রেলওয়ে উনিশ শতকে প্রবর্তিত হয়ে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী বিপ্লবের সূচনা করে। জর্জ স্টিফেনসনের প্রচেষ্টায় ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বের প্রথম রেলওয়ে চালু হয় ইংল্যান্ডের স্টকটন থেকে ২৬ কিমি দূরের ডার্লিংটন পর্যন্ত। এরপর ১৮৩৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে, ১৮৩৫ সালে জার্মানিতে, ১৮৩৯ সালে ইতালিতে, ১৮৪৪ সালে ফ্রান্সে, ১৮৪৮ সালে স্পেনে ও ১৮৫৬ সালে সুইডেনে রেলওয়ে চালু হয়।
ব্রিটিশ শাসনাধীন বাংলাও রেলওয়ের এই বিপ্লব থেকে পিছিয়ে ছিল না। রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও কৌশলগত প্রয়োজনে ব্রিটিশ সরকার উপনিবেশিক বাংলায় রেল স্থাপনের পরিকল্পনা করে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে।
প্রত্যাশা রইল প্রত্যাশাতেই
সিলেট রেল সেকশন প্রবর্তিত হয় ১৯৫৪ সালে। অর্ধশতাব্দী পার হলেও এই সেকশনে আধুনিকতার কোনো ছোঁয়া লাগেনি। বহুবার প্রতিশ্রুতি এসেছে—দেশের অন্যান্য রেলপথের মতো এই পথেও উন্নয়ন হবে, কিন্তু প্রতিবারই প্রতিশ্রুতি ভাঁওতায় পরিণত হয়েছে।
বর্তমানে এই রেলপথটি ভয়ংকর অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটে—উনিশ থেকে কুড়ি ট্রেন চললেই লাইনচ্যুতি ঘটে। সিলেট রেলপথ এখন আতঙ্কের আরেক নাম। সিলেটবাসী ও রেল সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলছেন—দেশজুড়ে উন্নয়নের জোয়ারের মধ্যে এ সেকশনই বা বঞ্চিত কেন?
প্রতিশ্রুতির ইতিহাস ও ব্যর্থতা
রেলওয়ের পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে বেশ কয়েকজন রেলপথমন্ত্রী ছিলেন, যারা নিজ নিজ অঞ্চলে একের পর এক নতুন রেলপথ ও ট্রেন উদ্বোধন করেছেন। কিন্তু সিলেট রেলপথ রয়ে গেছে উপেক্ষিত।
সুনামগঞ্জের কৃতী সন্তান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ২০১১ সালের ২৮ নভেম্বর রেলপথমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। মাত্র চার মাসের মাথায় পদত্যাগ করেন তিনি। তবে তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০১২ সালের ১৫ মে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের উদ্বোধন করেন ঢাকা–সিলেটগামী কালনী এক্সপ্রেস। কিন্তু আজ সেটিই ওই পথের সবচেয়ে জরাজীর্ণ ট্রেন। পুরোনো কোচে চলছে ট্রেনটি, যখন দেশের অন্যান্য রুটে অর্ধশতাধিক আধুনিক কোচের নতুন ট্রেন ছুটছে।
জরাজীর্ণ রেলপথ ও ডেড স্টপ
রেলওয়ে প্রকৌশল-অপারেশন ও পরিবহণ দপ্তরের তথ্যমতে, সিলেট–আখাউড়া রেলপথের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮০ কিলোমিটার। এর অধিকাংশ রেলব্রিজ মেয়াদোত্তীর্ণ—রেলের ভাষায় যেগুলোকে বলে ‘ডেড স্টপ’। অর্থাৎ, সেখানে সব ট্রেন বাধ্যতামূলকভাবে থামতে হয়।
পুরো রেলপথের প্রায় ৯০ শতাংশই ত্রুটিপূর্ণ। হিসাব বলছে—এ রুটেই দেশের সবচেয়ে বেশি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। বহুবার ব্রিজ ভেঙে কোচ খাদে পড়েছে। লেভেলক্রসিংয়ের ৮৮ শতাংশই অবৈধ। এর ফলে প্রায়ই ঘটে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা।
২০১৮ সালের ব্যর্থ প্রকল্প
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সিলেট–আখাউড়া রেলপথে উন্নয়নের সর্বশেষ বড় প্রতিশ্রুতি আসে ২০১৮ সালে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যমান মিটারগেজ লাইনের উপর ডুয়েলগেজ লাইন স্থাপনের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়—ব্যয় ধরা হয় প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা।
তবে প্রকল্পে চীনা অর্থায়ন, উচ্চ সুদের হার এবং সরাসরি ক্রয়পদ্ধতি (DPM) নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। প্রস্তাবিত ব্যয় অনুযায়ী প্রতি কিলোমিটারে ৫৮ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়, যেখানে একই সময়ে ঢাকা–নারায়ণগঞ্জ লাইনে খরচ ছিল মাত্র ৯ কোটি টাকা—অর্থাৎ সাড়ে ছয় গুণ বেশি।
অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে ২০২০ সালে প্রকল্পটি বাতিল করা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ব্যয় কমানোর নির্দেশনা দিলেও, চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়। ফলে সিলেটবাসীর আশা আবারও ভেঙে যায়।
নতুন স্বপ্নও থেমে আছে
২০২১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রেলওয়ে মহাপরিচালক ডিএন মজুমদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিশেষ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়—আখাউড়া–সিলেট রেলপথে নতুন ব্রডগেজ ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণের জন্য নকশা ও সমীক্ষা প্রণয়ন করা হবে।
কিন্তু নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ে কর্মকর্তাদের মতে, ২০২১ সালের পর থেকে সমীক্ষা বা নকশা—কোনো কাজই শুরু হয়নি। অথচ দেশের অন্যান্য রেল প্রকল্প একের পর এক বাস্তবায়িত হচ্ছে।
অখণ্ড বাংলার রেলওয়ের ইতিহাস
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতায় উপনিবেশিক বাংলায় রেলওয়ে স্থাপনের পরিকল্পনা শুরু হয়। এর মূল লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক, কৌশলগত ও বাণিজ্যিক সুবিধা অর্জন।
১৮৫৪ সালে হাওড়া–হুগলি পর্যন্ত ৩৮ কিমি রেললাইন চালুর মাধ্যমে বাংলার প্রথম রেলযাত্রা শুরু হয়। এরপর ১৮৬২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কলকাতা থেকে রাণাঘাট পর্যন্ত রেলপথ উদ্বোধন করে।
১৫ নভেম্বর ১৮৬২ সালে দর্শনা–জগতী পর্যন্ত ৫৩ কিমি ব্রডগেজ লাইন চালু হয়—এটাই ছিল বর্তমান বাংলাদেশের প্রথম রেললাইন।
১৮৭১ সালে কুষ্টিয়া–গোয়ালন্দ রেললাইন চালুর মাধ্যমে নদীপথ ও রেলপথের মিলন ঘটে।
১৮৮৫ সালে ঢাকা–ময়মনসিংহ–নারায়ণগঞ্জ রেললাইন নির্মাণের মাধ্যমে পাট বাণিজ্যে গতি আসে।
১৯১৫ সালে পদ্মার উপর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণ হয়—এটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম বৃহৎ রেলসেতু।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ববাংলা উত্তরাধিকারসূত্রে ২,৬০৬ কিমি রেললাইন পায়, যার নতুন নাম হয় ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে।
১৯৫৪ সালে সিলেট–ছাতক রেললাইন চালু হয় পাথর পরিবহনের উদ্দেশ্যে, যা আজও কার্যকরভাবে চলছে।
লাতুর ট্রেন: আসাম–বঙ্গের শেষ রেলস্মৃতি
বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে লাতুর ট্রেন। এটি শুধু একটি পরিবহনব্যবস্থা ছিল না—বরং একসময় ছিল সীমান্তবর্তী মানুষের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ঐতিহাসিক সূচনা:
১৮৯১ থেকে ১৯০৩ সালের মধ্যে আসাম–বেঙ্গল রেলওয়ে নির্মাণ করে বিস্তৃত রেলপথ, যা ভারতের করিমগঞ্জ, সিলেট ও চট্টগ্রামকে যুক্ত করে। করিমগঞ্জ থেকে চা ও গমসহ বিভিন্ন পণ্য এই পথে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাত।
চা শিল্প ও বাণিজ্যের চালিকাশক্তি:
চা শিল্পের বিকাশে লাতুর রুটের অবদান ছিল অনন্য। তিনসুকিয়া, কুলাউড়া, মৌলভীবাজার ও শ্রীমঙ্গলের চা সহজে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছত, যা আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির জন্য অপরিহার্য ছিল।
এই রেলপথ শুধু বাণিজ্যের মাধ্যমই নয়, আসাম ও সিলেট অঞ্চলের মানুষকে যুক্ত করেছিল সংস্কৃতি ও ইতিহাসের অদৃশ্য সেতুতে। আজ লাতুর ট্রেন ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে, কিন্তু তার স্মৃতি এখনও জীবন্ত।
উপসংহার
অর্ধশতক পরেও সিলেট রেলপথে উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া নেই। দুর্ঘটনা, অবৈধ ক্রসিং, ভাঙা ব্রিজ—সব মিলিয়ে রেলপথটি এখন জীবনহানির ঝুঁকিপূর্ণ পথে পরিণত হয়েছে।
প্রতিশ্রুতি এসেছে বারবার, বাস্তবায়ন হয়নি একবারও। অন্য অঞ্চলে যেখানে আধুনিক কোচ ও ডাবল লাইন বাস্তবতা, সেখানে সিলেটের মানুষ এখনও অপেক্ষায়—একটি নিরাপদ, আধুনিক রেলপথের আশায়। কুলাউড়ার দর্পণ রির্পোট।।
সম্পাদক: ময়নুল হক পবন, প্রকাশক: রিয়াজুল হক রেজা, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : মোহাম্মদ জয়নুল হক.
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়,কামাল প্লাজা (১ম তলা), কুলাউড়া, মৌলভীবাজার,ফোন: ০১৭১১-৯৮৩২৬৯
ঠিকানা: 𝐃𝐮𝐛𝐚𝐢 𝐈𝐧𝐯𝐞𝐬𝐭𝐦𝐞𝐧𝐭 𝐩𝐚𝐫𝐤 𝐃𝐈𝐏, 𝐀𝐥 𝐁𝐚𝐲𝐚𝐧 𝐁𝐮𝐢𝐥𝐝𝐢𝐧𝐠 𝟐𝟎𝟏𝟏, 𝐏.𝐎 𝟏𝟎𝟎𝟏𝟐𝟏- 𝐃𝐮𝐛𝐚𝐢. সংবাদ, ছবি ও বিজ্ঞাপন পাঠানোর ঠিকানা: Email: kulauradorpon@gmail.com ওয়েবসাইট: www.kulaurardarpan.com,
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত