 
							
							 
                    
৭১ এর স্মৃতিতে কুলাউড়া
“শিশির হোমিও হল “
সৈয়দ শাকিল আহাদ
বর্তমান কুলাউড়া শহর ৭ং ইউনিয়ন ভুক্ত , যা তেরটি ইউনিয়নের একটি জনবহুল উন্নত এলাকা এবং পৌরসভার অন্তর্গত । যে যায়গায় পৌরসভার অফিস নির্মিত হয়েছে একসময় সেটা ছিল সি এন্ড,বি এর অফিস সংল্প্ন খাই বা খাল এককথায় কচুরীপানা সম্বলিত ডোবা । পররর্তীতে এখানে মাটি ভরাট করে পৌরসভা স্থাপিত হয়েছে পরিধি বেড়েছে , আধুনিকতার ছোয়ায় ও নতুন প্রজন্মের পরশে যতেষ্ট নান্দনিক রুপে সজ্জিত হয়েছে এই কুলাউড়া ।
এই পৌরসভা অফিসের বিপরিতে প্রধান রাস্তার পস্চিমে একটু আগেই ছিল ডা: শিশির কুমার চৌধুরীর “ শিশির হোমিও হল ।
স্বাধীনতা পূর্বে এবং স্বাধীনতার পরবর্তীতে ডাঃ শিশির বাবুকে চিনতো না এমন লোকের সংখ্যা খুউবই কমছিল কুলাউড়াতে , চারিদিকেই তার নাম ডাক ছিল ইর্যনীয় ।
কুলাউড়া জুড়ি রোডে রাস্তা থেকে একটু দুরত্বে লম্বা চৌচালা টিনের ঘরের সামনে বারান্দা ওয়ালা এবং বারান্দা র দুইপাশে দুইটি হাতলওয়ালা বেন্চি ছিল , ছিল লম্বা সাইনবোর্ড । শিশির বাবুর নাম ডাক ছিল দেশে বিদেশে প্রচুর । তার দেওয়া ঔষধ ডাক বা ভি পি পি যোগে কোলকাতা ,লন্ডন, আমেরিকাতে পর্যন্ত যেতো , তিনি খুউব নম্র ভাষায় কথা বলতেন , হাতের নারী ধরেই রোগীর কাছে রোগের বর্ননা দিয়ে সবকিছু বলে দিতে পারতেন , এবং সেই মোতাবেক ঔষধ দিতেন । ডাঃ শিশির কুমার চৌধুরীর কথা এখন অনেকের কাছেই অজানা , তবে চিকিৎসা সেবায় তার অবদান কুলাউড়া বাসীর কাছে অবিস্মরণীয় । ডাঃ বাবুর টিনের ঘরের পিছনেই ছিল তার বাসা , বেশ সুন্দর বাসার বা সেই বাড়িতে ডোকার সৌভাগ্য হয়েছে আমার অনেক বার , নানুর
সাথেই রিকশাযোগে উনার চেম্বারে যখন যেতাম , নানু তখন বাইরের লোকের সামনে রোগের বর্ননা দিতেন না , শিশির বাবুর ইচ্ছায় ই ভিতরে চলে যেতেন । আর পিসিমার আন্তরিকতা তো বলে শেষ করার মত নয় ।তিনি টেবিলে বসিয়ে ভাত না খাইয়ে ছাড়তেন না , অনেক প্রকার খাবার থাকতো আর মোয়া , নারকেলী ও গুড়ের মিষ্টি তো ছিলই , ছোট ছোট কলা ও থাকতো , উনাদের বাড়ীর ভিতর একটি টিউব ওয়েল ছিল , একটু চাপ দিতেই অনেক স্বচছ্ ও শীতল পানি বেড়িয়ে আসতো , সেই পানি পান করে সকলেই তৃপ্ত হতেন । বাড়ির ভিতরে একটি ছোট পুকুর ও ছিল , পুকুরে তেলাপিয়া মাছ কিলবিল করতো ,পুকুরের চারপাশে জবাফুলের গাছ ছিল , ছিল চিকন চিকন পাতাবাহার ও একটি সাদা গোলাপ ফুলের গাছ ।
ডাঃ শিশির বাবুর বড় ছেলে মহিন্দ্র বাবু বা মনু বাবু ১৯৭১ সালে যুদ্ধচলাকালীন সময়ে ভারতীয় শরনার্থী শিবিরে চিকিৎসা সেবা দান রত অবস্তায় লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান । উল্লেখ্য যুদ্ধ শুরু হবার অল্প কিছুদিন আগেই তার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল তিনি মনু বাবু ১৯৭১ সালে মারা যাবার পর তার সুন্দরী বিধবা পত্নী ডাঃ শিশির বাবুর সাথেই থেকে শশুর সেবা করেই জীবন কাটিয়েছেন । ডাঃ শিশির কুমার চৌধুরী শেষ বয়সে চোখে কম দেখতেন কিন্তু রোগীর হাত ধরেই রোগ নির্নয় করে ঔষধ দিতে পারতেন । তার ছোট ছেলে দেশেই ছিলেন এবং পরবর্তীতে বেচে আছেন কিনা তা আমার জানা নাই ।
ডাঃ শিশির কুমার চৌধুরী ও তার পরিবারের প্রয়াত সদস্যদের বিদেহী আত্বার শান্তি কামনা করছি ।
কৃতজ্ঞতায় ঃ এই প্রতিবেদন তৈরীতে তথ্য যাচাই , সহযোগীতা ও লেখালেখীতে উৎসাহ দানের জন্য বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই “ আলেয়া চৌধুরীকে “ যিনি একসময় কুলাউড়াতে ছিলেন এবং বর্তমানে ব্রাম্বনবাড়ীয়াতে অবস্তান করছেন ।
৭১ এর স্মৃতি -পর্ব ২৫ ( পাল্লাকান্দি)
সৈয়দ শাকিল আহাদ
লংলার আশপাশের আরো কয়েকটি প্রসিদ্ধ ও উল্লেখযোগ্য ইতিহাস ও ঐতিয্যে সম্বৃদ্ধ আত্বীয় বাড়িতে গিয়েছিলাম মনে আছে ।
বিশেষ করে পাল্লাকান্দির কথা । পাল্লাকান্দি সাহেব বাড়ি কুলাউড়ার পরেই লংলা স্টেশন থেকে দক্ষিন পশ্চিম দিকে অবস্থিত, নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পরিবেষ্টিত সবুজের পাহাড়ে ঘেরা টিলাগাঁও ইউনিয়নের অনেক গুলো গ্রামের একটি গ্রামই হ্চছে এই পাল্লাকান্দি ।ঐ গ্রামেই রয়েছে একটি ইমাম বাড়ী , একট্ মসজিদ , পুকুর সহ বিরাট সাহেব বাড়ী,
যে বাড়িতেই সংগ্রামের সময় একবার যাবার সুযোগ হয়েছিল যা অত্যান্ত সুন্দর ফুলবাগান , ফলের গাছে সাজানো ছবির মত ছিল সেই সুবিশাল বাগান সম্বৃদ্ধ সাহেব বাড়ীটি , ঐ
“পাল্লাকান্দি “
বাড়ীর কেউ হয়তো সেই ছোট্ট শিশুটিকে মনে রাখেনি কিন্ত আমার স্মৃতিতে যতটুকু দেখেছি তাতেই ঐ বাড়ি আজও উজ্জল হয়ে আছে বলেই ঐ বাড়ির , ঐ বংশের কিছু কথা লিখতে পারলে নিজেকে গৌরবাননিত মনে করবো , তাই লিখছি ,কোন সম্পর্কে কিভাবে গিয়েছিলাম তা এতটা মনে করতে পারছি না তবে কানিহাটি , আমানীপুর এর পরই , পাল্লাকান্দি তে যাই ,তা ছাড়া একটা বিশেষ কথা মনে আছে উনাদের চা বাগান ছিল এবং কেউ গেলে অতিথীকে ফেরার সময় সম্মান সুচক উপহার হিসাবে সুন্দর করে গোলআকারে পত্রিকায় মোড়ানো প্যাকেটে চা পাতা দিতেন উপহার দিতেন ঐ চায়ের গন্ধ ও স্বাদ ছিল ভিন্নতর যা বাজারের চা য়ের সাথে কখনই মিলতো না ।পরবর্তীতে আমার বংশের অনেক মুরব্বীদের সাথে আলোচনা কালে জেনেছি তাদের ঐতিয্যের বর্ননা ।
১৯৭১ সালের শেষের দিকে পাল্লাকান্দি বাড়ীতে বইছিল থমথমে নিরবতা এই বাড়ীর জমিদার সৈয়দ আলী আকতার এর দ্বিতীয় কন্যা সৈয়দা সাকিনা আক্তারের স্বামী হবিগঞ্জের আউশপাড়ার পুরুষ সৈয়দ সিরাজুল আব্দালকে পাকিস্তানী রা বাড়ী ঘেরাও করে অন্দরমহলের সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে বলে সৈয়দ সিরাজুল আব্দাল কে দিতে , অন্যথায় সবাইকে গুলি করে মারবে , সকলের কথা চিন্তা করে তিনি বেরিয়ে আসেন এবং পাকিস্তানীরা তাকে ধরে নিয়ে হত্যা করে ,তার লাশ পাওয়া যায়নি ।তিনি এর আগেও একবার সিলেটে পাকিস্তানীদের হাতে গ্রেফতার হন এবং সৌভাগ্যক্রমে বেচে যান ।তিনি ছিলেন প্রথমে লাক্কাতুরা চা বাগানের সহকারী ব্যাবস্থাপক পরে কেয়াছড়া বাগানের দায়িত্বে এবং স্বাধীনতার স্বপক্ষের লোক । শহীদ সৈয়দ সিরাজুল আবদাল মামুন (বীর মুক্তিযাদ্ধা) ১৯৩১ সালের ১৮মে হবিগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী আউশপাড়া (সাহেব বাড়ি) নিবাসী জনাব সৈয়দ সাজিদ আলী সাহেবের ঔরসে ও সৈয়দা জামিলা খাতুনের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের পূর্বপুরুষ ছিলেন ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম হযরত খাজা সৈয়দ আব্দুল ওয়াহিদ বোগদাদী (রাহ:)। সৈয়দ সিরাজুল আবদালের পিতামহ ছিলেন সৈয়দ রেহমান আলী সাহেব এবং মাতামহ ছিলেন হবিগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী চন্দ্রচুরি (সাহেব বাড়ি) নিবাসী সৈয়দ ইজহার আলী পীর সাহেব। তিনি ছিলেন ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম সিপাহসালার হযরত সৈয়দ নাসির উদ্দিন (রাহ:)’র পরবর্তী বংশধর।
উল্লেখ্য সৈয়দ সিরাজুল আব্দালের মা-খালারা ছিলেন চারজন। তন্মধ্য তাঁর বড়খালা:- সৈয়দা কামরুন্নেছা খাতুনের বিবাহ হয় মৌলভীবাজার জেলার সদর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী কনকপুর (খান বাড়ি) নিবাসী জমিদার নজাবত আলী খান সাহেবের পুত্র গোলাম ইয়াজদানী খান সাহেবের নিকট। মেঝখালা:- সৈয়দা সামসুন্নেছা খাতুনের বিবাহ হয় হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার ঐতিহ্যবাহী স্নানঘাট (দেওয়ান বাড়ি) নিবাসী দেওয়ান তমিজ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী সাহেবের পুত্র দেওয়ান আব্দুল গণী চৌধুরী সাহেবের নিকট।
উনার ছেলে মেজর ( অবঃ) ডাঃসৈয়দ জামিল আব্দাল ও দুই মেয়ে সৈয়দা তাহমিনা আব্দাল কানাডা প্রবাসী ও সৈয়দা সায়মা আব্দাল ঢাকাতেই রয়েছেন তারা এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই দিনের সেই পিতৃহারানোর ব্যাথা – উনারা হয়তো আরো বিশদভাবে বিস্তারিত বলতে পারবেন ।
সম্প্রতি আমানীপুরের উপর লেখাটি প্রকাশিত হবার পর আমার সাথে যোগাযোগ হয় আমানীপুরের সৈয়দ আহবাব উদ্দিনের কন্যা সৈয়দা হাসিনার সাথে , উনার আর এক বোন সৈয়দা জান্নাতুল কুবরা ও ভাই সৈয়দ হোসেন শহীদ দেশেই আছেন ।কথা প্রসংগে উনার সাথে আলোচনা করে এই ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হই । কৃতজ্ঞতা জানাই উনাকে আত্বীয়তার শিকড় খুঁজতে গিয়ে জানলাম কানিহাটির আব্দুল মান্নান সাহেবের মেয়ে দিলারা রশিদ যার বিয়ে হয়েছে বেগম সিরাজুন্নেছার ছেলে জাহান জেব রশিদ চৌধুরীর সাথে তিনি সম্পর্কে সৈয়দা হাসিনার বোন হন , আর দিলারা খালাকে যেহেতু আমি খালা ডাকি এবং তিনি আমার খালা সুতরাং উনাকও খালা ডাকবো তিনি আপত্তি করেন নাই। তিনিও আমেরিকা এবং বাংলাদেশ মিলিয়েই থাকেন , উনার আপন খালুই হচ্ছেন সৈয়দ সিরাজুল আব্দাল । সৈয়দা হাসিনা খালার স্বরণ শক্তি অত্যান্ত প্রখর , তিনি অনেক তথ্য দিয়েছেন , অনেক গুলো নাম ও সম্পর্ক নিশ্চিত করেছেন অন্যথায় লেখাটিতে হয়তো কিছু ত্রুটি থাকতো ।
