।
তখন চল্লিশটি হাতি নিয়ে বিরাট বরযাত্রী নরপতি এসে প্রায় একসপ্তাহ অপেক্ষা করে সৈয়দ সাহেবদের কে রাজি করিয়ে সৈয়দা ফাতেমা বানুকে বিয়ে করে পৃথিম পাশা নিয়ে আসেন ।
আলী আমজাদ খানের পুত্র নবাব আলী হায়দার খান ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও রাজনীতিবিদ ছিলেন। পৃথিমপাশা নবাব পরিবারের আলী সরওয়ার খান আওয়ামী লীগের টিকেট পেয়ে প্রাদেশিক পরিষদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হন ।এই পরিবারের অন্যতম সদস্য ও ভাসানী ন্যাপের অন্যতম সিনিয়র নেতা নবাব আলি সফদর খান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একজন বলিষ্ঠ সংগঠক ও স্থানীয় জনগনের অত্যান্ত আস্থাভাজন ও নির্ভরযোগ্য নেতা ছিলেন ।
তিনি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালন করেন ।তাকে হত্যা করার জন্য পাক বাহিনী বহুবার বিভিন্ন স্হানে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় ।
অন্যায়ের সাথে ‘রাজা পৃথিমপাশা নবাব পরিবারের আলী সরওয়ার খান আওয়ামী লীগের টিকেট পেয়ে প্রাদেশিক পরিষদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হন ।এই পরিবারের অন্যতম সদস্য ও ভাসানী ন্যাপের অন্যতম সিনিয়র নেতা নবাব আলি সফদর খান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একজন বলিষ্ঠ সংগঠক ও স্থানীয় জনগনের অত্যান্ত আস্থাভাজন ও নির্ভরযোগ্য নেতা ছিলেন ।
আবার এই নবাব পরিবারের আর এক উশৃংখল সদস্য নবাব আলী ইয়াত্তর খান পাকিস্তানপন্থী হানাদার বাহিনীর একজন যোগসাজশকারী হিসাবে সর্বত্র গন্য ছিলেন ।
তারই আহব্বানে নবাব বাড়িতে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছিল এবং পাক হানাদারদের দ্বারা বেশ কিছু মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে ।
এমনকি নবাব আলী সফদর খানের বসত বাড়ীতে একজন পাক আর্মি অফিসারের আস্তানা গড়ে উঠেছিল তিনি তখন সপরিবারে ভারতে অবস্তান করছিলেন ,
তার স্ত্রী পুত্রদের ভারতের আগরতলায় আত্বীয়ের বাড়ীতে রেখে তিনি মুক্তিযাদ্ধা শিবিরে সংগঠক হিসাবে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন, তাদের খাবারের ব্যবস্তা করে দিতেন ।
তিনি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালন করেন ।তাকে হত্যা করার জন্য পাক বাহিনী বহুবার বিভিন্ন স্হানে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় ।
অন্যায়ের সাথে ‘রাজা সাহেব’ কখনই আপোষ করেন নাই ।
তিনি সংগ্রাম করেছেন জমিদার পিতার বিরুদ্ধে , অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামী এই জননেতা ১৯৭৪ সালের ১৬ ই জুলাই মৃত্যুবরণ করেন ।
পৃত্থিমপাশা জমিদার পরিবারের পরবর্তী সন্তানগন ও সমাজসেবা ও জনহিতকর কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন ,রাজা সাহেবের ছেলে ‘নবাব আলী আব্বাস খান ‘ বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ এবং তিন বার সংসদ সদস্য ছিলেন , আপামর জনসাধারণের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন । তিনি এই নির্বাচনী এলাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয় ও গ্রহনযোগ্য ব্যক্তিত্ব। ছোট ছেলে ‘নওয়াব আলী নকী খান’ এই ইউনিয়নের দীর্ঘদিন জনপ্রিয় চেয়ারম্যান ছিলেন এবং বর্তমানে বাড়িতেই অবস্তান করছেন ।
সারাদেশের বিভিন্ন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সাথে রয়েছে এই পরিবারের আত্বীয়তা এবং সুসম্পর্ক ।
