স্টাফ রিপোর্টার।। কুলাউড়ার দর্পণ
তখন আষাঢ় মাসের বিকেল। মৌলভীবাজার-শমসেরনগর সড়কের কালো পিচ কোথাও বৃষ্টির পানিতে ভিজে আছে, কোথাও ঝকঝকে ধুলা উড়ছে। বোঝা যায়, বৃষ্টি ঝরাটা সমানতালে ছিল না। এ সড়কের কাছারিবাজার থেকে পশ্চিমের দিকে একটি আধা পাকা সড়ক চলে গেছে। ওই পথ গেছে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার হামিদিয়া চা-বাগানের দিকে।
গত শুক্রবার বিকেলে সেই পথে চলতে চলতে দেখা হয়ে যায় একটি গাছের সঙ্গে। টিলার মতো স্থানে গাছটির লতার শরীর ছড়ানো। তবে নামে গাছ হলেও দেখতে অন্য সব গাছের মতো নয়। না আছে ঊর্ধ্বমুখী কাণ্ড, না আছে শাখা-প্রশাখা। গোড়া থেকে বড় রশির মতো বিশাল সব লতা কাছের আম, কাঁঠাল, বটগাছকে আশ্রয় করে ঝুলে আছে, জড়িয়ে আছে। লতার মতো হলেও এটিকে সবাই গাছই জেনে এসেছেন। সেভাবেই সংরক্ষণ করে চলেছেন। কবে কোন শতকে এখানে গাছটি জন্ম নিয়েছিল, কেউ জানেন না। গাছটি এখন লোক-ইতিহাসের একটি অংশ।
গাছটি আছে হামিদিয়া চা-বাগানের ছালামিটিলা এলাকায়। ওখানে ‘হজরত শাহ গাজী (র.) মোকাম’ আছে। এই মোকামেরও অনেক বয়স। মোকাম এলাকায় আরও কিছু গাছ আছে। সেগুলোর অনেকগুলোর বয়স তার কাছাকাছিই হতে পারে। তবে এটি অন্য গাছের থেকে আলাদা। অন্য গাছের মতো খাড়া হয়ে ওপরের দিকে মাথা তোলেনি। গাছটির শিকড় যেখানে, তা কেউ দেখিয়ে না দিলে অনুমান করা কঠিন। একটি বটগাছের কাছে গোড়া। সেখান থেকে লতার মতো বেয়ে বেয়ে অন্য সব গাছের দিকে গেছে। সেই স্থান থেকে অজগরের মতো শরীরকে লতিয়ে টেনে বটগাছ, পাশের বিভিন্ন আম ও কাঁঠালগাছে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। লতার মতো গাছের শরীর এমনভাবেই ছড়ানো, ঝুলে আছে।
ফলো করুন
অনেক অনেক বছর ধরে মানুষ আর গাছটিতে কোনো কাটাছেঁড়া করেন না, ক্ষত তৈরি করেন না
অনেক অনেক বছর ধরে মানুষ আর গাছটিতে কোনো কাটাছেঁড়া করেন না, ক্ষত তৈরি করেন নাছবি: প্রথম আলো
তখন আষাঢ় মাসের বিকেল। মৌলভীবাজার-শমসেরনগর সড়কের কালো পিচ কোথাও বৃষ্টির পানিতে ভিজে আছে, কোথাও ঝকঝকে ধুলা উড়ছে। বোঝা যায়, বৃষ্টি ঝরাটা সমানতালে ছিল না। এ সড়কের কাছারিবাজার থেকে পশ্চিমের দিকে একটি আধা পাকা সড়ক চলে গেছে। ওই পথ গেছে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার হামিদিয়া চা-বাগানের দিকে।
গত শুক্রবার বিকেলে সেই পথে চলতে চলতে দেখা হয়ে যায় একটি গাছের সঙ্গে। টিলার মতো স্থানে গাছটির লতার শরীর ছড়ানো। তবে নামে গাছ হলেও দেখতে অন্য সব গাছের মতো নয়। না আছে ঊর্ধ্বমুখী কাণ্ড, না আছে শাখা-প্রশাখা। গোড়া থেকে বড় রশির মতো বিশাল সব লতা কাছের আম, কাঁঠাল, বটগাছকে আশ্রয় করে ঝুলে আছে, জড়িয়ে আছে। লতার মতো হলেও এটিকে সবাই গাছই জেনে এসেছেন। সেভাবেই সংরক্ষণ করে চলেছেন। কবে কোন শতকে এখানে গাছটি জন্ম নিয়েছিল, কেউ জানেন না। গাছটি এখন লোক-ইতিহাসের একটি অংশ।
গোড়া থেকে বড় রশির মতো বিশাল সব লতা কাছের আম-কাঁঠাল, বটগাছকে আশ্রয় করে ঝুলে আছে
গোড়া থেকে বড় রশির মতো বিশাল সব লতা কাছের আম-কাঁঠাল, বটগাছকে আশ্রয় করে ঝুলে আছেছবি: প্রথম আলো