পাল্লাকান্দির জমিদার সৈয়দ আলী আখতার বাবা হয়রত শাহজালাল (রঃ) এর অন্যতম সাথী সিপাহসালার হযরত সৈয়দ নাসিরুদ্দিনের ১৪ তম পুরুষ , তার পিতার নাম সৈয়দ আলী আকবর ,পিতামহ শাহ সৈয়দ ইকরামুল্লাহ , সৈয়দ ইকরামুল্লাহ এর এক ভাই ছিলেন আমানীপুরের সৈয়দ ইনামুল্লাহ , আর এক ভাই সৈয়দ রহমতুল্লাহ , উনার পুত্র সৈয়দ মাহতাব উদ্দিন চলে যান নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার হারুলিয়া সাহেব বাড়ি। উনার নাতি ছিলেন বৌলাইয়ের বিখ্যাত জমিদার জালাল উদ্দিন আহমদ খুরশিদ মিয়া সাহেব ।
পাল্লাকান্দির সৈয়দ আলী আকতার সর্ব প্রথম বিয়ে করেন আওরঙ্গপুরের সৈয়দ আনহার বক্তের (ইয়াওর বক্তের ভাতিজা) বড় বোন কে। কিন্তু অল্প দিন পরেই তিনি অসুস্থ হয়ে মারা যান।
দ্বিতীয় বিয়ে করেন ইয়াওর বক্তের মেয়ে সৈয়দা সালেহা খাতুনকে – তাঁর ঘরে
১. সৈয়দা ফাতেমা আহবাব
২. সৈয়দা সাকিনা আবদাল
২. সৈয়দা কুলসুম এজাজ
৩. সৈয়দা যয়নব আলীম
৪. সৈয়দ জয়নাল আক্তার
৫. সৈয়দা সালমা ইসলাম
কিন্তু আওরঙ্গপুরের ইয়াওর বক্তের সাথে কোন কারনে মতবিরোধ হলে ইয়াওর বক্ত তাঁর মেয়েকে পাল্লাকান্দি যেতে দীর্ঘদিন বাধা দেন। যার কারনে সৈয়দ আলী আক্তার সেখান থেকে ফিরে এসে মন্ডাজে অপর বিয়ে করেন। উনারা কেউই জিবিত নেই আল্লাহ উনাদের সকলকে জান্নাত বাসি করুন।
তিনি ও তার দুই ছেলে সৈয়দ আলী আফজাল এবং সৈয়দ আলী আহসান “ পাল্লাকান্দি টি ষ্টেট এর অনেক উন্নয়ন করেন,
এই পাঁচ মেয়ের মধ্যে
১ম মেয়ে সৈয়দা ফাতেমা আক্তার স্বামী সৈয়দ আহবাব উদ্দিন যিনি আমানীপুরের সৈয়দ বুরহান উদ্দিনের নাতি ।
২য় মেয়ে সৈয়দা সাখিনা আক্তার , স্বামী সৈয়দ সিরাজুল আব্দাল মামুন
৩য় মেয়ে সৈয়দা জয়নব আক্তার , স্বামী এ.কে়.এম.এ. আলীম কোরেশী , বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী
৪র্থ মেয়ে সৈয়দা কুলসুম আক্তার , স্বামী মেজর জেনারেল এজাজ আহমেদ চৌধুরী (অঃ) ,সিলেট ফুলবাড়ী।
৫ম মেয়ে সৈয়দা সালমা ইসলাম স্বামী নজরুল ইসলাম , একজন ব্যবসায়ী ছিলেন
সৈয়দ আলী আকতারের পিতা ছিলেন সৈয়দ আলী আকবর প্রথম বিবাহ করেন নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার হারুলিয়া সাহেব বাড়ি নিবাসী সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া সাহেবের কন্যাকে। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। অতঃপর তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন কিশোরগন্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার বিখ্যাত জংগলবাড়ী দেওয়ান হাবেলী নিবাসী জমিদার সৈয়দ এমদাদ উদ্দিন হোসেন সাহেবের কন্যাকে। উল্লেখ্য তিনি ছিলেন ভাটি বাংলার বারো ভুইয়াদের প্রধান মসনদ-ই-আলা দেওয়ান ঈশা খাঁ’র পরবর্তী বংশধর দেওয়ান আজিম দাঁদ খান সাহেবের দৌহিত্র বংশীয়।
এই জংগলবাড়ীতে অবস্তানরত অন্যতম জমিদার সৈয়দ এমদাদউদ্দিন হোসেন যিনি তরপের নরপতির জমিদার , জংগলবাড়িতে আসেন হবিগঞ্জের নরপতি হতে তিনি ঐ জংগলবাড়ির খানেদামান্দ ছিলেন তার এক মেয়েকে বিয়ে দেন পাল্লাকান্দি সৈয়দ আলী আকবরের সাথে সৈয়দ এমদাদ উদ্দিন এর অপর মেয়েকে বিয়ে দেন বৌলাই সাহেব বাড়ীতে এবং তার একমাত্র ছেলের নাম ছিল দেওয়ান আজিম দাদ খান ওরফে মেনু মিয়া ।
সৈয়দ আলী আকতার পাক পান্জাতন ও আহলে
বায়েত এর অনুসারী ছিলেন । তাদের এখানে প্রতিবছর মহররম মাসে মহা শোক দিবস পালন করা হয় তিনি কারবালার শহীদানদের স্বরনে শোকাবিভুত থাকতেন ১০ ই মহররম আশুরার দিনে শোক মিছিলে অংশ নিতেন । তিনি অত্যানত দানশীল ছিলেন ও মানুষের সেবা করতেন ।আমাদের এই সকল হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন বাড়ীর কৃর্তিমান পর্বপুরুষদের ,কাছে দুরের নারী পুরুষ আত্বীয় স্বজনদের বিদ্বেহী আত্বার শান্তি কামনা করি ।আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন তাদের জান্নাত নসীব করুন । আমিন । ( চলবে)
৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সৈয়দ সিরাজুল আবদাল
হবিগঞ্জের আউসপাড়া নিবাসি সৈয়দ সাজিদ আলী ও সৈয়দা জামিলা খাতুনের ছোট ছেলে সৈয়দ সিরাজুল আবদাল, ১৯৫৯ সালে ডানকান ব্রাদার্স চা কম্পানির অধিন সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগানের ব্যাবস্থাপক হিসাবে চাকুরি শুরু করেন। সৈয়দ সিরাজুল আবদাল ১৯৬২ সালে মৌলভীবাজারে পাল্লাকান্দী চা বাগান মালিক সৈয়দ আলী আখতার ও সৈয়দা সালেহা খাতুনের দ্বিতীয় কন্যা সৈয়দা সাকিনা আখতারকে বিবাহ করেন। ১৯৭১ এর ১৯ এ মে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে সিলেট কেডেট কলেজে বন্দী অবস্থায় নির্মম ভাবে অত্যাচারিত হয়ে সৈয়দ সিরাজুল আবদাল শহীদ হন! তাঁর লাশ পাওয়া যায় নাই!
মৃত্যু কালে শহীদ সৈয়দ সিরাজুল আবদাল তাঁর স্ত্রী সৈয়দা সাকিনা আবদাল, শিশু পুত্র ৭ বছরের সৈয়দ জামিল আবদাল, শিশু কন্যা ৫বছরের সৈয়দা তাহমিনা আবদাল, ও ৩ বছরের সৈয়দা সায়মা আবদালকে রেখে যান। স্বাধীনতা উত্তর স্বামী হারা স্ত্রী সৈয়দা সাকিনা আবদাল ও তাঁর ৩ অনাথ শিশু সন্তানের জীবন যুদ্ধ ছিল আরো কঠিন ও দুর্বিসহ।
পাকিস্তান আমলে ব্রিটিশ মালিকানাধিন চা বাগান গুলোর ব্যবস্থাপনার সিংহভাগ ছিল উর্দু ও পাঞ্জাবী ভাষী পশ্চিম পাকিস্তানিদের দখলে, অবশিষ্ট কিছু ব্রিটিশ এবং হাতে গোনা কয়েক জন বাংগালী, যাদের মধ্য সৈয়দ সিরাজুল আবদাল ছিলেন অন্যতম। ৬০ দশকের শুরুতে সারা পুর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষা ও বাংগালী জাতীয়তাবাদের ছোয়া চা বাগান ব্যবস্থাপক সৈয়দ সিরাজুল আবদালকেও প্রভাবিত করে। চা বাগান গুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দৌরাত্ব ও বাংগালীদের প্রতি তাদের বৈসম্যমুলক আচরন তাঁকে ব্যথিত ও প্রতিবাদী করে তুলে। ৬৮-৬৯ এর গন আন্দোলনের সময় তাঁর সাথে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যবস্থাপকদের বাংলা ভাষা ও বাংগালীর সার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে তর্ক বিতর্কে অনাকাংখিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ১৯৭০ এ সৈয়দ সিরাজুল আবদাল সকল উর্দু-পাঞ্জাবী ভাষী ব্যবস্থাপকদের ঠিকানায় ইংরেজি তে একটি চিরকুট সংগে লিখে “বাংলা বর্ণমালার বই” ডাক যোগে প্রেরন করেন, ঘটনা জানাজানি হলে তিনি তাদের বিরাগ ভাজন হন। কিন্তু তাঁর ঐ এক কথা “বাংলাদেশে থাকতে হলে সবাইকে বাংলা শিখতে হবে!”, এই নিয়ে লাংলা ভ্যালী ক্লাবে এক পাকিস্তানি ব্যবস্থাপকের সাথে তাঁর হাতাহাতি হয়ে যায়।
১৯৭০ এর নির্বাচনের আগে সিলেট শহরের আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজীর সাথে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠে। নির্বাচনে চা বাগানের সকল শ্রমিক কর্মচারিদের একচেটিয়ে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয়ায় তাঁর উপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের সন্দেহ ও আক্রোশ বেড়ে যায়। ৭১ এর মার্চের অসহযোগ আন্দলোনে সৈয়দ সিরাজুল আবদাল আওয়ামী লীগ নেতা দেওয়ান ফরিদ গাজীর বাসায় কয়েক বার যাওয়া আসা করেন এবং শহরের সকল মিটিং মিছিলে চা বাগান শ্রমিক কর্মচারিদের অংশ গ্রহণ ছিল সতস্ফুর্ত ও সর্বাধিক। যা ছিল পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দার দৃষ্টি গোচরে। মার্চের ২৫/২৬ তারিখে শহরের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে তিনি পরিবারকে শ্বশুর বাড়ী পাল্লাকান্দীতে সৈয়দ আলী আখতারের চা বাগানে পাঠিয়ে দিলেও তিনি লাক্কাতুরা চা বাগানেই থেকে যান।
প্রথম দফা গ্রেফতার –
১৯৭১ এর ১লা এপ্রিল বৃহস্পতি বার- পাকিস্তানি সৈন্যরা সৈয়দ সিরাজুল আবদালকে লাক্কাতুরা চা বাগান থেকে গ্রেফতার করে ও বাংলো লুটপাট করে জালিয়ে দেয়। তারা তাঁকে সিলেট জেলে বন্দী রাখে।
বিদ্রোহী বাংগালী ইপিআর পুলিশ আনসার যোদ্ধাদের প্রচণ্ড চাপের মুখে পাকিস্তানি সৈন্যরা ৭ই এপ্রিল সিলেট শহর ছেড়ে উত্তরে সরে যায়।শহর দিন কয়েকের জন্য মুক্ত হলে সিলেট জেল থেকে অনেকের সাথে মুক্তি পান সৈয়দ সিরাজুল আবদাল। তিনি শ্বশুর বাড়ী পাল্লাকান্দীতে তাঁর পরিবারের সাথে মিলিত হলে এক আনন্দময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কিন্তু সেখানে তিনি মুক্তি যুদ্ধ সংঘটনের কাজে জড়িয়ে যান ও এপ্রিলের মাঝা মাঝি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কৈলাশহরে চলে যান।
কৈলাশহর থেকে ২৭ এপ্রিলে তিনি তাঁর ভাতিজা লন্ডন প্রবাসী সৈয়দ শহীদুল ইসলামকে বাংলাদেশের যুদ্ধ ও গনহত্যার বিবরন দিয়ে চিঠি লেখেন। চিঠিতে জানান যে তাঁর মেঝ ভাতিজা সৈয়দ জাহিদুল ইসলাম ইতিমধ্যে সশস্ত্র মুক্তি যুদ্ধে যোগ দিয়েছে এবং তাঁকে লন্ডনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধিনতার পক্ষে জোরদার আন্দোলন শুরুর করার অনুরোধ করেন। প্রবাসী ভাতিজা সৈয়দ শহীদুল ইসলাম ঐ চিঠি ৭১ এর ৪ মে তারিখে পেয়ে যান এবং অন্যান্য বাংগালী প্রবাসীদের তা দেখান, যা তাঁকে বাংলাদেশের পক্ষে আন্দোলন জোরদার করতে সাহায্য করে!
