স্টাফ রিপোর্টার,কুলাউড়ার দর্পণ।
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর চা ও আনারসের বাগান আর পাহাড়-টিলা-হাওরবেষ্টিত পর্যটন জেলা মৌলভীবাজারে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জেলার চারটি আসনেই বিএনপি প্রার্থীরা মাঠে-ময়দানে সক্রিয়। সম্মেলন, ব্যালটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন এবং প্রতিনিয়ত সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে জনসম্পৃক্ততা বাড়াচ্ছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
অন্যদিকে দীর্ঘসময় ধরে দখল করে রাখা চারটি আসনে এখন আর আওয়ামী লীগের সংগঠনিক প্রভাব নেই। ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে বিচ্যুত হওয়ার পর নেতারা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় জেলাজুড়ে আওয়ামী লীগ কার্যত বিলুপ্তপ্রায়।
অন্যদিকে দীর্ঘসময় ধরে দখল করে রাখা চারটি আসনে এখন আর আওয়ামী লীগের সংগঠনিক প্রভাব নেই। ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে বিচ্যুত হওয়ার পর নেতারা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় জেলাজুড়ে আওয়ামী লীগ কার্যত বিলুপ্তপ্রায়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের জেলা হিসেবে পরিচিত মৌলভীবাজার। হাসিনার দুঃশাসনের অবসানের পর জেলায় বিএনপিকে সক্রিয় করেছেন তারই ছেলে সাবেক এমপি এম নাসের রহমান। জেলা আহ্বায়ক ফয়জুল করিম ময়ূন ও সদস্য সচিব আব্দুর রহিম রিপন।
ইতোমধ্যে সদর ও রাজনগর উপজেলা বিএনপির সম্মেলন শেষ হয়েছে। আগস্টেই বড়লেখা, জুড়ী ও কুলাউড়া উপজেলার সম্মেলন ও কাউন্সিলের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়েছে। ১৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে জেলা বিএনপির সম্মেলন।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের নিজ জেলা মৌলভীবাজার। এখানে নিয়মিত কর্মসূচি পালন করছেন দলটির নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে কুলাউড়া ও বড়লেখা উপজেলায় দলের শক্তিমত্তা বাড়ানো হয়েছে। ইতোমধ্যে জেলার সব আসনেই প্রার্থী ঘোষণা করেছে জামায়াত। পাশাপাশি খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলনও প্রার্থী ঘোষণা করেছে। সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও গণঅধিকার পরিষদ।
মৌলভীবাজার-১
বড়লেখা ও জুড়ি উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন তিনজন। তারা হলেনÑজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য নাসির উদ্দিন মিঠু, কাতার বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শরিফুল হক সাজু, সাবেক ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মরহুম এবাদুর রহমান চৌধুরীর কন্যা ব্যারিস্টার জহরত আবিদ চৌধুরী। এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী মাওলানা আমিনুল ইসলাম জেলা জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য এবং ঢাকার শেরেবাংলা থানার সাবেক আমির। খেলাফত মজলিসের প্রার্থী মাওলানা লোকমান আহমেদ দলটির কাতার শাখার সহসভাপতি।
বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলায় বিএনপির ভোটব্যাংক রয়েছে। তবে স্থানীয় নির্বাচনে জামায়াতের প্রমাণিত জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক ভিত্তির কারণে এ আসনে প্রতিযোগিতা অবধারিত। অন্য কোনো দলের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ আসনে সংখ্যালঘু ভোটাররাই হতে পারে কিং মেকার।
মৌলভীবাজার-২