এই বাড়ির ভেতর সবকিছু পুরানো আমলের কারুকাজ খচিত মনে হলেও সেগুলো পরিষ্কার ঝকঝকেই আছে এখনো। জমিদারদের ব্যবহার করা অনেক জিনিসপত্র রয়েছে এ বাড়িতে। রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য এখানে লোক রয়েছে। নবাব আলী আমজাদ খাঁর উত্তসুরিরাই বর্তমানে দেখাশুনা করেন জমিদার বাড়িটি এবং দেশে বিদেশে প্রচুর বংশধর ও আত্বীয় স্বজনেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্তান করছেন , অগনিত বহু বড় বড় বিখ্যাত ব্যক্তির আগমন ঘটেছে এই বাড়িতে , সেই উছিলায় কুলাউড়াতে , বাংলার ইতিহাসের অগ্নিস্বাক্ষী এই নওয়াব বাড়ির কথা লিখে শেষ করার মত নয়।
বহু ইতিহাস বিদ , গবেষকগন নানা ভাবে , নানা বইতে এই বাড়ি ও এই বাড়ির কৃতিমান দের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছেন , এমন কি গুগুল , উইকিপিডিয়া তে ও ব্যাপক আকারে পৃথিমপাশা নবাব বাড়ির কথা উল্লেখ রয়েছে , বিভিন্ন মাধ্যম থেকে টুকিটাকি তথ্য সংগ্রহ করে এই পর্বটি তৈরী করেছি , উইকিপিডিয়া সহ সকলকে কৃতজ্ঞতাজানিয়ে এই পর্ব শেষ করছি, ছবি সৌজন্যে সৈয়দ মিসবাহউদ্দিন , সিলেট ঃ- । (চলবে)
৭১ এর স্মৃতি - পর্ব- ২৬ ( ঘরগাঁও)
সৈয়দ শাকিল আহাদ
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার বিখ্যাত ‘সংকল্প’ কবিতায় বলেছেন
“ থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে,-
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে।
দেশ হতে দেশ দেশান্তরে
ছুটছে তারা কেমন করে,
কিসের নেশায় কেমন করে মরছে যে বীর লাখে লাখে,
কিসের আশায় করছে তারা বরণ মরণ-যন্ত্রণারে।। “
এই জগত দেখার মানসেই একবার কুলাউড়া থেকে সংগ্রামের সময় আখাউড়া গামী মিস্ ট্রেন এ করে লংলা গিয়ে নেমেছিলাম বড় মামা আমির আলীর সাথে উদ্দেশ্য ছিল পৃথিমপাশা নবাব বাড়ীর রাজা সাহেবের কাছে যাবো , বড় মামা আমাকে সাথে রাখতেন সম্ভাব্য বিপদ আপদে তার নিজের একটু সাহস বাড়ানোর লক্ষে ।
কিন্তু লংলা স্টেশনে নেমে বড় মামা সিদ্ধান্ত পাল্টে আমাকে নিয়ে হাটতে হাটতে পুর্বদিকে প্রথমে মনরাজ ,তারপর সুলতানপুর
এবং তারপরে দৌলতপুর ,আসামপুর ,
রবিরবাজারের পর পৃথিমপাশা নওয়াব বাড়ীর একটু উত্তরপুর্বে ঘরগাও সৈয়দ বাড়িতে সৈয়দ আনোয়ার সাহেবের সাথে দেখা করতে গেলেন ,তিনি বর্তমানে ইহলোক ত্যাগ করেছেন , তার দুই ছেলে সৈয়দ রিপন ও সৈয়দ লিটন এবং দুই মেয়ে লিনা এ সাবিনা বিভিন্ন জায়গায় অবস্তান করছেন ।তিনি বিয়ে করেছিলেন ব্রাম্বনবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর ঊপজেলার নাসিরপুর সৈয়দ বাড়ীর সৈয়দ আবদুল নকীব এর কন্যা সৈয়দা ফরকুন্দা বিবিকে , এই আনোয়ার সাহেব একটু নীচুস্বরে কিন্তু অত্যানত্য দ্রুত কথা বলতেন , বড় মামা ও এখন বেচে নেই তবে সেদিন তার সাথে ছিলাম আমি সেই কথা স্পষ্ট মনে আছে । এই ঘরগাও এর সাথে সম্পর্ক হয় আরো অনেক পরিবারের বিশেষ করে আমানীপুরের শাহ সৈয়দ ইনামুল্লাহ এর নাতি সৈয়দ
আফতাব উদ্দিনের ভাগ্নী সৈয়দা আসিয়া খাতুন ( ডালই বিবিকে) বিয়ে করেন সৈয়দ মহিবুর নুর সাহেব , ডালই বিবি ছিলেন কুলাউড়া উপজেলার কৌলা (বড় বাড়ি) নিবাসী সৈয়দ সদরুল হোসেন ও হামিদুন নেছা চৌধুরীর কন্যা তাঁদের সন্তানগণঃ- ১) সৈয়দ মজিবুর নুর (কয়ছর),