৭১ এর মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তায় সৈয়দ সিরাজুল আবদাল পরিবারের খোজ নিতে গোপনে পুনরায় পাল্লাকান্দীতে ফিরে আসেন। মুক্তিযুদ্ধ সংঘটনের কাজে তিনি মৌলভীবাজার-কুলাউড়া, শমশেরনগর অঞ্চলে ঘোরাঘুরি করায় তাঁর ফিরে আসা আর গোপন থাকে নাই।
সৈয়দ সিরাজুল আবদাল দ্বিতীয় বার গ্রেফতার! – ১৯৭১ এর ১৪ই মে শুক্রবার সকাল ১০-৩০মিঃ এ একটি রেল গাড়ীতে পাকিস্তানি মেজর আব্দুল ওয়াহেদ মোগল তার সৈন্য বাহিনী নিয়ে লংলা ও টিলাগাও ষ্টেশনের মাঝামাঝি পাল্লাকান্দি চা বাগানের কাছে থামে। সশ্ত্র সৈন্যরা পাল্লাকান্দি চা বাগানের ফ্যেক্টরী, অফিস ও সংলগ্ন বাংলো বাসস্থান ঘেরাও করে। তারা ফ্যেক্টরী ও অফিসের সামনের মাঠে সকল শ্রমিক কর্মচারি ও বাসস্থানের সকল পুরুষদের জড়করে বসিয়ে রাখে। মেজর মোগল সৈয়দ সিরাজুল আবদালের একটি ছবিও সংগে নিয়ে আসে। মেজর মোগল বার বার হুমকি দিতে থাকে যে- “যদি ঐ ছবির মানুষকে তার সামনে হাজির করা না হয় তবে তারা বাসস্থানের ভেতরে হামলা করবে”। মেজর মোগল বাড়ীর মহিলাদের উপর হামলা করবে – এই হুমকির মুখে বহু মানুষের সাথে অফিসের মাঠে বসে থাকা সৈয়দ সিরাজুল আবদাল নিজেই দাঁড়িয়ে যান। তিনি পাকিস্তানি মেজর মোগলের কাছে দুই রাকাত নামাজ পড়ার অনুমতি নিয়ে নামাজ পড়েন। মেজর মোগল ও তার সৈন্য বাহীনি তাঁকে চোখ বেধে সেই অপেক্ষামান ট্রেইনে করে নিয়ে যায়। সেটাই ছিল পরিবারের সকলের সাথে তাঁর শেষ বিদায়!
বন্দী অবস্থায় সৈয়দ সিরাজুল আবদালের শেষ কয়েক দিনের কথা জানাযায় সিলেটের প্রখ্যত রশিদ পরিবারের মরহুম আমিনুর রশিদ চৌধুরীর লেখা থেকে। আমিনুর রশিদ চৌধুরীর নিজেও শ্রীমঙ্গলে পাকিস্তানির হাতে গ্রেফতার হন এবং সিলেট কেডেট কলেজের পাশাপাসি কামরায় বন্দী ছিলেন। জানালা দিয়ে তাদের দেখা ও ইশারায় কথা হয়। বন্দী অবস্থায় নিয়মিত অত্যাচার ছাড়াও পাকিস্তানি পীচাশেরা তাঁর রক্ত নিত! আমিনুর রশীদ চৌধুরী তাঁর সাপ্তাহিক যুগোভেরী পত্রিকায় ১৯৭২ এর ১ লা এপ্রিলে প্রকাশিত “অবিস্মরণীয় সেই হাসি” শিরোনামে শহীদ সৈয়দ সিরাজুল আবদাল কে নিয়ে একটি স্মৃতি চারণ লেখেন। আমিনুর রশীদ চৌধুরীর কথায় তিনি শেষ বার ১৯ এ মে ১৯৭১ এ শহীদ সৈয়দ সিরাজুল আবদালকে বন্দী অবস্থায় কামরা থেকে নিয়ে যেতে দেখেছিলেন। কিন্তু শহীদ সৈয়দ সিরাজুল আবদাল আর ফিরে আসেন নাই বা তাঁর লাশ পাওয় যায় নাই!
আল্লাহ শহীদ সৈয়দ সিরাজুল আবদালকে জান্নাত বাসি করুন!
৭১ এ সিলেটের মুক্তি যুদ্ধে শহীদ সৈয়দ সিরাজুল আবদালের স্মৃতি স্বরনে নাট্যজন লুতফুন নাহার লতার উপস্থাপনায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নির্ভর অনুষ্ঠান, “আমাদের অশ্রু ও বিজয়ের গাথা-পর্ব ৯” প্রচারিত হবে আসছে রবিবার, ৩ অক্টেবর ২০২১। বাংলাদেশ সময় রাত ৯-০০ টা, লন্ডন সময় বিকাল ৪-০০ টা ও নিউইয়র্ক সময় সকাল ১১-০০ টায়।
৭১ এর স্মৃতি -পর্ব ২০ ( গাজিপুর)
সৈয়দ শাকিল আহাদ
কুলাউড়া শহরের প্রবেশমুখেই উছলাপারায় হাতের ডানদিকে নবীনচন্দ্র হাই স্কুলের ফুটবল খেলার মাঠ এবং বামদিকে খান বাহাদুর মৌলবী আমজদ আলীর বাড়ি , বিশাল এক পুকুর নিয়ে তৈরী সেই বাড়িতেই টুক টুক করে বেড়ে উঠেছি আমি ,সেই পুকুরের পানি আজও স্বচ্ছ টলটলে , ছোটবেলায় এই পুকুরের পানি খেয়ে বড় হয়েছি ,দক্ষিন দিকে পাড়ের মাঝবরাবর গাছগাছালীর মাঝে কয়েকটি মনগাছ বা মাকালফল গাছ ও পেয়ারা গাছ ছিল ,
আজও সেখানে অর্থাৎ সেই পুকুরে মাছেরা , হাসেরা-সাঁতার কাটে ,আজও মনে আছে সেই মধুর স্মৃতি , পাড়ের গাছ গাছালী্র পাতার ভিড়ে চুপটি করে বসে থাকতো মাছরাঙ্গা ,ডানা শুকাতো পানকৌড়ি, ফিঙে দোল খেতো পেয়ারা গাছের মগডালে , দুপুরের রোদ গায়ে মেখে খোলা আকাশে উড়ে বেড়াতো চিল ,পুকুরের জলভরা বুকে সেই চিলের ছায়া ভেসে বেড়াতো আর বিষন্ন কন্ঠের ডাক মধ্যান্হের নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে মনকে উদাস করে তুলতো ,শরৎ এলেই শাপলা ফুটতো,
,জৈষ্ঠ্য মাসে পশ্চিম পাড়ের আম গাছের নিচ থেকে আম কুড়ানোর সুখ আজও উপলব্ধি করি নিরবে নিভৃতে , তার পিছনেই বাড়ীর দেওয়াড়ে বিশাল বড় লাল টুকটুকে কৃষ্নচুড়ার গাছ ও সাথে তেতুল ও খেজুর গাছের অস্তিত্ব কখনই ভোলার মত নয় , আষাঢ়ে টুপটাপ ঝড়ে পড়া বৃষ্টির ফোটাগুলোকে গায়ে মেখে ঐ পুকুরে সাঁতার কেটেছি অনেক – অনেক ,
আহারে সেই বর্ষাকালের কি দারুন উপলব্ধি !!
স্মৃতিচারণমুলক লিখা লিখতে বসে যখন অনেক কিছুই মাথায়। আসে ,তখন বিষয় গুলোকে জরুরী , কম জরুরী , গুরূত্বপূর্ন , কমগুরুত্বপূর্ন মনে করে ঐ বিষয়গুলোর মাঝখান থেকে কোন একটা বিষয় বাছাই করে লিখবো ভেবে বসে আছি , অথচ মন মানছে না , কিন্তু মনকে যতই বুঝাচ্ছি কিছুতেই মানছে না ,
মনকে মানিয়ে নিতে হচ্ছে ,
হটাৎ মনে হলো দ্বিধা দন্দে না থেকে একটু আগ বারিয়ে সামনে এসে কুলাউড়া শহরের দক্ষিন দিকে আগাই ।
মনটা চাইছে রবির বাজারের দিকে যেতে ,তাইতো স্কুল চৌমুহনী পর্যন্ত এসে বামে পুর্বদিকে রেলক্রসিং পাড় হয়ে কলেজ রোড ধরে
গাজিপুরের দিকে ছুটলাম ।
রেললাইনের পুর্বদিকের গ্রামগুলোর মধ্যে ,কয়েকটি গ্রাম ও এলাকার কথা বেশ বেশি মনে হচ্ছে যেমন ঃ-দানাপুর,দতরমুরি,লষ্করপুর ,
ঘাঘটিয়া , কামারকান্দি,জয়চন্ডী,রামপাশা,
দিলদারপুর,দুর্গাপুর,মিঠিপুর,আবুতালিবপুর,বেগবানপুর,গিয়াসনগর,গোপালীছড়া,মেরিনা,মীরশংকর,পাঁচপীর ,রসুলপুর,পোষাইনগর,
হরিহরপুর ,লৈয়ারহাই,গৌরীশংকর,রঙ্গীরকুল,সাদেকপুর,মীরবকসপুর,রাজাপুর,কুটাগাও ,গাজিপুর ইত্যাদি তাদের মধ্যে অন্যতম ।
কুলাউড়ায় পাক বাহিনী এসে বিভিন্ন জায়গায় আস্তানা তৈরী করে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে , তাদের সাথে যুদ্ধ ও হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা , মিত্রবাহিনীর সমন্নয়ে ,তেমনি দু একটি যুদ্ধের বর্ননা না দিলেই নয় ,
আমি যু্দধকালিন ঘটে যাওয়া
ঘটনাসমুহের সরাসরি প্রত্যক্ষদর্শী নই , তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ননায় ও বিভিন্ন মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়ে ছি যেহেতু আমি তখন অনেক ছোট ছিলাম তাই নানাজনে , নানামতে বিভিন্ন প্রকার প্রশ্ন জাগতে পারে ,
প্রশ্ন জায়গাটা খুবই স্বাভাবিক ,তখনকার যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী কয়েকজন প্রত্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিতে ঐ ঘটনা সমুহের যতেষ্ট মিল খুঁজে পেয়ে লিখে যাচ্ছি কিছু স্মৃতি যা অনেক মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও কবি লেখকেরা তাদের লেখনিতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে তুলে এনেছেন ।বিশেষ ভাবে এই অন্চলের মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদ ,মোহাম্মদ ওয়াহিদ মুরাদ তাদের মধ্যে অন্যতম কৃতজ্ঞতা জানাই তাদের প্রচেষটা কে ।
কুলাউড়ার আশে পাশের কিছু যুদ্ধের কথা , কিছু সেনাবাহিনীর কর্মকর্তার কথা বেশকিছু মুক্তিযোদ্ধাদের কথা , কুলাউড়া অন্চলের সাহসী সূর্যসন্তান দের কথা ,বীরাঙ্গনাদের কথা ,অনেক বেশী মনে হচ্ছে যা বহুভাবে বিভিন্ন জনের আলোচনায় এসেছে ,
ঃ-পাকিস্তানি মিলিটারীদের উপর হামলা চালিয়েছিল কুলাউড়ার সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রবেশ করে ভারতে ট্রনিংপ্রাপ্ত বাঙ্গালী বীরযোদ্ধারা ,বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাতের বেলা চলতো ঐ সকল অপারেশন ।যুদ্ধের পরিকল্পনা এ আক্রমনের স্থান ঠিক করে দিতো ৪ নং সেক্টরের কর্মকর্তারা , এই কুলাউড়া তখন ৪ নং সেক্টরের আওতাধীন ছিল ঃ-
বিশিষ্ট গবেষক রফিকুল ইসলামের রচনায় গ্রন্থ “ লক্ষ্য প্রানের বিনিময়ে “র ৩১৯ নং পৃষ্টার বর্ননায় স্পষ্ট জানা যায় ঃ-
৪ নং সেক্টরের সাথে যে সব সেনা কর্মকর্তারা যুক্ত ছিলেন , তারা হলেন ঃ-
১) মেজর জেনারেল সি আর দত্ত
২)কর্নেল আব্দুর রব
৩)লেঃ কর্নেল শরিফুল হক বীর উত্তম ( অব:)
৪) স্কোয়ার্ডন লিডার নুরুল কাদির ( অবঃ)
৫) লেঃ কর্নেল খায়রুল আনাম (অব)
৬)লেঃ কর্নেল এম এ রাশেদ চৌধুরী বীর প্রতিক (অবঃ)
৭) লেঃ কর্নেল সাজ্জাদ আলি
বীর প্রতিক (অবঃ)
৮) লেঃ কর্নেল এস.এ. হেলাল উদ্দিন, পি.এস.সি (অবঃ)
৯)মেজর আব্দুল জলিল (অবঃ)
১০) লেঃ কর্নেল এ. কে.এম. জালালাবাদী
১১) লেঃ কর্নেল নিরন্জন ভট্টাচার্য
১২) মেজর জহিরুল হক ,
বীর প্রতিক (অবঃ)
১৩) মেজর ওয়াকিউজ্জামান ।
১৪) লেঃআতাউর রহমান
১৫) মেজর দোস্ত মোহাম্মদ সিকদার ( অবঃ)
১৬) লেঃ কর্নেল চৌধুরী মোহাম্মদ আলী
১৭) মেজর মুক্তাদির আলী
১৮) লেঃ কর্নেল চন্দ্র কান্ত দাস
১৯) লেঃ কর্নেল জীবন কানাই দাস
যুদ্ধ হয়েছিল , দত্তগ্রামে,জুড়িবাজারে,শরীফপুর ইউনিয়নের চাতলাপুরে,পৃথিমপাশা নবাববাড়ির ডাকঘরে,আলীনগর বিওপিতে ,সাগরনালে, নিশ্চিন্তপুরে ,মুরইছড়াতে,পাবই রেলসেতুতে ,দিলদারপুরে,দিলকুশা চা বাগান এলাকায়,মনু নদীর উপর পল্কী ব্রিজ এলাকায়,ফুলতলা বাজারে,কর্মধা ইউনিয়নের কালাইগীরি ক্যাম্পে ,গাজিপুর চা বাগান সহ উল্লেখ যোগ্য স্থানে ।
বিখ্যাত সেই গাজীপুরের যুদ্ধ ছিল তেমনি একটি স্বরনীয় যুদ্ধ যা
১৯ ৭১ সালের ৪ এবং ৫ ডিসেম্বর
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন পরিচালিত একটি সামরিক অভিযান।
এটি সংঘটিত হয়েছিল কুলাউড়ার কাছে গাজীপুর টি ষ্টেটে।
যেটি পূর্ব পাকিস্তানের সিলেট জেলায় অবস্থিত।
অগ্রসরমান মিত্রবাহিনী মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের উপর আক্রমণ করেছিলো।
কেউ কেউ এই যুদ্ধকে সিলেটের যুদ্ধ নামেও পরিচিতি দিয়েছেন ।
এই যুদ্ধে ১১ জন নিহত হয়েছিল, ৬১ আহত হয়েছিল ।
উল্লেখ্য ২৭ নভেম্বর ১৯৭১ বিকালে ৪/৫ গোরখা রাইফেলস কদমতলার দিকে অগ্রসর হয়।
এটি পূর্ব পাকিস্তানের সিলেট বিভাগের সীমান্তের কাছাকাছি কুলাউড়া -মৌলভীবাজার সেক্টরের উল্টোদিকে অবস্থিত।
এর আগে এই এলাকা দখলের জন্য ছোট ছোট অনেক যুদ্ধ ও আক্রমণ পরিচালিত হয়েছিল। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৮ম মাউন্টেইন ডিভিশনের উল্টোদিকে ছিল ৫৯ তম মাউন্টেইন ব্রিগেড। এই এলাকাটি সীমান্ত পর্যন্ত চা বাগান ঘেরা পাহাড় দিয়ে পরিবেষ্টিত ছিল। আরও পশ্চিমে দৃষ্টিসীমার ভেতরে আরও কিছু ছোট ছোট পাহাড় চমৎকার প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছিলো।
সেই সাথে ভারতীয় সীমান্তে নজরদারীর জন্য জায়গাটি ছিল চমৎকার।
পাহাড়গুলো ছিল কুলাউড়ার ঠিক পূর্বে এবং সিলেটের সমতল অঞ্চল এখান থেকেই শুরু হয়েছিল। কুলাউড়া ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম কেন্দ্র এবং রেলপথে ধর্মনগর – গাজীপুর – মৌলভীবাজার – সিলেটের সাথে সংযুক্ত ছিল।
৫৯তম মাউন্টেইন ব্রিগেডের সাহায্যে ধর্মনগর – গাজীপুর – কুলাউড়া, ধর্মনগর – জুরি সীমান্ত পোস্টগুলোর দখল নেওয়া।
৮১তম মাউন্টেইন ব্রিগেড শমশেরনগর – ফেঞ্চুগঞ্জ – মৌলভীবাজার অঞ্চলের দায়িত্বে থাকবে।
লক্ষ্য ছিল সম্মিলিত সামরিক আক্রমণের মাধ্যমে সিলেট বিভাগের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া।
পাকিস্তানের ১৪ তম ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের ৩১৩ তম ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড মৌলভীবাজারে অবস্থান করছিল। যখন এর ৩য় ব্রিগেড আরও দক্ষিণে ভৈরব বাজার এবং আশুগঞ্জ অঞ্চলের দায়িত্বে ছিল, এর ২০২ তম ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড সিলেটে চলে গিয়েছিল।
২২ বেলুচ রেজিমেন্ট সাগরনাল, গাজীপুর, কুলাউড়া এবং জুরি এলাকা অতিরিক্ত মিলিটারি ইউনিট এবং EPCAF এর সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করছিল।
এই ব্যাটালিয়ানের একটি ইউনিট ধর্মনগর – জুরি অঞ্চল এবং কয়েকটি সীমান্ত পোষ্টে নিযুক্ত ছিল।
প্রতি সীমান্ত পোষ্টে এক প্লাটুনের বেশি সৈন্য,
সাগরনালে EPCAF,
গাজীপুরে এক ইউনিট, কুলাউড়ায় ব্যাটালিয়ান হেডকোয়ার্টার এবং অবশিষ্ট সৈন্য মৌলভীবাজারে অবস্থান করছিল।
কিন্তু ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের কাছে যে সেই সময় অতিরিক্ত পরিদর্শনমূলক ব্যবস্থা এবং আত্মরক্ষার জন্য প্রচুর পরিমাণ গোলাবারুদ ছিল সেটা কারো জানা ছিল না।
ভারতীয় ৫৯ মাউন্টেইন ব্রিগেড প্রাথমিক ভাবে ৪/৫ গোর্খা রাইফেলসের যা সীমান্ত বাহিনী নামে অভিহিত তাদের সাহায্যে সাগরনাল সীমান্তের আউটপোস্ট দখল করে নেয়ার পরিকল্পনা করে। ৯ম রক্ষীবাহিনী জুড়ি এবং
৬ষ্ঠ রাজপুত বাহিনী গাজীপুর দখল করে কুলাউড়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।
যুদ্ধ চলার কারণে ৪/৫ গোর্খা রাইফেলস বা সীমান্ত বাহিনী
৬ষ্ঠ রাজপুত বাহিনীর প্রয়োজনে নিয়োজিত ছিল।
কুলাউড়া সুরক্ষিত হওয়ার পর এই দুই বাহিনীর একত্রে কাজ করার পরিকল্পনা করে ।
গাজীপুরের ধর্মতলা – কদমতল – সাগরনাল – গাজীপুর – কুলাউড়া রোডের অনেকটা অংশ গাজীপুর চা বাগানের ম্যানেজারের বাংলো এবং দক্ষিণপূর্ব দিকের উঁচু এলাকা দিয়ে গিয়েছিল।
চা গাছের সারি এই এলাকায় গোলকধাঁধা সৃষ্টি করেছিলো এবং এর গলিগুলো স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে বেষ্টিত ছিল।
এর উত্তরের উঁচু জমি ছিল নজরদারির জন্য চমৎকার স্থান। এখানকার ব্যাঙ্কারগুলো কলা গাছ দিয়ে আচ্ছাদিত ছিল যা
“কেলা-কা-বাগিচা “ নামে সকলের কাছে পরিচিত ছিল। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর রাত ৯ টার দিকে ৬ষ্ঠ রাজপুত বাহিনী গাজীপুর আক্রমণ করে এবং শক্ত প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।
ভোরের কিছুক্ষন আগে এটি স্পষ্ট হয় যে আক্রমণটি ব্যর্থ হয়েছে এবং সাহায্য চেয়ে পাঠানোর মত সময় নেই।
এই অবস্থায় ৪/৫ গোর্খা রাইফেলসকে বা সীমান্ত বাহিনী কে ১৯৭১ সালের ৪/৫ ডিসেম্বর পরবর্তী রাতে গাজীপুর দখল অভিযানের ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল।
তারা ৪ ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে। আগের রাতের আক্রমণের সম্মুখীন হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী যে কোন দিক থেকে যে কোন রকম আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
তাদের সাহায্যের জন্য কামান প্রস্তুত ছিল। পাকিস্তানের চমৎকার সংগঠিত ২২ বেলুচ কোম্পানি গাজীপুরের কেলা-কা-বাগিচায়, স্কাউটদের সাথে, ম্যানেজারের বাংলোতে, এমএমজির কারখানায় এবং কোম্পানির সদর দফতরে এক প্লাটুন করে নিয়োজিত ছিল এবং সাথে অন্যান্য পরিদর্শনমূলক এবং সাহায্যকারী যন্ত্রপাতি ছিল। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নির্মাণাধীন এলাকা কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছিল এবং তাদের সুসজ্জিত ব্যাঙ্কার প্রস্তুত ছিল।
গোর্খা রাইফেলস বা সীমান্ত বাহিনী পর্যায়ক্রমিক ভাবে ডেল্টা কোম্পানির সাহায্যে “কেলা-কা-বাগিচা,”
আলফা কোম্পানির সাহায্যে ম্যানেজারের বাংলো,
ব্রাভো এবং চার্লি কোম্পানির সাহায্যে কারখানা অঞ্চল দখলের পরিকল্পনা করে ।
সিও টু ,শ্যাম কেলকারকে
বি এবং সি কোম্পানি পরিচালিত কারখানা আক্রমণের প্রধান কমান্ডার করা হয়েছিল।
লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ায় নেতৃত্ব দিয়েছিল ডেল্টা কোম্পানি। রাত ৮ টা ৩০ মিনিটের দিকে সামনের সৈন্যরা “কেলা-কা-বাগিচার” উত্তরের উঁচু জায়গায় পৌঁছায় এবং পাকিস্তানি বাহিনী কামান, এমএমজি এবং এলএমজি দিয়ে আক্রমণ করে। প্রায় ৮.৪৫ নাগাদ কোম্পানি আক্রমণ শুরু করে। একদম শেষ মুহূর্তে পাকিস্তানিরা আক্রমণে সুবিধা করতে পারে এবং তারা হিংস্র হয়ে ওঠে। সম্মুখ যুদ্ধে অনেকেই আহত হয়।
পরবর্তী লক্ষ্য ম্যানেজারের বাংলোর চারপাশে ব্যাঙ্কার থাকার কারণে এটি রীতিমত একটি দুর্গ হয়ে উঠে। চা গাছের সারির ফাঁক থেকে এবং কেলা-কা-বাগিচার সামনে থেকে আক্রমণ পরিচালিত হতে থাকে। রেডিও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে আলফা কোম্পানির কোন খবর পাওয়া যাচ্ছিল না ফলে ব্রাভো কোম্পানির উপর ম্যানেজারের বাংলো দখলের দায়িত্ব পরে। আলফা কোম্পানি জানত না যে পরিকল্পনা পরিবর্তন করে ব্রাভো কম্পানিকে তাদের কাজটি দেওয়া হয়েছে।
ব্রাভো কোম্পানি যখন “কেলা-কা-বাগিচার” পাশ থেকে আক্রমণ করছিল তখন সৌভাগ্যবশত আলফা কোম্পানি একটি সঙ্কীর্ণ বাঁকের আড়ালে ছিল। ম্যানেজারের বাংলো দখলের সময় ব্রাভো কোম্পানির কমান্ডার সহ অনেকেই হতাহত হয়েছিল। অন্যদিকেও তখন সিও টু ,
মেজর শ্যাম কেলকার এর মৃত্যুতে নীরবতা বিরাজ করছিল। আক্রমণের নেতৃত্ব দেওয়ার সময় সিও টু -মেজর শ্যাম কেলকার গুলিবিদ্ধ হন এবং ঘটনাস্থলেই মারা যান।
চা কারখানার শেষ এবং ফলাফল নির্ধারণকারী আক্রমণটি কমান্ডিং অফিসারের মৃত ব্রিগেডিয়ার এ বি হরলিকার, এমভিসি বক্তব্যে থেকে অনেক অজানা তথ্য উঠে এসেছে ।