কুলাউড়া উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসন বিএনপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। দলটির মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেনÑজেলা আহ্বায়ক কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট আবেদ রাজা, কুলাউড়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শওকতুল ইসলাম শকু, যুক্তরাজ্যপ্রবাসী ড. সাইফুল আলম চৌধুরী, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ জুবায়ের আলী, ক্যালিফোর্নিয়া বিএনপির সভাপতি অলিউর রহমান শিপলু, যুক্তরাজ্য বিএনপির উপদেষ্টা আব্দুল আহাদ, যুবদলের সাবেক আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও যুক্তরাষ্ট্র যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ আহমদ।
এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী জেলা আমির ও কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য প্রকৌশলী এম সাহেদ আলী। এছাড়াও দলের আমির ডা. শফিকুর রহমান এ আসনেরই বাসিন্দা। সম্প্রতি একাধিক দলীয় কর্মসূচিতে সরাসরি অংশ নিয়েছেন তিনি। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন রয়েছে শেষ পর্যন্ত তিনিই হয়তো এখানে প্রার্থী হতে পারেন। আনজুমানে আল-ইসলাহ উপজেলার সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মাওলানা কাজী ফজলুল হক খান সাহেদও প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জাতীয় পার্টি (জাফর) থেকে প্রার্থী হবেন সাবেক এমপি নবাব আলী আব্বাছ খান। এ আসনে এবারের নির্বাচন বহুমুখী লড়াইয়ে রূপ নিতে যাচ্ছে।
বিএনপি সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় হলেও মনোনয়নপ্রত্যাশীদের দীর্ঘ তালিকা প্রার্থী নির্ধারণে চ্যালেঞ্জ হতে পারে। অন্যদিকে জামায়াতের সুসংগঠিত প্রস্তুতি এবং ইসলামী প্রার্থীদের তৎপরতা একটি বিকল্প মেরু তৈরির ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে দলবদলের রাজনীতিতে পটু ও বিতর্কিত আগের দুই এমপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ ও এমএম শাহীন কার্যত মাঠের বাইরে থাকায় সাধারণ ভোটাররা নতুন মুখের আশায় রয়েছেন।
মৌলভীবাজার-৩
মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগর উপজেলা নিয়ে এ আসন। জেলার সবচেয়ে আলোচিত ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনি এলাকা এটি। এ আসনে সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের ছায়া এখনো স্পষ্ট। সাইফুর রহমানের উন্নয়ন দর্শন আজও মৌলভীবাজারবাসীর হৃদয়ে অমলিন হয়ে আছে। তার হাত ধরেই মৌলভীবাজার, তথা সিলেট অঞ্চলের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ময়দান হয়েছিল সমৃদ্ধ। এ নামটি গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সর্বত্র সাধারণ মানুষের মুখে মুখে এখনো উচ্চারিত হচ্ছে দলমতনির্বিশেষে। তার বড় ছেলে এম নাসের রহমান বর্তমানে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। একক প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের মাঠে সক্রিয় রয়েছেন তিনি। দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে জেলা বিএনপির সভাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম,
আন্দোলন ও জনসংযোগে সক্রিয় ছিলেন। খেলাফত মজলিসের প্রার্থী মাওলানা আহমদ বিলাল দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক সম্পাদক ও রাজনগর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান। এ আসনে অন্য দলের কোনো প্রার্থীর নাম এখনো ঘোষণা হয়নি।
মাওলানা আহমদ বিলাল বলেন, ইসলামী জোট হলে এ আসন জামায়াতকে ছেড়ে দেওয়া হবে। জোট না হলে তিনি খেলাফত মজলিসের প্রার্থী।
সাবেক এমপি এম নাসের রহমান বলেন, তিনি এমপি থাকাকালে রাজনগর ও মৌলভীবাজার উপজেলায় অনেক উন্নয়ন হয়েছে। তিনি আশাবাদী দল এবারও তাকেই মনোনয়ন দেবে।
জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী আব্দুল মান্নান বলেন, এখন ফ্যাসিস্ট হাসিনামুক্ত বাংলাদেশে প্রকাশ্যে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন। মানুষের সঙ্গে কথা বলে যতটুকু বুঝতে পেরেছি, তারা পরিবর্তন চায়।
মৌলভীবাজার-৪
শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী (হাজি মুজিব) ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শ্রীমঙ্গল পৌরসভার সাবেক মেয়র মহসিন মিয়া মধু।
শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলায় নির্বাচনের ফলাফল সব সময়ই চা-শ্রমিক ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর ভোটের ওপর নির্ভর করে। দুই মনোনয়নপ্রত্যাশীই ওই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষায় সক্রিয়। সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে তারা নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন।
এ আসনে ধানের শীষের পক্ষে শক্তিশালী গণভিত্তি স্পষ্ট। তবে মনোনয়নপ্রাপ্ত ব্যক্তি দলের মধ্যে কতটা ঐক্য আনতে পারবেন, সেটাই মূল বিষয়। এছাড়া চা-শ্রমিক ও সংখ্যালঘু হিন্দু ভোটারদের আস্থা অর্জনই হবে বিজয়ের প্রধান চাবিকাঠি।
এ আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী করা হয়েছে সিলেট মহানগরের সহকারী সেক্রেটারি ও সাবেক শিবির নেতা অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আব্দুর রবকে।
এছাড়াও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্য সচিব প্রীতম দাশ, বাংলাদেশ আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের নেতা নুরে আলম হামিদি ও গণঅধিকার পরিষদের সম্ভাব্য প্রার্থী হারুনুর রশীদের নাম শোনা যাচ্ছে। তবে মাঠপর্যায়ে এসব দলের প্রচার ও সাংগঠনিক তৎপরতা এখনো দুর্বল।
জানতে চাইলে মৌলভীবাজার জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি ইয়ামীর আলী আমার দেশকে বলেন, নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমরা চারটি আসনেই প্রার্থী ঘোষণা করেছি। আমাদের বড়লেখা উপজেলা প্রার্থী তিনি অতীতেও প্রার্থী ছিলেন। সে কারণে বড়লেখায় আমাদের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত। এখানে আমাদের ম্যানপাওয়ারও বেশি। প্রার্থীর পারিবারিক অবস্থানও ভালো। ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। জামায়াতে ইসলামীরও ঢাকার একটি থানার আমির ছিলেন। বর্তমানে জেলা কর্মপরিষদ শূরার সদস্য। এ আসনে মাঠে-ময়দানে জনগণের সঙ্গে বেশ মিশে আছেন তিনি। বেশ ভালো ও জনগণের সাড়া আছে প্রচুর। কুলাউড়া আসনে আমাদের জেলা আমির প্রার্থী হবেন । কিন্তু আমিরে জামায়াত একাধিকবার সফর করার কারণে জনগণের দাবি হলো, আমিরে জামায়াতকে যেন প্রার্থী করা হয়। আমিরে জামায়াতের পরপর সফরের ফলে একটা পটপরিবর্তন হয়েছে। রাজনগর-মৌলভীবাজার সদর আসনে জামায়াতের প্রার্থী বিগত দুবার রাজনগর উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থী ছিলেন।
আমাদের ধারণা রাজনগরে আমরা সর্বোচ্চ ভোট পাব। আর সদরে আমাদের প্রার্থীর পরিচিতিটা কিছুটা কম। তবে আমরা গত রমজান মাস থেকে আমাদের প্রার্থী সদরকেন্দ্রিক ১২টি ইউনিয়নে প্রচুর সফর করছেন। এতে জনগণের সমর্থনও বাড়ছে। শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ আসনের প্রার্থী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। সিলেট মহানগরের সভাপতি ছিলেন। আইনজীবী হিসেবেও পরিচ্ছন্ন মানুষ।
খেলাফত মজলিস মৌলভীবাজার জেলার সাধারণ সম্পাদক মুহিবুল ইসলাম বলেন, মৌলভীবাজার জেলার চারটি আসনেই আমরা প্রার্থী ঘোষণা করেছি এবং একটা সম্ভাবনা আছে পাঁচদলীয় জোটভিত্তিক নির্বাচন হওয়ার। ইসলামী দলগুলোর মধ্যে আসন সমঝোতার সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে সবার ছাড় দেওয়ার মনমানসিকতা আছে। ইসলামী জোট হলে স্বাভাবিকভাবেই বিএনপির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। ইসলামপন্থিরা ঐক্যবদ্ধ হলে সবকটি আসনেই আমরা জয়ী হব বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ফয়জুল করিম ময়ূন বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে জেলার চারটি আসনেই আমরা বিপুল ভোটে জয়ী হব।
সূত্র দৈনিক আমার দেশ
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।