লেখক হারুন চৌধুরী সুইডেন।
আমার প্রিয় জন্মভূমি।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলা শুধু ভৌগোলিক দিক থেকেই নয়, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জীবনধারার বৈচিত্র্যের জন্যও অনন্য। পাহাড়ি টিলা, হাওর ও চা-বাগানঘেরা এই জনপদে প্রাচীন ঐতিহ্য, লোকজ সংস্কৃতি ও বহুমাত্রিক সমাজজীবন একে অপরকে পরিপূরক করে চলেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
কুলাউড়ার ইতিহাস বহুমাত্রিক। প্রীতিমপাশা জমিদার পরিবার এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় বিদ্রোহী সৈন্যরা এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ১৯২১ সালের অসহযোগ আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কুলাউড়া জনগণ আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের ইতিহাস রচনা করেছে। গগন টিলা, প্রীতিমপাশার জমিদারবাড়ি ও রাঙ্গীরকুল বিদ্যা আশ্রম আজও সেই ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে।
কুলাউড়া সমাজে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও উপজাতীয় সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে। মনিপুরি ও খাসিয়াদের নিজস্ব ভাষা, পোশাক ও উৎসব স্থানীয় সংস্কৃতিকে করেছে সমৃদ্ধ। দুর্গাপূজা, ঈদ, বৈশাখী উৎসব কিংবা পাউষ সংক্রান্তির মেলা—সবই কুলাউড়ার মানুষকে মিলিয়ে দেয় আনন্দের বন্ধনে।
স্থানীয় হাট-বাজার কেবল পণ্য কেনাবেচার কেন্দ্র নয়, সামাজিক আড্ডা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়েরও প্রাণকেন্দ্র। বাঁশ ও পাটের হস্তশিল্প, মনিপুরি তাঁতের পোশাক কিংবা চা-শ্রমিকদের নিজস্ব সংগীত ও নৃত্য এই জনপদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির প্রতিফলন।
কুলাউড়ার খাদ্যাভ্যাস মূলত ভাত, ডাল, মাছ ও শাকসবজিভিত্তিক। হাওর এলাকার মাছ যেমন বোয়াল, শিং, টেংরা বা মৌসুমি শুকনা মাছ এখানকার মানুষের বিশেষ প্রিয়। মৌলভীবাজারের লেবু, আনারস, লিচু ও কাঠাল কুলাউড়ার বাজারে আলাদা স্বাদ এনে দেয়। পাশাপাশি স্থানীয় মিষ্টি ও উৎসবভোজও সামাজিক মিলনকে করে আরও প্রাণবন্ত।
এ অঞ্চলের ধর্মীয় জীবন চিরকাল বৈচিত্র্যপূর্ণ। মসজিদ-মন্দিরের পাশাপাশি রয়েছে সুফি দরগাহ ও স্থানীয় মাজার, যা মুসলিম-হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের মিলনমেলায় রূপ নেয়। এ মিলনই কুলাউড়ার সামাজিক ঐক্যের মূলভিত্তি।
কৃষি, মাছ ধরা ও পশুপালনের পাশাপাশি চা-বাগান কুলাউড়ার অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। শত শত চা শ্রমিক তাদের শ্রমে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে অবদান রাখছে। আধুনিক সময়ে সড়ক ও রেলপথের উন্নয়ন, শিক্ষার বিস্তার এবং বিদেশে কর্মরত প্রবাসীদের রেমিট্যান্স কুলাউড়ার অর্থনীতিকে করেছে আরও শক্তিশালী।
বাংলার উত্তর-পূর্ব প্রান্তে, সবুজ পাহাড় আর চা-বাগানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক পুরনো জংশন—কুলাউড়া রেলওয়ে স্টেশন। আজকের ব্যস্ত যাত্রীদের কাছে এটি হয়তো কেবলই যাতায়াতের কেন্দ্র, কিন্তু এর দেয়ালে লুকিয়ে আছে শত বছরের ইতিহাস, ব্রিটিশদের সময়কার গল্প।
১৮৯৬ সাল। ব্রিটিশরা তখন সিলেটের চা-বাগান থেকে পাতা নিয়ে ছুটে চলেছে। তাদের দরকার এমন একটি পথ, যেখান দিয়ে চা সহজেই পৌঁছাবে কলকাতার বাজারে আর চট্টগ্রামের বন্দরে। সেই প্রয়োজন থেকেই জন্ম নিল কুলাউড়া জংশন। রেললাইন এঁকেবেঁকে গিয়ে মিশল এই ছোট্ট শহরে, আর এখান থেকেই ছড়িয়ে পড়ল নানা দিকে—সিলেট, আখাউড়া, চট্টগ্রাম, এমনকি ভারতের করিমগঞ্জ পর্যন্ত।