গাছটি আছে হামিদিয়া চা-বাগানের ছালামিটিলা এলাকায়। ওখানে ‘হজরত শাহ গাজী (র.) মোকাম’ আছে। এই মোকামেরও অনেক বয়স। মোকাম এলাকায় আরও কিছু গাছ আছে। সেগুলোর অনেকগুলোর বয়স তার কাছাকাছিই হতে পারে। তবে এটি অন্য গাছের থেকে আলাদা। অন্য গাছের মতো খাড়া হয়ে ওপরের দিকে মাথা তোলেনি। গাছটির শিকড় যেখানে, তা কেউ দেখিয়ে না দিলে অনুমান করা কঠিন। একটি বটগাছের কাছে গোড়া। সেখান থেকে লতার মতো বেয়ে বেয়ে অন্য সব গাছের দিকে গেছে। সেই স্থান থেকে অজগরের মতো শরীরকে লতিয়ে টেনে বটগাছ, পাশের বিভিন্ন আম ও কাঁঠালগাছে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। লতার মতো গাছের শরীর এমনভাবেই ছড়ানো, ঝুলে আছে।
এখন বর্ষা চলছে। সব গাছই কম-বেশি পাতায় সবুজ হয়ে উঠেছে। এই গাছেও একই প্রকৃতি। শরীরের লতানো অংশের কোথাও পাতা নেই। তবে অন্য গাছের সঙ্গে ঝুলে থাকা ডগায় ঝাঁকে ঝাঁকে কিছুটা লম্বাটে, চ্যাপটা অনেক পাতা গজিয়েছে। পাতায় হালকা, গাঢ় সবুজের মায়া লেগে আছে।
দেখা হয় মো. মুহিবুর আলী নামের একজনের সঙ্গে। তিনি বাঁশের তৈরি একটি বেঞ্চে একা বসে ছিলেন। তাঁর বাড়ি ছালামিটিলায়। কথায় কথায় জানা গেল, তিনি একজন পীর-মুরশিদভক্ত মানুষ। পীর-মুরশিদদের সঙ্গে মাজারে মাজারে ঘুরে দিন পার করে দিয়েছেন। জাগতিক মায়ায় আর জড়াননি, ঘরসংসার করেননি। তিনি কবিতা লেখেন। মুখে মুখে দু-একটি কবিতার লাইন, পঙ্ক্তিও শোনালেন। তবে এখন চোখে কম দেখেন, তাই আর নতুন করে কিছু লেখেন না।
কিছু পরই মুহিবুরের সঙ্গে এসে যুক্ত হন পাশের কমলগঞ্জের বড়চেগ গ্রামের বিমল দেব। তিনি বলেন, গাছটির বয়স ৪০০ থেকে ৫০০ বছর বা তারও বেশি হবে। তাঁরা তাঁদের আগের প্রজন্মের কাছে যে লোক-ইতিহাস জেনেছেন, তা–ই শুনিয়ে গেলেন। এখানে ছালামিটিলা বা হামিদিয়া চা-বাগান আগে ছিল না, বনজঙ্গল ছিল। মোকামের পাশেই একটি রাজবাড়ী ছিল। যদিও এখন আর রাজবাড়ীর চিহ্ন নেই। সে রকম একটা সময়ে গাজীকালু ঘুরতে ঘুরতে এই স্থানে এসে আসন গাড়েন, বিশ্রাম নেন। পরে এখানে শাহ গাজীর মোকাম হয়েছে।
প্রচলিত আছে, একসময় গাছটিতে কাটাছেঁড়া করলে রক্তের মতো কষ বের হতো। অনেক অনেক বছর ধরে মানুষ আর গাছটিতে কোনো কাটাছেঁড়া করেন না, ক্ষত তৈরি করেন না। সম্মানের সঙ্গে গাছটিকে সংরক্ষণ করে চলছেন স্থানীয় লোকজন। তবে এই দুজন জানালেন, গাছটির নাম ‘জিরবট’। তাঁরা একটি ব্যাখ্যাও দিলেন, গাছটি দেখতে জিরের (কেঁচো) মতো হওয়ায় এমন নামেই স্থানীয় লোকজন চেনেন।
মুহিবুর আলী বলেন, ‘আগে এখানে চা-বাগান ছিল না। আমরার বাপ-দাদায় যে রকম গাছ দেখছইন (দেখেছেন), গাছ এখনো এ রকম আছে। ৪০০-৫০০ বছরের কম না গাছের বয়স, আরও বেশিই অইবো (হবে)। একটা বটগাছ, ছয়টা আমগাছ ও দুইটা কাঁঠালগাছে গাছটা জড়িয়ে আছে। কেউ গাছের কিছু কাটে না।’
লোককথা যা-ই থাক, মোকামের সঙ্গে এই ‘জিরবট’ নামের গাছটি এখন লোক-ইতিহাসের অংশ হয়ে টিকে আছে। গাছটির মূল থেকে কাণ্ড ওপরের দিকে না উঠে লতানো উদ্ভিদের মতো এগাছে–ওগাছে চলে গেছে। শুকনাকালে পাতা ঝরে যায়। তখন শুধু বিরাট লতাগুলোই চোখে দেখা যায়। বৃষ্টির মৌসুম এলে লতার ডগার দিকে কুঁড়ি ফুটতে থাকে, পাতা বেড়ে ওঠে। গাছের ডগা সবুজ হয়ে ওঠে। বয়স, নাম-পরিচয় নিশ্চিত করা না হলেও বহুকাল ধরে নিঃশব্দ-নিভৃতে স্থানীয় মানুষের সম্মান-ভালোবাসা নিয়ে আছে গাছটি।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।