২) সৈয়দ মাহবুবুন নুর (আফছর), ৩) সৈয়দা সামসুন নাহার (মমতা), ৪) সৈয়দা নাজমুন নাহার (মায়া) ও ৫) সৈয়দা জেবুন নাহার (শেফা) ।এছাড়াও সারাদেশের অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সাথে আত্বিয়তা রয়েছে এই বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে যা অনেক বেশী উল্লেখযোগ্য ।
পৃথিম পাশা ইউনিয়নের ছোট্ট একটি গ্রাম ঘরগাও , পৃথিমপাশা নওয়াব বাড়ির সামনে দিয়ে একটু সামনে উত্তর পশ্চিমে এগুলোলেই সেই ঐতিহ্যবাহী গ্রাম , এই গ্রামে একটি সাহেব বাড়ী রয়েছে যার গোড়া পত্তন হয়েছিল সৈয়দ শামসুল হাসানের মাধ্যমে , ইতিহাস ঘেটে জানা যায় বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই এস এম ইলিয়াসকে তিনি তার লেখা “সিপাহসালার সৈয়দ নাসিরুদ্দিন (রঃ) সিলেট ও তরফ বিজয়ী “নামক গ্রন্থে অনেক পরিশ্রম করে অনেক অজানা তথ্য উপস্থাপন করেছেন ।
সৈয়দ শামসুল হাসানের পুর্বপুরুষ ছিলেন সিরাহসালার হযরত সৈয়দ নাসিরুদ্দিন (রঃ) , তিনি হবিগঞ্জের মুরারবন্দের নরপতি উত্তর হাবেলীর বংশধর সেখানকার ঘরগাও থেকে এসে পৃথিমপাশার প্রসিদ্ধ জমিদার নবাব আলী আমজদের পরিবারে বিয়ে করেন এবং জমিদারীর একাংশ পেয়ে এই খানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন ।তার পূর্বপুরুষদের স্থায়ী বাসস্থান ঘরগাও য়ের নাম অনুসারে এই এলাকার নাম রাখেন ঘরগাও ।
এখনও নরপতি মুড়ারবন্দের পাস্বে অবস্থিত ঘরগাঁও এর সেই পুরোনো বাড়িটির নাম পীরের বাড়ী ।বর্তমানে সেই বাড়ীতে তাদের কোন বংশধর নেই , অন্য লোকেরা সেখানে বসবাস করছেন ।কিন্তু পীরের বাড়ী নামটি আজও মুছেনি । এই বাড়ীর সামনেই যুগের শ্রেষ্ট তাপস হযরত সৈয়দ ইলিয়াস কুতুবুল আওলিয়া (রঃ) বসে অজু করতেন সেই পাথর আজও বিদ্যমান ।পৃথিমপাশার পাশ্বে অবস্থিত ঘরগাও সাহেববাড়িও অনেক সুন্দর ।বাড়ির সামনে বিরাট দিঘী , প্রসস্থ মাঠ , মসজিদ বাংলো , ফুলবাগান সবকিছু মিলিয়ে অতি চমৎকার পরিবেশ ইত্যাদি ওয়াকফ স্টেটের অধিনে রয়েছে ।( চলবে) ..ছবি ও আংশিক তথ্য সৌজন্যে সৈয়দ মিসবাহউদ্দিন, সাবেক কাউন্সিলর , উপশহর ,সিলেট ।
৭১ এর স্মৃতি -পর্ব ২০ ( গাজিপুর)
সৈয়দ শাকিল আহাদ
কুলাউড়া শহরের প্রবেশমুখেই উছলাপারায় হাতের ডানদিকে নবীনচন্দ্র হাই স্কুলের ফুটবল খেলার মাঠ এবং বামদিকে খান বাহাদুর মৌলবী আমজদ আলীর বাড়ি , বিশাল এক পুকুর নিয়ে তৈরী সেই বাড়িতেই টুক টুক করে বেড়ে উঠেছি আমি ,সেই পুকুরের পানি আজও স্বচ্ছ টলটলে , ছোটবেলায় এই পুকুরের পানি খেয়ে বড় হয়েছি ,দক্ষিন দিকে পাড়ের মাঝবরাবর গাছগাছালীর মাঝে কয়েকটি মনগাছ বা মাকালফল গাছ ও পেয়ারা গাছ ছিল ,
আজও সেখানে অর্থাৎ সেই পুকুরে মাছেরা , হাসেরা-সাঁতার কাটে ,আজও মনে আছে সেই মধুর স্মৃতি , পাড়ের গাছ গাছালী্র পাতার ভিড়ে চুপটি করে বসে থাকতো মাছরাঙ্গা ,ডানা শুকাতো পানকৌড়ি, ফিঙে দোল খেতো পেয়ারা গাছের মগডালে , দুপুরের রোদ গায়ে মেখে খোলা আকাশে উড়ে বেড়াতো চিল ,পুকুরের জলভরা বুকে সেই চিলের ছায়া ভেসে বেড়াতো আর বিষন্ন কন্ঠের ডাক মধ্যান্হের নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে মনকে উদাস করে তুলতো ,শরৎ এলেই শাপলা ফুটতো,
,জৈষ্ঠ্য মাসে পশ্চিম পাড়ের আম গাছের নিচ থেকে আম কুড়ানোর সুখ আজও উপলব্ধি করি নিরবে নিভৃতে , তার পিছনেই বাড়ীর দেওয়াড়ে বিশাল বড় লাল টুকটুকে কৃষ্নচুড়ার গাছ ও সাথে তেতুল ও খেজুর গাছের অস্তিত্ব কখনই ভোলার মত নয় , আষাঢ়ে টুপটাপ ঝড়ে পড়া বৃষ্টির ফোটাগুলোকে গায়ে মেখে ঐ পুকুরে সাঁতার কেটেছি অনেক - অনেক ,
আহারে সেই বর্ষাকালের কি দারুন উপলব্ধি !!
স্মৃতিচারণমুলক লিখা লিখতে বসে যখন অনেক কিছুই মাথায়। আসে ,তখন বিষয় গুলোকে জরুরী , কম জরুরী , গুরূত্বপূর্ন , কমগুরুত্বপূর্ন মনে করে ঐ বিষয়গুলোর মাঝখান থেকে কোন একটা বিষয় বাছাই করে লিখবো ভেবে বসে আছি , অথচ মন মানছে না , কিন্তু মনকে যতই বুঝাচ্ছি কিছুতেই মানছে না ,
মনকে মানিয়ে নিতে হচ্ছে ,
হটাৎ মনে হলো দ্বিধা দন্দে না থেকে একটু আগ বারিয়ে সামনে এসে কুলাউড়া শহরের দক্ষিন দিকে আগাই ।
মনটা চাইছে রবির বাজারের দিকে যেতে ,তাইতো স্কুল চৌমুহনী পর্যন্ত এসে বামে পুর্বদিকে রেলক্রসিং পাড় হয়ে কলেজ রোড ধরে
গাজিপুরের দিকে ছুটলাম ।
রেললাইনের পুর্বদিকের গ্রামগুলোর মধ্যে ,কয়েকটি গ্রাম ও এলাকার কথা বেশ বেশি মনে হচ্ছে যেমন ঃ-দানাপুর,দতরমুরি,লষ্করপুর ,
ঘাঘটিয়া , কামারকান্দি,জয়চন্ডী,রামপাশা,
দিলদারপুর,দুর্গাপুর,মিঠিপুর,আবুতালিবপুর,বেগবানপুর,গিয়াসনগর,গোপালীছড়া,মেরিনা,মীরশংকর,পাঁচপীর ,রসুলপুর,পোষাইনগর,
হরিহরপুর ,লৈয়ারহাই,গৌরীশংকর,রঙ্গীরকুল,সাদেকপুর,মীরবকসপুর,রাজাপুর,কুটাগাও ,গাজিপুর ইত্যাদি তাদের মধ্যে অন্যতম ।
কুলাউড়ায় পাক বাহিনী এসে বিভিন্ন জায়গায় আস্তানা তৈরী করে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে , তাদের সাথে যুদ্ধ ও হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা , মিত্রবাহিনীর সমন্নয়ে ,তেমনি দু একটি যুদ্ধের বর্ননা না দিলেই নয় ,
আমি যু্দধকালিন ঘটে যাওয়া
ঘটনাসমুহের সরাসরি প্রত্যক্ষদর্শী নই , তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ননায় ও বিভিন্ন মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়ে ছি যেহেতু আমি তখন অনেক ছোট ছিলাম তাই নানাজনে , নানামতে বিভিন্ন প্রকার প্রশ্ন জাগতে পারে ,
প্রশ্ন জায়গাটা খুবই স্বাভাবিক ,তখনকার যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী কয়েকজন প্রত্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিতে ঐ ঘটনা সমুহের যতেষ্ট মিল খুঁজে পেয়ে লিখে যাচ্ছি কিছু স্মৃতি যা অনেক মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও কবি লেখকেরা তাদের লেখনিতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে তুলে এনেছেন ।বিশেষ ভাবে এই অন্চলের মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদ ,মোহাম্মদ ওয়াহিদ মুরাদ তাদের মধ্যে অন্যতম কৃতজ্ঞতা জানাই তাদের প্রচেষটা কে ।
কুলাউড়ার আশে পাশের কিছু যুদ্ধের কথা , কিছু সেনাবাহিনীর কর্মকর্তার কথা বেশকিছু মুক্তিযোদ্ধাদের কথা , কুলাউড়া অন্চলের সাহসী সূর্যসন্তান দের কথা ,বীরাঙ্গনাদের কথা ,অনেক বেশী মনে হচ্ছে যা বহুভাবে বিভিন্ন জনের আলোচনায় এসেছে ,
ঃ-পাকিস্তানি মিলিটারীদের উপর হামলা চালিয়েছিল কুলাউড়ার সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রবেশ করে ভারতে ট্রনিংপ্রাপ্ত বাঙ্গালী বীরযোদ্ধারা ,বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাতের বেলা চলতো ঐ সকল অপারেশন ।যুদ্ধের পরিকল্পনা এ আক্রমনের স্থান ঠিক করে দিতো ৪ নং সেক্টরের কর্মকর্তারা , এই কুলাউড়া তখন ৪ নং সেক্টরের আওতাধীন ছিল ঃ-