গাজিপুর বাগানে বেশ কয়েক বার গিয়েছি তাও স্বাধীনতার অনেক পরে হাবীব মামার বাংলোতে,তিনিও ৭১ এর অনেক পরে ঐ বাগানের ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন ।তিনি হবিগঞ্জের সুরাবই সৈয়দ বাড়ির সন্তান ,হযরত সৈয়দ নাসিরুদ্দিন (রঃ)সিপাহসালার এর বংশধর এস এম হাবিব , কেউ কেউ তাকে হাসিব সাহেব বলে ডাকতো ,খুউব সুন্দর ব্যাডমিন্টন খেলতেন ৭০ এর দশকের শেষের দিকে কুলাউড়া থানার সামনে হাবিব মামার বেডমিন্টন খেলা দেখার জন্য থানার সামনে রাস্তার পাশে অপেক্ষা করতাম , তার মেয়ে শাম্মী ও বেডমিন্টন খেলতো ,শাম্মী এবং ডাঃ আজহারুন্নেছা খালার মেয়ে ডলি দের একটি জুটি ছিল এরাও অত্যান্ত সাহসীকতার সাথে ডাকবাংলোর সামনে কোর্টেকাটা মাঠে বড়দের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলতে দেখেছি ,
যাই হোক বলছিলাম হাবিব মামার কথা ,বড় মামা আমীর আলীর সাথে , কৌলার জুবেদ মামার সাথে সহ কুলাউড়ার অধিকাংশ সম্ভ্রান্ত পরিবার ও লোকদের সাথে ছিল তার যোগাযোগ ও উঠা বসা ,সেই সুবাদে যে কয়বার তার বাংলোতে বেড়াতে গিয়েছি তিনি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতেন তার বাংলোর আশে পাশে কোথায় কিভাবে যুদ্ধ হয়েছে ,
এই গাজীপুরের যুদ্ধের সময়ের একজনের কথা না বললেই নয় , তিনি হচ্ছেন মুক্তি যোদ্ধা “ বীর প্রতিক আব্দুল জব্বার “
যার বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইল থানায় ।
বীর প্রতিক আবদুল জব্বারের জন্ম ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার কপালহর গ্রামে। তার বাবার নাম ইসহাক আলী এবং মায়ের নাম সৈয়দজান বেওয়া। তার স্ত্রীর নাম আয়েশা বেগম। তাদের তিন মেয়ে, চার ছেলে।
বীর প্রতিক আবদুল জব্বার চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন দিনাজপুর ইপিআর সেক্টরের অধীনে। তখন তার পদবি ছিল নায়েব সুবেদার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে ভারতে যান। সেখানে তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি বৃহত্তর সিলেট জেলায় যুদ্ধ করেন।(চলবে)
৭১ এর স্মৃতি —(৫)
সৈয়দ শাকিল আহাদ
স্মৃতি বড়ই মধুর আবার এই স্মৃতিই অত্যন্ত্য জ্বালাময় , ৭১ এর স্মৃতি কোন ভাবেই মধুর নয় অবশ্যই বেদনাদায়ক , যাদের আপনজন হারিয়েছে তাঁরাই কেবল উপলব্ধি করতে পারে সেই ব্যাথা কতটা ভয়াবহ ?
আজ এতদিন পরে সেই একাত্তরের কথা লিখতে বসে মনটাকেও বানিয়ে নিতে হচ্ছে ঐ সময়ের শিশুসুলভ ।
অনেক অনেক জলজ্যান্ত ঘটনার মত দুই একটি ঘটনা না বলে আর পারছি না ।
ছোট্ট থানা শহর কুলাউড়াতে পাকিস্তানী মিলিটারীরা প্রবেশ করে মে মাসের ৬ তারিখ রাতে , শহরে ঢুকেই তারা কুলাউড়া হাসপাতালে ,গার্লস স্কুলে , পৃথ্বীমপাশা নওয়াববাড়ি ও নবীনচন্দ্র স্কুলে ক্যাম্প তৈরি করে । আর তাদের প্রধানেরা , ক্যাপ্টেন দাউদ এবং মেজর আব্দুল ওয়াহিদ মোঘল অবস্তান নেন কুলাউড়া থানার বিপরিতে ডাক বাংলোতে ।
ক্যাপ্টেন দাউদের অতি মাত্রায় নির্যাতন ও পাশবিকতার দরুন তাকে সারা কুলাউড়ার সবাই যমের মত ভয় পেত ।
নবীনচন্দ্র স্কুলের একপাশে ক্যাম্প
স্থাপন করে , স্কুলের শিক্ষকদের নির্দেশ দিয়েছিল ছাত্রদের এনে নিয়মিত ক্লাস চালিয়ে যেতে যাতে স্কুল কলেজ খোলা আছে এবং ছাত্ররা নিয়মিত স্কুলে আসছে তা বিশ্ববাসি বুঝতে পারে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক ,ঐ সময়ে ছাত্ররা ভয়ে স্কুলে আসা বন্ধ করেছিল । তারপরও শিক্ষকগন ও আলবদর , রাজাকারেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে অনুরোধ করতো স্কুলে আসার জন্য , ইতিমধ্যে অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছিল ওপারে , কেউ কেউ আবার দেশকে শত্রুমুক্ত করার তাগিদে ভারতে গিয়ে যোগদিয়ে ছিল ট্রেনিং ক্যাম্পে , যারা দেশ ছেড়েছিল ওরা তো বেচে গিয়েছিল অনেক সাহসী ছাত্ররা শিক্ষকদের মান সম্মান রক্ষার্থে ভয়ে ভয়ে অনিচছা সত্বেও স্কুলে আসতো , ছোট বড় বিভিন্ন ক্লাসের ছেলেদের একসাথে করে নামেমাত্র রোল কল করে ২/৩টি ক্লাস নেওয়া হতো ,আর বারান্দায় হাটতো পাকিস্তানী সৈন্যরা। সেই দূ:সময়ের এক সাহসী নবম শ্রেণীর ছাত্র ছিল রাৎগাওয়ে জমিউর রহমান , তার মুখেই শোনা ,মিলিটারীরা কুলাউড়া আসার পরে প্রাণভয়ে কেউ স্কুলে আসতো না , রাজাকারেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলতো , স্কুলে না গেলে পাকিস্তানি মিলিটারীরা এসে ধরে নিয়ে যাবে , হত্যা করবে ,আর স্কুলে গেলে ছাত্রদের এবং তাদের পরিবারের কোন অসুবিধা হবে না ,
জামিউর আরো বলেছিল , আমরা অনিচছা সত্বেও স্কুলে যেতাম ক্লাস যখন চলতো তখন দরজার কাছে বসে থাকতো পাকিস্তানি সেপাহী ।
অক্টোবরের শেষের দিকে কোন একদিন আমাদের ক্লাসের সম্মুখে এসে বসেছিল এক মোছওয়ালা সৈন্য,ক্লাস নিচ্ছিলেন আহসান স্যার ঐ সৈন্যের কোকরানো মোছ দেখে আমাদের হাসি পাচ্ছিল ,সৈন্যটি ক্লাসে উকি দিতেই হোসেনপুর গ্রামের নুর মিয়া উচ্চস্বরে হেসে উঠে ,হাসির শব্দ শুনে সৈন্যটি অগ্নিমুর্তি ধারন করে ক্লাসের ভিতর ঢুকেই স্যারকে জিজ্ঞেস করে ‘কোনসে ছোকড়া হাসা ?
দেখেননি বলতেই ,সে স্যারের গালে দুটি চড় বসিয়ে দিয়ে দ্রুত ক্যাপ্টেন দাউদের কামরায় চলে যায় ।১৫ মি পরে একটি গাড়ি নিয়ে এসে স্যারসহ আমাদেরকে গাড়িতে উঠতে বলে ,আমাদেরকে কুলাউড়া হাসপাতালের বর্তমান ইমার্জেন্সী রুমে নিয়ে ঢুকিয়ে বাহির থেকে তালা মেরে দেয় ।সেখানে আমরা ২৬ জন ভয়ে পাথর হয়ে ছিলাম ,আহসান স্যারও এক কোনে নিরবে বসেছিলেন ।আমরা কয়েকজন জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি রামপাশার বাতির মেম্বার , মাহতাব চৌধুরী ও তার সাথে এক কাবুলীওয়ালার এবং একজন পাক সেনা উর্দুতে কি যেন বলাবলি করছে ,বেশ কিছুক্ষন পর দুইজন সিপাহী এসে রুমের তালা খুলে আমাদের কে বেরুতে বলে ,ভয়ে সেদিন ঐ রুমে আল্লাহকে কত যে ডেকেছি তার ইয়ত্তা নেই ,আমরা এক এক জন রুম থেকে বের হই আর সৈন্যরা আমাদের গালে দুইটা করে চড় মারে ,ওদের হাত বেশ শক্ত ছিল , আমার গালে এমন চড় মেরেছিল যার দরুন গাল বেশ কয়েক দিন ফোলা ছিল ।তার পর আমাদেরকে বেলা ৪টার দিকে গাড়িতে করে নিয়ে যায় স্কুলে , সেখান থেকে বই খাতা নিয়ে বাড়িতে চলে যেতে বলে ।বাঘের খাঁচা থেকে মুক্তি পাবার পর বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়েছি , কাফুয়ার পুলের কাছে যাবার পর পুল পাহারারত মুকুন্দপুরের রাজাকার ইব্রাহিম আলি পুলের উপর দিয়ে যেতে মানা করে , কি আর করবো তখন বই খাতা জামা কাপর ভিজিয়ে সাতরে ফানাই গাং পাড়ি দিয়ে বাড়ি যাই ।যতদিন পাকিস্তানী আর্মিরা ছিল ততদিন আর স্কুলে ক্লাসে যাইনি ।
জমিউর আরো বলেছিলেন ,
আমরা স্কুলে গিয়ে বাইরে থেকে দেখতাম , স্কুলের ফিল্ডে বহুদিন বহুলোক জড়ো হয়ে আছে ।স্কুলের দক্ষিন পশ্চিম পাশ্বের খালি জায়গায় প্রতিদিন বন্দিদের দিয়ে গর্ত খনন করানো হতো , পরের দিন দেখতাম সেই গর্তগুলো মাটি চাপা দেওয়া আর আগের দিনের ঐ মানুষ গুলো নেই ।তাগড়া জোয়ান ,শরীরের নানা জায়গায় আঘাতের চিন্হ, হাত পা বাঁধা , সুর্যের দিকে তাকিয়ে আছে , পাশ্বে সেন্ট্রি দাঁড়ানো সেই লোক গুলোর অমানবিক নির্যাতনের কষ্টের কথা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না, তাদেরকে তিলে তিলে হত্যা করা হতো , জমিউরের সচক্ষে দেখা পাকিস্তানী আর্মিদের সেই অমানবিক অত্যাচারের বর্ননা বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ও বইয়েও
উঠেছে । আমরা রাউৎগাওয়ের সেই স্কুল ছাত্র জমিউর রহমানকে স্যালুট জানাই তাকে তো আর মুক্তিযোদধা বলতে পারবো না ,তবে তিনি সহযোদ্ধা ৭১ । (চলবে)
৭১ এর স্মৃতি – পর্ব ৩১- (মুরইছড়া ,কর্মধা )
সৈয়দ শাকিল আহাদ
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ে উল্লেখযোগ্য ছিল সারাদেশের বিভিন্ন স্হানে সর্বস্তরের সাধারন জনগনের উদার সম্পৃক্ততা, তাদের অপরিসীম অবদান ও নিস্বার্থ পরিশ্রমের ফলে দ্রূত এদেশকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও আভ্যন্তরীণ মদদ দাতাদের কবলথেকে শত্রমুক্ত করতে দারুনভাবে সহায়তা করেছিল ,বিশেষ করে কৃষক ,মজুর,ছাত্রছাত্রী ,নারী,
পুরুষসহ আপামর জনসাধারণ, উল্লেখ্য,এদের মাঝে অনেক স্থানে স্হানীয়ভাবে অনেকেই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যাদের নাম পরবর্তীতে তেমন আলোচনায় আসে নাই এবং তারা ছিলেন প্রচার বিমুখ সেই সকল সহযোদ্ধাদের প্রতি গভীর ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জানিয়ে, অল্পবিস্তর জ্ঞানের আলোকে এই স্মৃতিচারণে আরো কিছু কথা বলার সুযোগ নিচ্ছি ,এতে হয়তো এই স্মৃতিচারণ কিছুটা দীর্ঘায়িত হবে তবে আমার বিশ্বাস বর্তমান এবং পরবর্তী প্রজন্মের কেউ কেউ দারুণভাবে উৎফুল্লিত হবেন ।
আজ কুলাউড়া থানার কর্মধা ইউনিয়নের কিছু কথা বলতে ইচ্ছা করছে , ১৯৭১ সালে এই ইউনিয়নের গুরুত্ব ছিল অনবদ্য । এটি মৌলভীবাজার জেলার বর্তমান কুলাউড়া উপজেলার অন্তর্গত একটি ইউনিয়ন ,যার উত্তরে কুলাউড়া ও রাউৎগাঁও ইউউনিয়ন ,দক্ষিনে ভারত সীমান্ত, পূর্বে ফুলতলা ইউউনিয়ন ও পশ্চিমে পৃথিমপাশা ইউনিয়ন অবস্থিত।