কুলাউড়া জংশন যেন এক বিশাল আঙিনা, যেখানে প্রতিদিন ট্রেন আসে আর যায়, যেন মানুষের গল্প নিয়ে এক অদৃশ্য বই লিখছে। কেউ যাচ্ছে রাজধানীতে চাকরির খোঁজে, কেউ বা ফিরছে চা-বাগানের কাজ শেষ করে। এই জংশনের বুক চিরে বয়ে চলা রেললাইন মানুষকে শুধু এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায় না, নিয়ে যায় সময়ের ভেতরও।
এই স্টেশন শুধু যাত্রীদের ভিড়েই ভরা নয়, বরং অর্থনীতিরও প্রাণকেন্দ্র ছিল একসময়। চা-পাতার বোঝাই বগি গড়গড় করে চলত এখান দিয়ে, কাঠ ও কৃষিপণ্য যেত দেশের নানা প্রান্তে। বলা চলে, কুলাউড়া ছাড়া সিলেটের চা-শিল্পের গল্পও অসম্পূর্ণ থেকে যেত।
আজও, যখন পুরনো লালচে ইটের ভবনের দিকে তাকানো হয়, মনে হয় যেন ব্রিটিশ আমলের সেই সিটি বাজানো ইঞ্জিন এখনো শোনা যায়—হুইসেল বাজিয়ে জানাচ্ছে, “চলো, পথ শুরু হলো।”
কুলাউড়া জংশন তাই শুধু একটি স্টেশন নয়, এটি এক জীবন্ত ইতিহাস, এক গল্পের বই, যেখানে প্রতিটি ট্রেনের শব্দই নতুন অধ্যায় রচনা করে চলেছে।
কুলাউড়া জংশনের ঐতিহাসিক টাইমলাইন
১৮৯৬ – ব্রিটিশরা চা-শিল্প ও প্রশাসনিক যোগাযোগের সুবিধার জন্য কুলাউড়া জংশন প্রতিষ্ঠা করে।
১৯০৩–১৯১২ – রেললাইন সম্প্রসারণ শুরু হয়; সিলেট, আখাউড়া ও চট্টগ্রামের সঙ্গে কুলাউড়ার সরাসরি সংযোগ গড়ে ওঠে।
১৯২৮ – ভারতীয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের করিমগঞ্জের সঙ্গে আন্তর্জাতিক রেলপথ চালু হয়।
১৯৪৭ – ভারত ভাগের পরও কুলাউড়া থেকে করিমগঞ্জ পর্যন্ত ট্রেন চলাচল অব্যাহত থাকে, ফলে স্টেশনটি সীমান্ত রেল যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ধরে রাখে।
১৯৬০-এর দশক – পাকিস্তান আমলে চা, কাঠ ও কৃষিপণ্য পরিবহনে কুলাউড়া জংশন হয়ে ওঠে সিলেট অঞ্চলের সবচেয়ে ব্যস্ত বাণিজ্যকেন্দ্র।
১৯৭১ – মুক্তিযুদ্ধের সময় কুলাউড়া জংশন কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পাকবাহিনী একাধিকবার এই রেললাইন ধ্বংস করতে চেয়েছিল, আবার মুক্তিকামী মানুষও এটিকে ব্যবহার করেছিল যাতায়াত ও রসদের পথে।
স্বাধীনতার পর (১৯৭২–১৯৮০) – বাংলাদেশ রেলওয়ের অন্যতম প্রধান জংশন হিসেবে নতুনভাবে উন্নয়ন ও পুনর্গঠন করা হয়।
১৯৯০-এর দশক – সড়ক পরিবহনের প্রসারের কারণে যাত্রী সংখ্যা কিছুটা কমলেও সীমান্ত বাণিজ্যে কুলাউড়ার গুরুত্ব অটুট থাকে।
২০০০–বর্তমান – আধুনিকায়নের প্রচেষ্টা শুরু হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটগামী ট্রেনসহ ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বপূর্ণ রেল সংযোগে কুলাউড়া আবারও আন্তর্জাতিক গুরুত্ব ফিরে পায়।
কুলাউড়া এক অনন্য জনপদ, যেখানে ইতিহাসের বীরত্ব, প্রকৃতির সৌন্দর্য, ধর্মীয় সম্প্রীতি ও লোকজ সংস্কৃতি একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এখানকার মানুষ তাদের ঐতিহ্য ধারণ করে আগামীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কুলাউড়া আজ কেবল মৌলভীবাজারের নয়, বরং সমগ্র বাংলাদেশের এক সাংস্কৃতিক সম্পদ।
আমার প্রিয় জন্মভূমি ,
সবুজ চায়ের বাগান ঘেরা,
নদী-খালের মায়া ভরা,
কুলাউড়া আমার প্রাণের গান,
ভালোবাসায় রঙিন স্থান।
গ্রামবাংলার গন্ধ মিশে,
পাখির সুরে ভোর যে উঠে,
প্রিয় জন্মভূমি তুমি–
চিরদিনের শান্তি ভূমি।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।