বিশিষ্ট গবেষক রফিকুল ইসলামের রচনায় গ্রন্থ “ লক্ষ্য প্রানের বিনিময়ে “র ৩১৯ নং পৃষ্টার বর্ননায় স্পষ্ট জানা যায় ঃ-
৪ নং সেক্টরের সাথে যে সব সেনা কর্মকর্তারা যুক্ত ছিলেন , তারা হলেন ঃ-
১) মেজর জেনারেল সি আর দত্ত
২)কর্নেল আব্দুর রব
৩)লেঃ কর্নেল শরিফুল হক বীর উত্তম ( অব:)
৪) স্কোয়ার্ডন লিডার নুরুল কাদির ( অবঃ)
৫) লেঃ কর্নেল খায়রুল আনাম (অব)
৬)লেঃ কর্নেল এম এ রাশেদ চৌধুরী বীর প্রতিক (অবঃ)
৭) লেঃ কর্নেল সাজ্জাদ আলি
বীর প্রতিক (অবঃ)
৮) লেঃ কর্নেল এস.এ. হেলাল উদ্দিন, পি.এস.সি (অবঃ)
৯)মেজর আব্দুল জলিল (অবঃ)
১০) লেঃ কর্নেল এ. কে.এম. জালালাবাদী
১১) লেঃ কর্নেল নিরন্জন ভট্টাচার্য
১২) মেজর জহিরুল হক ,
বীর প্রতিক (অবঃ)
১৩) মেজর ওয়াকিউজ্জামান ।
১৪) লেঃআতাউর রহমান
১৫) মেজর দোস্ত মোহাম্মদ সিকদার ( অবঃ)
১৬) লেঃ কর্নেল চৌধুরী মোহাম্মদ আলী
১৭) মেজর মুক্তাদির আলী
১৮) লেঃ কর্নেল চন্দ্র কান্ত দাস
১৯) লেঃ কর্নেল জীবন কানাই দাস
যুদ্ধ হয়েছিল , দত্তগ্রামে,জুড়িবাজারে,শরীফপুর ইউনিয়নের চাতলাপুরে,পৃথিমপাশা নবাববাড়ির ডাকঘরে,আলীনগর বিওপিতে ,সাগরনালে, নিশ্চিন্তপুরে ,মুরইছড়াতে,পাবই রেলসেতুতে ,দিলদারপুরে,দিলকুশা চা বাগান এলাকায়,মনু নদীর উপর পল্কী ব্রিজ এলাকায়,ফুলতলা বাজারে,কর্মধা ইউনিয়নের কালাইগীরি ক্যাম্পে ,গাজিপুর চা বাগান সহ উল্লেখ যোগ্য স্থানে ।
বিখ্যাত সেই গাজীপুরের যুদ্ধ ছিল তেমনি একটি স্বরনীয় যুদ্ধ যা
১৯ ৭১ সালের ৪ এবং ৫ ডিসেম্বর
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন পরিচালিত একটি সামরিক অভিযান।
এটি সংঘটিত হয়েছিল কুলাউড়ার কাছে গাজীপুর টি ষ্টেটে।
যেটি পূর্ব পাকিস্তানের সিলেট জেলায় অবস্থিত।
অগ্রসরমান মিত্রবাহিনী মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের উপর আক্রমণ করেছিলো।
কেউ কেউ এই যুদ্ধকে সিলেটের যুদ্ধ নামেও পরিচিতি দিয়েছেন ।
এই যুদ্ধে ১১ জন নিহত হয়েছিল, ৬১ আহত হয়েছিল ।
উল্লেখ্য ২৭ নভেম্বর ১৯৭১ বিকালে ৪/৫ গোরখা রাইফেলস কদমতলার দিকে অগ্রসর হয়।
এটি পূর্ব পাকিস্তানের সিলেট বিভাগের সীমান্তের কাছাকাছি কুলাউড়া -মৌলভীবাজার সেক্টরের উল্টোদিকে অবস্থিত।
এর আগে এই এলাকা দখলের জন্য ছোট ছোট অনেক যুদ্ধ ও আক্রমণ পরিচালিত হয়েছিল। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৮ম মাউন্টেইন ডিভিশনের উল্টোদিকে ছিল ৫৯ তম মাউন্টেইন ব্রিগেড। এই এলাকাটি সীমান্ত পর্যন্ত চা বাগান ঘেরা পাহাড় দিয়ে পরিবেষ্টিত ছিল। আরও পশ্চিমে দৃষ্টিসীমার ভেতরে আরও কিছু ছোট ছোট পাহাড় চমৎকার প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছিলো।
সেই সাথে ভারতীয় সীমান্তে নজরদারীর জন্য জায়গাটি ছিল চমৎকার।
