
ষ্টাফ রিপোর্টার।। বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে লাতুর ট্রেন। একসময় সীমান্তবর্তী এ রুট শুধু পরিবহন ব্যবস্থার অংশ ছিল না, বরং অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও মানুষের সামাজিক জীবনের এক অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিল।
ঐতিহাসিক সূচনা
১৮৯১ থেকে ১৯০৩ সালের মধ্যে আসাম–বেঙ্গল রেলওয়ে নির্মাণ করে বিস্তৃত রেলপথ, যা ভারতের করিমগঞ্জের সঙ্গে সিলেট ও চট্টগ্রাম বন্দরকে যুক্ত করে। করিমগঞ্জ—পূর্ব ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রেল জংশন—থেকে চা, গমসহ নানান পণ্য এ পথ ধরে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাত। আসাম ও পূর্ববঙ্গের চা বাগান মালিকদের চাহিদা মেটাতে এই রুট ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চা শিল্প ও বাণিজ্যের চালিকাশক্তি
চা শিল্পের বিকাশে লাতুর রুটের অবদান ছিল অনন্য। এই লাইনের মাধ্যমে তিনসুকিয়া থেকে চা সহজে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছত, যা আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির জন্য অপরিহার্য ছিল। ১৯১৫ সালে কুলাউড়া–সিলেট রেললাইন চালু হলে সিলেট থেকে সরাসরি চট্টগ্রাম রেল যোগাযোগের সুযোগ তৈরি হয়।
ঢাকা–চট্টগ্রাম সংযোগের পথ
১৯৩৭ সালে ভৈরব ব্রিজ নির্মাণের ফলে ঢাকা–চট্টগ্রাম সরাসরি রেল যোগাযোগ চালু হয়। একই নেটওয়ার্কে লাতুর রুট আসাম–বঙ্গের মধ্যে শেষ রেল যোগাযোগের সূত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সাত স্টেশনের গল্প
লাতুর রুটে মোট সাতটি স্টেশন ছিল—কুলাউড়া, জুড়ী, দক্ষিণভাগ, কাঁঠালতলি, বড়লেখা, মুড়াউল এবং শাহবাজপুর (লাতু)। এর মধ্যে বড়লেখা স্টেশন ছিল সবচেয়ে বড়। এটি শুধু পরিবহন কেন্দ্র নয়, বরং স্থানীয় অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র ছিল। স্টেশনকে ঘিরে গড়ে ওঠে বৃহৎ বাজার, যা একসময় পুরো অঞ্চলের ব্যবসা–বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
মানুষের নির্ভরতার প্রতীক
সরাসরি রেল যোগাযোগের আগে যাত্রীরা চাঁদপুর থেকে সুরমা মেইল ট্রেনে এসে কুশিয়ারার নদীর তীরে নেমে নৌকা বা লঞ্চে সিলেট যেতেন। তাই বড়লেখা, বিয়ানীবাজার, কুলাউড়া ও পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের জন্য লাতুর ট্রেন ছিল সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য যোগাযোগ মাধ্যম।
শেষ যাত্রা ও হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য
যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও ব্যবহার কমে আসায় ২০০২ সালে ধীরে ধীরে লাতুর রেললাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে আসাম–বঙ্গের ঐতিহাসিক সংযোগের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের অবসান ঘটে। তবে এই রুট এখনও মানুষের স্মৃতিতে জীবন্ত—একটি সময়ের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির প্রতীক হিসেবে।
ঐতিহ্যের মূল্যায়ন
বর্তমানে লাতুর ট্রেন নেই, কিন্তু এর ইতিহাস আজও গবেষক, স্থানীয় মানুষ ও ইতিহাসপ্রেমীদের আলোচনায় স্থান পায়। সীমান্তবর্তী মানুষের সম্পর্ক, বাণিজ্যের বিস্তার এবং রেলের ঐতিহ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এটি এক অমূল্য অধ্যায় হয়ে রয়েছে।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।