বর্তমানে ঢাকা থেকে কুলাউড়ায় বাস বা ট্রেনে এসে আবার বাস বা সি এন জিতে রবিরবাজার পর্যন্ত এসে রবিরবাজার থেকে সি এন জি বা অটো রিক্সায় চরে কর্মধা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের বিভিন্ন গন্তব্যে ঘুরে আসা আসা যায় ।
যা এক সময় অর্থাৎ যুদ্ধের সময় অকল্পনীয় ছিল ।
সম্প্রতি বেশ কয়েক জন পূরোনো মুক্তিযোদ্ধার সাথে কথা বলে একমত হই যে ,
১৯৭১ সালের ১৩ই জুলাই তারিখে সেই ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যে ভারতীয় ক্যাপ্টেন হামিদের নেতৃত্বে মাত্র ২৮ জন মুক্তিযাদ্ধা নিয়ে ভারতের টিলা বাজার থেকে মুরইছড়া পাকিস্তানী ক্যাম্প আক্রমনের পরিকল্পনা করেন এবং সেই মোতাবেক যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন ।
মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী হিসাবে মৌলভীবাজারের সাবেক এমপি আজিজুর রহমান এবং অধ্যাপক ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে হাল্কা অস্রহাতে রাত দেড়টার পরে মুরইছড়ার কাছে একটি হাওড়ে এসে পৌছান ।
সকলেই রওয়ানা হয়েছিলেন অবিরাম বৃষ্টির মধ্যে আক্রমন করার উদ্দ্যেশ্যে ভারতের টিলা বাজার ক্যাম্প থেকে মুরইছড়া’র পাকিস্তানীদের ক্যম্পের দুরত্ব ছিল মাত্র তিন মাইল ।
দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পরিশ্রান্ত দেহে ছনক্ষেতের উঁচু ঢিপির পিছনে নিজেদেরকে লুকিয়ে রেখে ঘন্টাখানেক বিশ্রাম করে নেন সকল সদস্য ।তার পর ধীরে ধীরে রাত বাড়তে থাকলে রাত আনুমানিক আড়াইটা থেকে তিনটার দিকে মুক্তি যোদ্ধারা পাকিস্তানী ক্যাম্প লক্ষ্য করে কিছু গুলি ছুঁড়ে এবং সকলেই স্বীয় অবস্তানে থেকে পজেশান নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে ।অতঃপর ১৫-২০ মিঃ পর পাক হানাদারেরা তাদের ক্যাম্প থেকে নিজেদের অবস্তান বোঝাতে গিয়ে পাল্টা গুলি ছোড়ে ,ক্ষনিক পরে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সাহসী দল সামনে এগিয়ে ক্যাম্পের কাছাকাছি নিজেদের অবস্তান শক্ত করতে সচেষ্ট হয় , মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্তান উপস্থিতি টের পেয়ে ক্যাম্পের পাকিস্তানী সেনারা কৌশলে ডানে বামে এগিয়ে গিয়ে তাদের ঘিরে ফেলে , তাৎক্ষনিকভাবে বিপদ উপলব্ধি করতে পেরে মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত সংকেত পাঠায় তাদের অপেক্ষমান দলের কাছে , বিপদ সংকেত পেয়ে তৎক্ষনাৎ দ্রুত এগিয়ে এসে ভারতীয় ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে অপেক্ষমান দলটি অতর্কিত আক্রমন করে পাকিস্তানী সেনাদের উপর ,হটাৎ এমন আক্রমনে হতভম্ব হয়ে দিশেহারা হয়ে পরে পিছু হটে পাকিস্তানীরা ,তাদের বেশ কয়েকজন আহত হয় ।সেদিন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায় একদল মুক্তিসেনা ।সংগত কারনেই ইতিহাসের অগ্নিস্বাক্ষী হয়ে আছে কুলাউড়ার এই দুর্গম সীমান্তঘেরা পাহাড়ীয়া এলাকা “ মুরইছড়া “ , সকলেই এই মুরইছড়া ইকোপার্কে বেড়াতে আসেন , উপভোগ করেন প্রাকৃতিক সৌন্দের্যের লীলাভুমি , তবে এদের জানা উচিত এই এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘটনা সমুহ ।
কর্মধা ইউনিয়নের আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য , যেমন
১) আবু মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ , পিতা মোঃ আব্দুস সাত্তার , গ্রাম ভাতাইয়া , তিনি স্থানীয় শ্রমিক ও যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করার জন্য প্ররোচিত করেন ।তার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নং হলো ০৫০৪০৪০৫৩৪।
২)মকবুল আলী , পিতা আরজদ আলী , গ্রাম ভাতাইয়া , তিনি স্থানীয় শ্রমিক ও যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করার জন্য প্ররোচিত করেন ।তার মতে আমরা দেশকে রাহুমুক্ত করেছি এটা আমাদের সান্তনা ।তিনি বিশ্বাস করেন নতুন প্রজন্ম এদেশকে উন্নতির শিখরে এগিয়ে নিয়ে যাবে ।তার মুক্তি নং ০৫০৪০৪০৪৩৯।
৩) মোঃ আবুল মান্নান , পিতা আব্দুস সমদ , গ্রাম কর্মধা , মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্তি নং :- ০৫০৪০৪০৪৪০।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের দরুন রাজাকারেরা মান্নানের পরিবারের
ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে ।
৪) সনাতন সিংহ , পিতা বাবু ছানা সিংহ , গ্রাম নলডরি , মুক্তিযোদ্ধা অন্তর্ভুক্তি নং :- ০৫০৪০৪০৪৪৮ ।
তার ভাষ্যে পাকিস্তানীরা এই এলাকায় এসেই আমাদের সম্প্রদায়ের বাড়ীঘরের উপর হামলা চালায় , আমরা পাক সেনাদের আসার আগেই সপরিবারে ভারতে চলে যাই , সেখানে যুদ্ধের ট্রেনিংপ্রাপ্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বিভিন্ন অপারেশানে অংশগ্রহন করি , বহুবার মৃত্যুর মুখামুখি হয়েছি ।মৃত্যুর চেয়ে দেশের স্বাধীনতা আমাদের কাছে বড় ছিল ।
৫) রাম সুন্দর গোপাল , পিতা -রাম জনম গোপাল , বাড়ী ঃ- রাঙ্গিছড়া চা বাগানে তিনিও মুক্তি যুদ্ধে অনবদ্য ভুমিকা রাখেন ।তার মুক্তি যোদ্ধা নং ০৫০৪০৪০৪৫০
৬) গানেশ রুহি দাশ , পিতা -শুকুয়া রুহি দাস , বাড়ী ঃ- কালুটি চা বাগানে তিনিও মুক্তি যুদ্ধে অনবদ্য ভুমিকা রাখেন ।তার মুক্তিযোদ্ধা নং ০৫০৪০৪০৪৫১।
এই কয়জন ছাড়াও অনেকের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে যা আগামীতে ব্যাপক ভাবে আলোচনা করার ইচ্ছা রাখি ।
সেই ইউনিয়নের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অনেকে মধ্যে একজন সহায়তাকারী মহান ব্যক্তির কথা বিশেষভাবে মনে হচছে ,তিনি হচ্ছেন ঐ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান , যিনি হলেন হোসনাবাদ গ্রামের জনাব ইয়াকুব আলী , যিনি ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যনের দায়িত্ব পালন করেন , পরবর্তীতে তার ছেলে আব্দুস শহীদ বাবুল ও দীর্ঘদিন এই কর্মধা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেন ।এবং কুলাউড়াতে এই মহান ব্যক্তির নামে “ইয়াকুব তাজুল মহিলা মহাবিদ্যালয়” নামে একটি বেসরকারী কলেজ ও পরিচালিত হচ্ছে ।
হিন্দু মুসলমান সহ চা বাগান ও সীমান্তঘেরা পাহাড়ীয়া এলাকা এবং চা শ্রমিক ও স্বল্প সংখ্যক উপজাতীয় দের সহাবস্থান সমন্নয়ে এই এলাকার গুরুত্ব অনেক বেশী ।
কর্মধা ইউনিয়ন ভুক্ত গ্রাম ও এলাকার মধ্যে বিশেষভাবে
কর্মধা, মলডরী, টাট্টীউলী,মনসুরপুর,মুরইউড়া, পাট্টাই,বুধপাশা, হাসিমপুর,ফটিগুলি,ভাতাইয়া,
রাঙ্গীছড়া,কাটাপুন্জি, ঝীমাই ,লম্বাছড়া,মনছড়া,এওলাছড়া,দোয়ালগ্রাম, কুকিজুরুী,মৈশামারী,নুনা,বরুয়াকান্দি,ভান্ডারীগাও,গুতুমপুর,মহিষমারা,রুষনাবাদ,উগারছড়া,মেঘাটিলা,কালিটি,লক্ষীপুর ,
আসগরাবাদ, কাটাবাড়ী ইত্যাদি পাহাড়ীয়া এলাকার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।
অনেক অনেক স্মৃতি ময় কুলাউড়ার সেই ৭১ এর কথা সরাসরী সম্পৃক্ত কেউই কখনও ভুলতে পারবে বলে আমার মনে হয় তবুও নতুন প্রজন্মের কাছে সেই সংগৃহীত কিছু স্মৃতি ও গুটি কয়েক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তির তথ্য তুলে ধরে কিছুটা আনন্দ এবং স্বস্তি ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি ।
এ পর্বটি তৈরীতে তথ্য সংগ্রহের জন্য বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই ‘মুক্তিযুদ্ধে কুলাউড়া’ বইটির লেখক জনাব মোহাম্মদ ওয়াহিদ মুরাদকে ।( চলবে )
৭১ এর স্মৃতি – ( ১৫ )
সৈয়দ শাকিল আহাদ
স্মৃতি কখনও মুছে ফেলা যায় না , তবে ভুলে থাকা যায় ,
৫১ বছর আগের কথা , মুক্তিযোদ্ধাদের কথা , যুদ্ধ চলাকালিন সহযোদ্ধাদের কথা , বীরাঙ্গনাদের কথা , শহীদদের কথা ও হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের স্বরন করার মাঝে হয়তো কারো কারো মনে হবে , হতেই পারে যে আমি অযথাই সময় নষ্ট করছি
আসলে কি লাভ ৭১ সালের দোকান পাঠ বা রাস্তাঘাট কিম্বা বাড়ীঘরের কথা মনে করে ? তাৎক্ষনিক ভাবে লাভ ক্ষতির হিসাব না মিললেও আমার বিশ্বাস এক সময় এই লেখা পড়ার জন্য মানুষ হন্য হয়ে ঘুরবে , যার গন্ধ আমি এখনই পাচ্ছি , এমন কি অনেকেই পুরোনো আপনজনের কথা এখানে জানতে পেরে আবেগে আপ্লুত হচ্ছেন ।
বলছিলাম কুলাউড়ার কথা , সংযুক্ত ছবিটির কথা , ছবিটি আমার বন্ধু লিটনের মাধ্যমে প্রাপ্ত , প্রচন্ড মেধা সমপন্ন ও তুখোর স্মৃতিতে ভরপুর আমেরিকা প্রবাসী লিটনের কাছে আমি ঋণী , লিটনকে সবাই ডাকবাংলোর লিটন বলেই চিনে , ডাকবাংলোর পাশেই তার বাসা ছিল , সে একজন ফুটবল খেলোয়ার ও সংগঠক , কুলাউড়ার প্রাচীনতম সংগঠন “ জাতীয় তরুন সংঘ” এর সে সাধারন সম্পাদক ছিল বহুদিন ,ইন্টারনেটের কল্যানে বিশেষ করে এই কোভিড দুর্যোগ কালিন সময়ে প্রায়ই ভোরবেলায় ফজরের নামাজের পর যখন মেসেন্জারে দেখতাম ওর নামের পাশে সবুজ বাতিটি জ্বলছে , সাথে সাথেই কল দিয়ে বসতাম এবং কুলাউড়ার নানা বিষয়ে কথা বলতাম ,এই লিটনের উৎসাহে ই আমি আরও একটি তথ্যবহুল ও পর্যটন সহায়ক গ্রন্থ
“ হাওরে পাহাড়ে কুলাউড়া” সম্পাদন করে ফেলেছি ।
যা এখন প্রকাশের অপেক্ষায় আছে ,এবং এই গ্রুপে যে লেখাটি ক্রমাগত যাচ্ছে “৭১ এর স্মৃতি “ নামে , সেটি লিখতে গিয়েও ,বেশ কয়েকটি পর্বের অনেক গুরুত্ববহ তথ্য লিটনের মারফতে পেয়েছি , যেমন এই পর্বের সংযুক্ত ছবিটাও তার দেওয়া এবং এই ছবিটির জন্যই পর্বটা সম্বৃদ্ধ হয়েছে , যার ফলে
ছবির ব্যক্তি তিনজনের মুক্তিযুদ্ধের অবদানের কথা উঠে এসেছে ।
ছবিটিতে তিনজন ধ্রুব তারা কে আমরা দেখতে পাচ্ছি , তিন জনই ছিলেন তখন অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ের ৭১ সালের রিয়েল হিরো ,
আর কেঊ যদি একবার হিরো হয় তো আজীবন তার নামের পাশে হিরোযুক্ত হয়ে থাকে ।
১) বামদিক থেকে শুরু করে প্রথমজন হচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠক মোঃ আব্দুল লতিফ খান ,
জন্মগ্রহন করেন ও বড় হয়েছেন বরমচাল ইউনিয়নের নন্দগ্রামের খান বাড়িতে , পড়ালেখা শেষ করে কর্মজীবনের শুরুটা ছিল পাকিস্তান আর্মিতে ,কিছুদিন চাকরী করার পর তিনি চাকরী ছেড়ে নিজ গ্রামে এসে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন এবং জনকল্যানে নিজেকে নিয়োগ করেন এবং কুলাউড়ার সম সাময়িক সংগঠকদের নিয়ে দেশ মাতৃকার প্রয়োজনে মুক্তি যুদ্ধে সক্রিয় হন ।
৭১ এর ২৬ শে মার্চের পর থেকেই চলতে থাকে জনগনের ভারত যাত্রা , হাজার হাজার লোক , বিভিন্ন শ্রেনীপেশার নারীপুরুষ , শিশু, কিশোর ,যুবক, যুবতীসহ ,আবাল- বৃদ্ধ ,সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের আগরতলা , কুকিতল , কৈলাশহর , ধর্মনগরের শরনার্থী শিবিরে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছিল ,দেশকে শত্রুমুক্ত করতে
তখন আগ্রহী যুবকদেরকে কিছু অবসর প্রাপ্ত পুলিশ , আনসার ও সামরিক বাহিনীর লোকদের সম্ননয়ে অশ্রচালনা ও যুদ্ধকৌশল প্রশিক্ষনের ব্যবস্তা করা হয়েছিল সেই প্রশিক্ষন ক্যাম্পের নির্দেশকের দায়িত্ব পালন করেন আব্দুল লতিফ খান , পাক মিলিটারীরা কুলাউড়া আসলে পরে তিনি ভারতের ধর্মনগরে চলে যান এবং সেখান থেকে বিভিন্ন অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দেন ।, তিনি ১৯৭৭ ইং থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত কুলাউড়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ।
আব্দুল লতিফ খান প্রথম ১৯৬৫ সালে বরমচাল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং জনকল্যানে নিরলস ভাবে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন ।স্বাধীনতার পরও ১৯৮৪ সাল হইতে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত পর পর দুই দফায় তিনি বরমচাল ইউনিয়নের সফল চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন ।
২) ছবিটিতে ২য় জন হলেন মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠক জয়নাল আবেদিন ।তিনি জন্মগ্রহন করেন সিলেট অন্চলের বিয়ানী বাজারে , তিনিও অন্যান্যদের সাথে ঐপারে শরনার্থী শিবিরে মিলিত হয়ে পাশেই প্রশিক্ষন ক্যাম্পে মুকতিকামীদের প্রশিক্ষিত করে এদেশে এসে মুক্তি বাহিনীর সাথে যোগ দিয়ে বিভিন্ন অপারেশনের সফল নেত্রৃত্ব দানের মাধ্যমে নিজের দেশকে শক্রুমুক্ত করতে সচেষ্ট হোন , তিনি দীর্ঘদিন কুলাউড়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন । তাছাড়াও জয়নাল আবেদিন ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী , ষ্টার এজেন্সীর মালিক ।
৩) ৩য় জন হলেন জুবেদ মামা বা আব্দুল মুক্তাদির চৌধুরী , যিনি ছিলেন কুলাউড়ার স্বাধীনতা সংগ্রামী সংগঠকদের অন্যতম , মুক্তি যোদ্ধাদের সংগঠিত ও প্রশিক্ষন কালে তিনি ভারতের কৈলাশটিলা ও ধর্মনগরে অবস্তান করেন , রাজা সাহেব , জব্বার মামা , সৈয়দ জামালসহ অন্যান্য নেতাদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন, সংগঠিত করতেন মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ,কিভাবে কুলাউড়াকে শত্রু মুক্ত করা যায় তার পরিকল্পনা করতেন ,যুদ্ধের সময়কার সংগ্রামী একজন অগ্রনায়ক ছিলেন এই মুকতাদির চৌধুরী বা জুবেদ মামা ,তিনি কৌলার কানিহাটী চৌধুরী বাড়ীর সন্তান ,
এমনি অনেক মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের নিয়ে আগামীতে আরো লেখার আশা রাখি । ( চলবে )
“কালা পাহাড় “
সৈয়দ শাকিল আহাদ
সিলেটের পাহাড় নিয়ে অনেক দিন যাবত ভাবছি কিছু একটা লিখবো , কিন্তু শুরুটা কখন কিভাবে করবো ভাবতে ভাবতে অনেক সময় পেরিয়ে গেছে ,
১৯৩৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচিত্র সাপুড়ে তে কাননদেবীর কন্ঠে গাওয়া বিখ্যাত নজরুল গীতি “ আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ ..
ছোটবেলায় আমাদের হয়বতনগর দেওয়ানবাড়িতে একটি গ্রামোফোন ছিল , সবাই মিলে বিশেষ করে আমার চাচা সৈয়দ আব্দুল হাদী ওরফে মন্জুর মিয়া যখন আমাদের সবাই কে ডেকে এনে রেকর্ডে বাজিয়ে গান শুনাতেন তখন ঐ গানটি একটু বেশিই শুনতাম ,শুনতে শুনতে বড় হয়েছি আর ভেবেছি পাহাড় আবার ঘুমায় কিভাবে , যদি সুযোগ পাই তবে দেখবো সেই ঘুমের দৃশ্য .. আবার অন্য আর এক গান ছিল এ রকম ,,
রিমঝিম রিমঝিম বৃষ্টি পড়ে ,
খাসিয়ারা বাঁশি বাজায় ঐ পাহাড়ে ..
এই মধুক্ষনে প্রিয়া তোমায় মনে পড়ে … হো হো হো… প্রিয় বন্ধু কামরুন নুর চৌধুরীর এই গানটি যতবার শুনেছি মনটা ছুটে গিয়েছে পাহাড়ে , তাও আবার কুলাউড়া অন্চলের কর্মধা ইউনিয়নের ঐতিহাসিক “কালা পাহাড়ে “
যাকে কুলাউড়ার পাহাড় ও বলে থাকেন কেউ কেউ ।
কুলাউড়া পাহাড় বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের বেগুণছড়া পুঞ্জিতে অবস্থিত একটি পাহাড় যাহার উচ্চতা ১০৯৮ ফুট। কালাপাহাড় সিলেট বিভাগের সর্বোচ্চ পাহাড়চূড়া। এটা মূলত খাসিয়াদের গ্রাম। খাসিয়ারা গ্রামকে “পুঞ্জি” বলে। এর এক পাশে কুলাউড়া, অন্য পাশে জুড়ি উপজেলা ও ভারত সীমান্ত। এখানে আরো অনেক পুঞ্জি আছে। তাছাড়া এখানে ছোট বড় আরো বেশ অনেকগুলো পাহাড় আছে। আরো আছে চা বাগান সহ ছোট ছোট পরিষ্কার পানির ছড়া।
এই পাহাড়ের উচ্চতা সর্বোচ্চ বিন্দু এক হাজার ৯৮ ফুট (সমুদ্র স্তর থেকে) পরিমাপ করা হয় । কালাপাহাড়কে স্থানীয় ভাষায় লংলা পাহাড় নামে ডাকা হয়।
বাংলাদেশ জিওগ্রাফিক সোসাইটির মতে, কালাপাহাড়টি ‘হারারগঞ্জ পাহাড়’ নামেও পরিচিত। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় অবস্থান করা এই পাহাড়ের ৬০ শতাংশ বাংলাদেশে পড়েছে এবং বাকি অংশ ভারতের উত্তর ত্রিপুরায় অবস্থিত।
ত্রিপুরায় এই পাহাড়টির বাকি অংশের রঘুনন্দন পাহাড় । ভারতের বিখ্যাত প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক ধর্মীয় স্থান ঊনকোটি এই পাহাড়টির পাদদেশে অবস্থিত। উল্লেখ্য যে কালাপাহাড়ের সর্বোচ্চ বিন্দু থেকে হাকালুকি হাওরের নীল পানি দেখা যায়।
এখানে বলে রাখা ভাল সিলেট জেলার উত্তরে খাসিয়া ও জয়ন্তিয়া পাহাড় বিদ্যমান আছে আর সিলেট জেলায় অনেক গুলো ছোট বড় পাহাড় রয়েছে যার মধ্যে নিম্নলিখিত পাহাড় গুলোর কথা
না বললেই নয় ,
১) পল্ডহরের বা সরষপুরের পাহাড় : – এই পাহাড়টি সিলেট জেলার পুর্ব দিকে সিলেট ও ভারতের কাছাড় জেলার মধ্যে অবস্থিত ।
এই পাহাড়টি উত্তর দক্ষিনে প্রায় ৫০ মাইল লম্বা আর প্রস্তে কোন কোন জায়গায় ১২-১৩ মাইল ।এর পুর্বদিকে ভারতের কাছার জেলা , পশ্চিমে পল্ ডহর , এগারসতী ও চাপঘাট পরগনা ইহার উচ্চ স্হান বা শৃঙ্গ ২০৩০ ফিট ।
২) দু আলিয়া বা প্রতাপগরের পাহাড়:-প্রতাপগড় পরগনার মধ্যে , উত্তরে ও দক্ষিনে প্রায় ৩০ মাইল , এই পাহাড়টি পল্ডহরের প্রায় পাঁচ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত এর উচ্চতা সর্ব্বোচ্চ ১৫০০ ফিট ।
৩) আদম আইল বা পাথারিয়া পাহাড় :- এই পাহাড়টি দুআলিয়া পাহাড়ের কয়েক মাইল পশ্চিমে , উত্তর দক্ষিনে লম্বায় প্রায় ২৮,মাইল প্রস্তে কমপক্ষে ৭-৮ মাইল ।পুর্বে প্রতাপগড়, জফরগড় ও রবিনগর পরগণা আর পশ্চিমে পাথারিয়া ও শাহবাজপুর ।সর্বোচ্চ চুড়া ৮০০ ফিট উপরে , মাধবকুন্ড নামের জলপ্রপাত এই পাহাড়ের এক কোনে অবস্থিত ।
৫) আদমপুরের পাহাড় : লংলা পাহাড়ের দক্ষিন পশ্চিমদিকে উত্তরে দক্ষিনে প্রায় ২৩ মাইল লম্বা এই পাহাড়ের পুর্বদিকে আদমপুরে ইটা ও পশ্চিমে চোয়ালিশ , এই পাহাড় লংলা পাহাড় হতে প্রায় পাঁচ মাইল দক্ষিন পশ্চিমে অবস্থিত । এর উচ্চতা ৬০০ ফিট ।
৬) বড়শী যোড়া বা বালিশিরার পাহাড় : এই পাহাড়টি আদমপুর পাহাড়ের দক্ষিন পশ্চিমে , এর দৈর্ঘ ২২ মাইল আর প্রস্ত ৪ মাইল এর পুর্বদিকে ভানুগাছ ও ছয়চিরি পরগণা পশ্চিমে বালিশিরা ও চুয়ালিশ এই পাহাড়ের উঁচু টিলার নাম চুড়ামনি টিলা যার উচ্চতা সমতল ভুমি হইতে ৭০০ ফিট ।
এই পাহাড়ের পাশ ঘিরে অনেক চা বাগান রয়েছে ।
৭) সাত গাঁও বা বিষ গাওয়ের পাহাড় :~ এই পাহাড়টি বালিশিরার পাহাড় হইতে ৮ মাইল পশ্চিম দিকে অবস্থিত , লম্বায় ২২ মাইল সর্ব্বোচ্চ উচ্চতা ৭০০ ফিট ।এই পাহাড়ের পুর্বদিকে বালিশিরা সাতগাঁও ও পচাউন প্রভৃতি পরগণা ও পশ্চিমে তরফ ফৈজাবাদ ইত্যাদি পরগণা বিদ্যমান ।
৮) রঘুনন্দন পাহাড় :~ এই পাহাড়টি বৃহত্তর সিলেট জেলার দক্ষিন পশ্চিম দিকে অবস্থিত এটি বিষগাও পাহাড় থেকে প্রায় ১৬ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত ।উচ্চতা ৭০০ ফিট ।
উপআলোচিত পাহাড় ছাড়াও আরো অনেক ছোট বড় পাহাড় , টিলা এই সিলেট বিভাগকে প্রাকৃতিক নৈস্বর্গীক সৌন্দর্যে সম্বৃদ্ধ করে রেখেছে , যেমন ইটার পাহাড়, লাইড়ের পাহাড় , মিনারের টিলা , দেউলির টিলা , ইত্যাদি ।
পাহাড়ের সৌন্দর্য আমাদের সিলেট এর অহংকার এবং পর্যটক দের কে আরো বেশি আকৃষ্ট করে থাকে ।
সিলেট কে সকলেই পীর ফকির অলী আওলীয়াদের বিচরনে বিশেষ করে বাবা হযরত শাহজালাল ( রঃ) এবং উনার সাথী ৩৬০ আওলিয়ার পুণ্যভুমি হিসাবে পবিত্রতার সাথে চিন্হিত হয়ে আসছে ।
( তথ্য কৃতজ্ঞতায় :~ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত – অচ্যুতচরন চৌধুরী)
৭১ এর স্মৃতি – পর্ব -৩৩ ( চাতলাপুর )
—- সৈয়দ শাকিল আহাদ
কানিহাটি পরগনার ১৯ টি মৌজা নিয়ে ৭৬৯২ একর জমি পরিবেষ্টিত একটি অন্যতম ইউনিয়ন হলো শরীফপুর , যা কুলাউড়ার অন্য ইউনিয়ন সমুহের চেয়ে একটু ভিন্ন , এই শরীফপুর ইউনিয়নের অনেকগুলো গ্রামের মধ্য অন্যতম একটি প্রসিদ্ধ এলাকা হচ্ছে “ চাতলাপুর “ ,
কুলাউড়ার দক্ষিনপুর্বদিকে চাতলাপুরে একটি চা বাগান রয়েছে । এই চা বাগান সম্বৃদ্ধ পাহাড়িয়া এলাকাটি ভারতীয় সীমান্তবর্তী এই ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত সবুজে ঘেরা একটি স্থলবন্দরযুক্ত সুন্দর নয়নাভিরাম এলাকা ।
১৯৬৫ ইং থেকে দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত সময়ে এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন সন্জরপুর গ্রামের “ নৌসা মিয়া “.
এই ইউনিয়নের অন্যান্য গ্রামগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ,চুয়াল্লিশপাট্টা,তিলকপুর,পালকিছড়া,দত্তগ্রাম,নিশ্চিন্তপুর,মাদানগর,দাউদপুর(সোনাপুর),হরিপুর,খিদিরপুর,মানগাও,মনোহরপুর,ইটারঘাট,চরিয়ারঘাট,কালবৈয়ারচর,তেলিবিল,চান্দপুর,পুর্বভাগ,সংগ্রামসিং,লালারচক,সন্জবপুর,বাগজুরা,নসিরগন্জ,বেরিগাও এবং শরীফপুর উল্লেখযোগ্য …
এই শরীফপুরের পুর্বভাগে বিশিষ্ট দরবেশ “ হাজী খা” এবং দত্তগ্রামে “ দেওয়ান শাহ “ এর মাজার রয়েছে ।
১৯৭১ সালে ভারত সীমান্তবর্তী এই গ্রামের উপর বয়ে যাওয়া অবাঞ্ছিত ঘটনা , রক্তপাত ,বিভিষীকাময় আতংকের বর্ননা ও ভয়াবহ পরিস্থিতি যারা মোকাবিলা করেছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে দুএকটি ঘটনা উল্লেখ না করে পারছি না ,
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এই চাতলাপুরের বি.ও.পি ক্যাম্প নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে অবস্তান নেয় ।
উল্লেখ্য যে চাতলাপুরের বিপরিতে ভারতীয় অংশে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্রশিক্ষন শিবির বা ক্যাম্প ছিল , দুই ভুখন্ডের দুইটি ক্যাম্প কাছাকাছি থাকাতে দুইটি ক্যাম্পের সকলকেই নির্ঘুম ,তটস্থ ও আতংকিত থাকতে হতো সর্বদা ,যে কোন সময় যে কোন পরীস্থিতি মোকাবেলার জন্য । তখন ভারতীয় ভুখন্ডের ক্যাম্প দুই দিক থেকে দুইটি দলে বিভক্ত হয়ে ১৩ জন করে সদস্যসম্বলিত দলে বিভক্ত হয়ে ক্যাম্পের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকতে শোনা যায় , যার এফ এফ দলের নেত্বৃত্বে ছিলেন সৈয়দ মখলিছুর রহমান আর অন্যদিকে ১৩ জন সদস্যের এম এফ দলের নেত্বৃত্বে ছিলেন ই পি আরের অন্যতম সদস্য জনাব আবুল কাশেম যারা ।
আলীনগর বিএপির ক্যাম্পের নিকটবর্তীএকটি বাড়ীর জনৈক উস্তার আলীর দেওয়া তথ্যমতে,তার পিতা আব্দাল মিয়া ও ভাই মাসুক মিয়ার হত্যাকালীন বর্ননা রীতিমত লোমহর্ষক ।
আলীনগর বিওপি ক্যাম্পে দুইজন পান্জাবী ই পি আর সদস্যকে দুইজন বাঙ্গালী ইপি আর সদস্য হত্যা করে পালিয়ে গিয়ে মুক্তি বাহিনীতে যোগ দেয় ।
পরবর্তীতে পাক হানাদারদের নিয়ে চারটি জীপে করে স্থানীয় স্বাধীনতা বিরোধীচক্রের সহযোগীতায় তাদের মধ্যে পৃথিমপাশার ছতু মিয়া এবং খালিক মিয়া , পাস্ববর্তী ধলিয়া গ্রামের মনির এবং গলই ও তাদের পিতা ওয়াহিদ মিয়া সহ আরো কয়েকজন মিলে ক্যাম্প দখল করে নেয় ।
উস্তার আলীর মতে সেদিন পাক বাহিনীর সদস্যরা এসে উর্দুভাষায় জানতে চায় ,পান্জাবী বিওপি সদস্যদের কে কে হত্যা করেছে ?
সেই মুহুর্তে স্বাধীনতা বিরোধী পাক দোসরেরা আমার ভাই মাসুককে জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে বলে আমাদের বাড়ী দেখিয়ে দেয় , মাসুক তখন বাবুর্চীর সহযোগী হিসাবে ক্যাম্পে কাজ করতো ।
ওদের কথামত পাকিস্তানী হানাদারেরা আমাদের বাড়ী ঘেরাও করে আমার বাবা আব্দাল মিয়া ওরফে আব্দুল জব্বার এবং ভাই মাসই মিয়া ওরফে মাসুক কে ধরে হাত পা বেধে ক্যাম্পে নিয়ে বেধরক পিটাতে থাকে , বন্দুকের বাট দিয়ে মারতে থাকে আর জানতে চায় কে তাদের লোককে মেরেছে তাদের আর্তচিৎকার ও চেটামেচিতে গগন বিদির্ন হয় ।অসহ্য যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতে আমার ভাই বলছিল “আমি জানিনা ,আমি সন্ধার আগে কাজ শেষ করে বাড়ি চলেগিয়েছি “ কিন্তু পাকিরা আমার ভাইয়ের কথায় কর্নপাত করেনি ,আরো জোরে লাথি গুতা মারতে থাকে , তাদের কে লুকলুকি গাছের সাথে বেঁধে অমানুষিক নির্যাতন করে মেজর মোঘলের নির্দেশে গুলি করে নির্মম ভাবে হত্যা করে ,সেদিন গ্রামের আরো অনেককে ধরে এনে সারি বেধে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হ্ত্যা করেছিল ।
উল্লেখ্য সেদিন সবাইকে লাইন ধরে দাঁড় করানোর পর লাইন থেকে আমাদের গ্রামের শক্ত সামর্থ মফিজ মাস্টার , গনি মিয়া , ও ওয়াব আলীকে দিয়ে ক্যাম্পের উত্তর পাশ্বে গর্ত করিয়ে সেই গর্তে মৃতদের মাটি চাপা দেয় ,সেদিন গর্তে মাটিচাপা দেবার সময় আমার বাবা শহীদ আব্দাল মিয়ার মৃতু হয়নি , অজ্ঞান অবস্তায় তখন তিনি পানি খেতে চেয়েছিলেন , যারা গর্তে মৃতদেহ ফেলছিল তাদের ইচ্ছা ছিল আমার বাবার নাক উপরে থাকুক যাতে তিনি স্বাসপ্রস্বাস নিতে পারেন , তখন এক বন্দুকধারী বিষয়টি অর্থাৎ আব্বা জীবিত উপলব্ধি করে তাৎক্ষনিক ভাবে তার হাতে থাকা বন্দুক থেকে গুলি করে আব্বার মৃত্যু নিশ্চিত করে ।
চোখের সামনে ভাই ও বাবাকে হারানোর দু:খ উস্তার মিয়া কখনওই ভুলবে না আর তাকে শান্তনা দেবার ভাষাও আমাদের নেই ।
তবে এই ইউনিয়নের পল্কি সেতু ধ্বংস করার মাধ্যমে পাক সেনাদের প্রতিহত করার সত্য ঘটনা সহ বেশ কিছু ঘটনা অন্য আর একটি পর্বে আলোচনা করার ইচ্ছা রয়েছে ।অনেক মুক্তিযোদ্ধা সরাসরি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন যাদের অবদান চির স্বরনীয় , তাদের কয়েক জনের নাম উল্লেখ না করে পারছি না ,যেমন :-
ক) মুরল বাউরি , পিতা :~ কালা বাউরি , গ্রাম :-৪৪ পাট্টা , মুক্তি নং ০৫০৪০৪০০০৬ ইউ:- শরীফপুর।
খ) দুলভ মিয়া ,পিতা :~ ওয়াহিদ আলী , গ্রাম :-চানপুর , মুক্তি নং ০৫০৪০৪০০০৭ ইউ:- শরীফপুর।
গ) আরশদ আলী পিতা :~ আরজু মিয়া , গ্রাম :-সনজবপুর, মুক্তি নং ০৫০৪০৪০০০৮ ইউ:- শরীফপুর।
ধ) মো: আতাউর রহমান পিতা :~ মো: আব্দুর রহিম , গ্রাম :-মানগাও , মুক্তি নং ০৫০৪০৪০০০৯ ইউ:- শরীফপুর।
এই আলোচনায় অনেক বেশী অবদান রাখার জন্য যে সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান নিয়ে কথা বলার ইচ্ছা ছিল যা স্বল্প পরিসরে আলোচনা করা বাতুলতা মাত্র , কৃর্তিমানদের আত্বত্যাগ এবং তাদের অবদান অপরিসীম যা অনস্বীকার্য।(চলবে)
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।