পাহাড়গুলো ছিল কুলাউড়ার ঠিক পূর্বে এবং সিলেটের সমতল অঞ্চল এখান থেকেই শুরু হয়েছিল। কুলাউড়া ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম কেন্দ্র এবং রেলপথে ধর্মনগর – গাজীপুর – মৌলভীবাজার – সিলেটের সাথে সংযুক্ত ছিল।
৫৯তম মাউন্টেইন ব্রিগেডের সাহায্যে ধর্মনগর – গাজীপুর – কুলাউড়া, ধর্মনগর – জুরি সীমান্ত পোস্টগুলোর দখল নেওয়া।
৮১তম মাউন্টেইন ব্রিগেড শমশেরনগর – ফেঞ্চুগঞ্জ – মৌলভীবাজার অঞ্চলের দায়িত্বে থাকবে।
লক্ষ্য ছিল সম্মিলিত সামরিক আক্রমণের মাধ্যমে সিলেট বিভাগের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া।
পাকিস্তানের ১৪ তম ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের ৩১৩ তম ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড মৌলভীবাজারে অবস্থান করছিল। যখন এর ৩য় ব্রিগেড আরও দক্ষিণে ভৈরব বাজার এবং আশুগঞ্জ অঞ্চলের দায়িত্বে ছিল, এর ২০২ তম ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড সিলেটে চলে গিয়েছিল।
২২ বেলুচ রেজিমেন্ট সাগরনাল, গাজীপুর, কুলাউড়া এবং জুরি এলাকা অতিরিক্ত মিলিটারি ইউনিট এবং EPCAF এর সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করছিল।
এই ব্যাটালিয়ানের একটি ইউনিট ধর্মনগর – জুরি অঞ্চল এবং কয়েকটি সীমান্ত পোষ্টে নিযুক্ত ছিল।
প্রতি সীমান্ত পোষ্টে এক প্লাটুনের বেশি সৈন্য,
সাগরনালে EPCAF,
গাজীপুরে এক ইউনিট, কুলাউড়ায় ব্যাটালিয়ান হেডকোয়ার্টার এবং অবশিষ্ট সৈন্য মৌলভীবাজারে অবস্থান করছিল।
কিন্তু ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের কাছে যে সেই সময় অতিরিক্ত পরিদর্শনমূলক ব্যবস্থা এবং আত্মরক্ষার জন্য প্রচুর পরিমাণ গোলাবারুদ ছিল সেটা কারো জানা ছিল না।
ভারতীয় ৫৯ মাউন্টেইন ব্রিগেড প্রাথমিক ভাবে ৪/৫ গোর্খা রাইফেলসের যা সীমান্ত বাহিনী নামে অভিহিত তাদের সাহায্যে সাগরনাল সীমান্তের আউটপোস্ট দখল করে নেয়ার পরিকল্পনা করে। ৯ম রক্ষীবাহিনী জুড়ি এবং
৬ষ্ঠ রাজপুত বাহিনী গাজীপুর দখল করে কুলাউড়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।
যুদ্ধ চলার কারণে ৪/৫ গোর্খা রাইফেলস বা সীমান্ত বাহিনী
৬ষ্ঠ রাজপুত বাহিনীর প্রয়োজনে নিয়োজিত ছিল।
কুলাউড়া সুরক্ষিত হওয়ার পর এই দুই বাহিনীর একত্রে কাজ করার পরিকল্পনা করে ।
গাজীপুরের ধর্মতলা – কদমতল – সাগরনাল – গাজীপুর – কুলাউড়া রোডের অনেকটা অংশ গাজীপুর চা বাগানের ম্যানেজারের বাংলো এবং দক্ষিণপূর্ব দিকের উঁচু এলাকা দিয়ে গিয়েছিল।
চা গাছের সারি এই এলাকায় গোলকধাঁধা সৃষ্টি করেছিলো এবং এর গলিগুলো স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে বেষ্টিত ছিল।
এর উত্তরের উঁচু জমি ছিল নজরদারির জন্য চমৎকার স্থান। এখানকার ব্যাঙ্কারগুলো কলা গাছ দিয়ে আচ্ছাদিত ছিল যা
“কেলা-কা-বাগিচা “ নামে সকলের কাছে পরিচিত ছিল। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর রাত ৯ টার দিকে ৬ষ্ঠ রাজপুত বাহিনী গাজীপুর আক্রমণ করে এবং শক্ত প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।
ভোরের কিছুক্ষন আগে এটি স্পষ্ট হয় যে আক্রমণটি ব্যর্থ হয়েছে এবং সাহায্য চেয়ে পাঠানোর মত সময় নেই।
এই অবস্থায় ৪/৫ গোর্খা রাইফেলসকে বা সীমান্ত বাহিনী কে ১৯৭১ সালের ৪/৫ ডিসেম্বর পরবর্তী রাতে গাজীপুর দখল অভিযানের ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল।
তারা ৪ ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে। আগের রাতের আক্রমণের সম্মুখীন হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী যে কোন দিক থেকে যে কোন রকম আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
তাদের সাহায্যের জন্য কামান প্রস্তুত ছিল। পাকিস্তানের চমৎকার সংগঠিত ২২ বেলুচ কোম্পানি গাজীপুরের কেলা-কা-বাগিচায়, স্কাউটদের সাথে, ম্যানেজারের বাংলোতে, এমএমজির কারখানায় এবং কোম্পানির সদর দফতরে এক প্লাটুন করে নিয়োজিত ছিল এবং সাথে অন্যান্য পরিদর্শনমূলক এবং সাহায্যকারী যন্ত্রপাতি ছিল। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নির্মাণাধীন এলাকা কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছিল এবং তাদের সুসজ্জিত ব্যাঙ্কার প্রস্তুত ছিল।
গোর্খা রাইফেলস বা সীমান্ত বাহিনী পর্যায়ক্রমিক ভাবে ডেল্টা কোম্পানির সাহায্যে “কেলা-কা-বাগিচা,”
আলফা কোম্পানির সাহায্যে ম্যানেজারের বাংলো,
ব্রাভো এবং চার্লি কোম্পানির সাহায্যে কারখানা অঞ্চল দখলের পরিকল্পনা করে ।
সিও টু ,শ্যাম কেলকারকে
বি এবং সি কোম্পানি পরিচালিত কারখানা আক্রমণের প্রধান কমান্ডার করা হয়েছিল।
লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ায় নেতৃত্ব দিয়েছিল ডেল্টা কোম্পানি। রাত ৮ টা ৩০ মিনিটের দিকে সামনের সৈন্যরা “কেলা-কা-বাগিচার” উত্তরের উঁচু জায়গায় পৌঁছায় এবং পাকিস্তানি বাহিনী কামান, এমএমজি এবং এলএমজি দিয়ে আক্রমণ করে। প্রায় ৮.৪৫ নাগাদ কোম্পানি আক্রমণ শুরু করে। একদম শেষ মুহূর্তে পাকিস্তানিরা আক্রমণে সুবিধা করতে পারে এবং তারা হিংস্র হয়ে ওঠে। সম্মুখ যুদ্ধে অনেকেই আহত হয়।
পরবর্তী লক্ষ্য ম্যানেজারের বাংলোর চারপাশে ব্যাঙ্কার থাকার কারণে এটি রীতিমত একটি দুর্গ হয়ে উঠে। চা গাছের সারির ফাঁক থেকে এবং কেলা-কা-বাগিচার সামনে থেকে আক্রমণ পরিচালিত হতে থাকে। রেডিও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে আলফা কোম্পানির কোন খবর পাওয়া যাচ্ছিল না ফলে ব্রাভো কোম্পানির উপর ম্যানেজারের বাংলো দখলের দায়িত্ব পরে। আলফা কোম্পানি জানত না যে পরিকল্পনা পরিবর্তন করে ব্রাভো কম্পানিকে তাদের কাজটি দেওয়া হয়েছে।
ব্রাভো কোম্পানি যখন “কেলা-কা-বাগিচার” পাশ থেকে আক্রমণ করছিল তখন সৌভাগ্যবশত আলফা কোম্পানি একটি সঙ্কীর্ণ বাঁকের আড়ালে ছিল। ম্যানেজারের বাংলো দখলের সময় ব্রাভো কোম্পানির কমান্ডার সহ অনেকেই হতাহত হয়েছিল। অন্যদিকেও তখন সিও টু ,
মেজর শ্যাম কেলকার এর মৃত্যুতে নীরবতা বিরাজ করছিল। আক্রমণের নেতৃত্ব দেওয়ার সময় সিও টু -মেজর শ্যাম কেলকার গুলিবিদ্ধ হন এবং ঘটনাস্থলেই মারা যান।
চা কারখানার শেষ এবং ফলাফল নির্ধারণকারী আক্রমণটি কমান্ডিং অফিসারের মৃত ব্রিগেডিয়ার এ বি হরলিকার, এমভিসি বক্তব্যে থেকে অনেক অজানা তথ্য উঠে এসেছে ।
গাজিপুর বাগানে বেশ কয়েক বার গিয়েছি তাও স্বাধীনতার অনেক পরে হাবীব মামার বাংলোতে,তিনিও ৭১ এর অনেক পরে ঐ বাগানের ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন ।তিনি হবিগঞ্জের সুরাবই সৈয়দ বাড়ির সন্তান ,হযরত সৈয়দ নাসিরুদ্দিন (রঃ)সিপাহসালার এর বংশধর এস এম হাবিব , কেউ কেউ তাকে হাসিব সাহেব বলে ডাকতো ,খুউব সুন্দর ব্যাডমিন্টন খেলতেন ৭০ এর দশকের শেষের দিকে কুলাউড়া থানার সামনে হাবিব মামার বেডমিন্টন খেলা দেখার জন্য থানার সামনে রাস্তার পাশে অপেক্ষা করতাম , তার মেয়ে শাম্মী ও বেডমিন্টন খেলতো ,শাম্মী এবং ডাঃ আজহারুন্নেছা খালার মেয়ে ডলি দের একটি জুটি ছিল এরাও অত্যান্ত সাহসীকতার সাথে ডাকবাংলোর সামনে কোর্টেকাটা মাঠে বড়দের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলতে দেখেছি ,
যাই হোক বলছিলাম হাবিব মামার কথা ,বড় মামা আমীর আলীর সাথে , কৌলার জুবেদ মামার সাথে সহ কুলাউড়ার অধিকাংশ সম্ভ্রান্ত পরিবার ও লোকদের সাথে ছিল তার যোগাযোগ ও উঠা বসা ,সেই সুবাদে যে কয়বার তার বাংলোতে বেড়াতে গিয়েছি তিনি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতেন তার বাংলোর আশে পাশে কোথায় কিভাবে যুদ্ধ হয়েছে ,
এই গাজীপুরের যুদ্ধের সময়ের একজনের কথা না বললেই নয় , তিনি হচ্ছেন মুক্তি যোদ্ধা “ বীর প্রতিক আব্দুল জব্বার “
যার বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইল থানায় ।
বীর প্রতিক আবদুল জব্বারের জন্ম ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার কপালহর গ্রামে। তার বাবার নাম ইসহাক আলী এবং মায়ের নাম সৈয়দজান বেওয়া। তার স্ত্রীর নাম আয়েশা বেগম। তাদের তিন মেয়ে, চার ছেলে।
বীর প্রতিক আবদুল জব্বার চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন দিনাজপুর ইপিআর সেক্টরের অধীনে। তখন তার পদবি ছিল নায়েব সুবেদার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে ভারতে যান। সেখানে তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি বৃহত্তর সিলেট জেলায় যুদ্ধ করেন।(চলবে)
সম্পাদক: ময়নুল হক পবন, প্রকাশক: রিয়াজুল হক রেজা, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : মোহাম্মদ জয়নুল হক.
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়,কামাল প্লাজা (১ম তলা), কুলাউড়া, মৌলভীবাজার,ফোন: ০১৭১১-৯৮৩২৬৯
ঠিকানা: 𝐃𝐮𝐛𝐚𝐢 𝐈𝐧𝐯𝐞𝐬𝐭𝐦𝐞𝐧𝐭 𝐩𝐚𝐫𝐤 𝐃𝐈𝐏, 𝐀𝐥 𝐁𝐚𝐲𝐚𝐧 𝐁𝐮𝐢𝐥𝐝𝐢𝐧𝐠 𝟐𝟎𝟏𝟏, 𝐏.𝐎 𝟏𝟎𝟎𝟏𝟐𝟏- 𝐃𝐮𝐛𝐚𝐢. সংবাদ, ছবি ও বিজ্ঞাপন পাঠানোর ঠিকানা: Email: kulauradorpon@gmail.com ওয়েবসাইট: www.kulaurardarpan.com,
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত