1. kulauradorpon@gmail.com : কুলাউড়ার দর্পণ : কুলাউড়ার দর্পণ
  2. info@www.kulaurardarpan.com : কুলাউড়ার দর্পণ :
বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:২৭ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
মৌলভীবাজার -২,কুলাউড়া সংসদীয় আসন পরিবর্তনের পর তা ডাঃ জুবায়দার প্রতি উৎসর্গ করবো …..সিলেট বিভাগবন্ধু আবেদ রাজা কুলাউড়ায় ১শ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি: ভারত সীমান্তবর্তী কর্মধায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে হুহু করে : ২ জনের মৃত্যু পাকিস্তানের সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও “ডন” পত্রিকার সম্পাদক কুলাউড়ার আলতাফ হোসেন দি মৌলভীবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’র পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত “দুই সেতুর ঝুঁকিতে হাজারো মানুষের জীবন—ভবানীপুর ও লক্ষীপুরে জরুরি সংস্কারের দাবি” জুড়ীতে স’মিল ৩ লক্ষ টাকার বেশি বকেয়া বিল নিয়ে মালিকের নাটকীয় কাণ্ড কুলাউড়ার গৌরব ব্যারিস্টার মোন্তাকীম চৌধুরী: সংগ্রাম, রাজনীতি ও রাষ্ট্রগঠনের এক জীবন্ত ইতিহাস কাতার যাচ্ছেন সশস্ত্র বাহিনীর ৮০০ সদস্য গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ: কুলাউড়ার তরুণীর মৃত্যু, আরেকজন লাইফ সাপোর্টে কুলাউড়ার কাদিপুরের গৌরব: ক্ষীরোদ বিহারী সোম ও তাঁর উত্তরসূরি

কুলাউড়া (সৈয়দ আকমল হোসেনের জীবনীর ছোট্ট একটা গল্প) বর্তমান বহুল পরিচিত সৈয়দ বাড়ি 

  • প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৫
  • ১৩১ বার পড়া হয়েছে

৭১ এর স্মৃতি -পর্ব – ২১

সৈয়দ শাকিল আহাদ।।

কুলাউড়ার পূর্বদিকে ,দানাপুর দতরমুরি ,লষ্করপুর কামারকান্দি , ঘাগটিয়া ,রঙ্গীরকুল বিজয়া , দিলদারপুর, ক্লিবডন,গাজিপুর এবং এর আশে পাশের গ্রাম গুলোর ও চা বাগান গুলোর অনেক তথ্যই বর্তমান প্রজন্মের কাছে অজানা ।যুদ্ধকালিন সময়ে যখন প্রথম গাজিপুর যাই সেই স্মৃতিও বেশ মধুর , রাস্তার দুইধারে ফসলের মাঠ , বড় বড় গাছ গাছালী পরিবেষ্টিত সড়ক , সেই সড়কটি ও ছিল পাথরের নুড়ি বিছানো , উচুনীচু রাস্তায় রিকশাই ছিল অন্যতম বাহন , বাগানের কিছু জীপ ও ট্রাক্টর ও মাঝে মাঝে চলতে দেখা যেতো , তবে সচরাচর সাইকেলে চড়ে ও পায়ে হেটে চলাচল করতে দেখা যেত বেশী ।, বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক মোহাম্মদ ওয়াহিদ মুরাদের লেখা “ইতিহাসের দর্পনে কুলাউড়া “নামক বইয়ে উল্লেখ রয়েছে “হযরত শাহ হেলীম উদ্ভিদ কুরেশী ও তোয়ারিখে সাহাবউদ্দিন পাশা নামক দুইটি বই থেকে জানা যায় , হযরত শাহাজালাল ( রঃ) এর নির্দেশে শাহ হেলীম উদ্দীন কুরেশী ( রঃ) নামে একজন দরবেশ লংলা পরগনায় এসে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন ।তিনি ছিলেন চৌকি পরগনার শাহ তাজ উদ্দিন কুরেশীর ভাই ।সেই সময়ে লংলা অন্চলে পাহাড়ীয়াদের প্রাধান্য ছিল ।লংলা অন্চলটি তখন নামে মাত্র সিলেটের অধীন ছিল , সিলেট তখন গৌড় রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল যা ত্রিপুরার রাজার কর্তৃত্বে ছিল ।

তখন শাহ হেলিম উদ্দিন কুরেশী লংলার একটি পাহাড়ীয়া এলাকায় ভয়ংকর স্থানে বসবাস শুরু করেন ও আরাধনায় নিমগ্ন হন ।জনশ্রুতি আছে একদিন সকালে বনের মধ্যে শাহ হেলিমউদ্দিন রোদ পোহাচ্ছিলেন তাকে ঘিরে ছিল বেশ কয়েকটি বাঘ ।এই দৃশ্য দেখামাত্রই আশেপাশের লোকজন সকলে ভয়ে এই এলাকা ছেড়ে লুসাই পাহাড়ের দিকে চলে যায় ।একদিন এক অসুস্ত রোগাকান্ত হিন্দু মহিলা এই দরবেশের কাছে এসে তার কাছে রোগথেকে মুক্তি কামনা করেন । তিনি তখন আল্লাহ পাকের নামে নিজের হাতের একটি ফল খেতে দেন । ফলটি খেয়ে কিছুক্ষনের মধ্যেই মেয়েটি সুস্ত হয়ে উঠে । পরবর্তীতে ঐ মহিলাটি ইসলাম ধর্ম গ্রহন করলে হযরত শাহ হেলীমউদ্দিন কুরেশী তাকে বিয়ে করেন । ওয়েজউদ্দিন এবং তয়েজউদ্দিন নামে তাদের দুইটি ছেলে সন্তান ছিল ।

দরবেশ হযরত শাহ হেলীম উদ্দিন কুরেশীর মৃত্যুর পুর্বেই তার অধিকারভুক্ত জমির মধ্যাংশে একটি বিশাল দীঘি খনন করে ঐ দীঘির উত্তর অংশ ওয়েজউদ্দিন এ

দক্ষিন অংশে তয়েজউদ্দিন কে ভাগ করে দেন , এই দীঘিটি হদের দীঘি নামে আজও পরিচিত ।ঐ দীঘির পাশ্বে শাহ হেলীম উদ্দিন কুরেশীর মাজার রয়েছে ।বর্তমান কুলাউড়া রবিরবাজার রাস্তার পশ্চিম পাশ্বে ও ফানাই নদীর দক্ষিনে এই মাজার ও দীঘির অবস্তান । শাহ হেলীম উদ্দিন কুরেশীর অধঃস্তন বংশধরদের মধ্যে অনেক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব রয়েছেন এই বংশের অনেকেই কিয়াতলা,কাদিপুর,জয়পাশা,

নজাতপুর , রাউৎগাও , কর্মধা, পৃথিমপাশা, ঘাগটিয়া প্রভৃতি এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করছেন ।জনশ্রুতি আছে ওয়েজউদ্দিন ও তয়েজউদ্দিনের মধ্যে জমি ভাগ হবার পর এর উত্তরাংশ উত্তরভাগ পরবর্তীতে উত্তর লংলা এবং দক্ষিণাংশ দক্ষিণভাগ পরবর্তীতে দক্ষিন লংলা নামে পরিচিত হয় ।

ওয়েজউদ্দিনের পুত্র বুরহান উদ্দিন তার একমাত্র চাচাতো বোনকে বিয়ে করেন ।বুরহান উদ্দিন ও নুরউদ্দিন সময় সিলেটের শাসনকর্তার সাথে ত্রিপুরার রাজার বিরোধ বাধে ।সিলেটের শাসনকর্তার পক্ষে বুরহান উদ্দিন ও নুরউদ্দিন বীরত্ব দেখান ।এই কারনে দিল্লীশ্বর তাদেরকে “খান ই খানান “ উপাধী দান করেন ।নুরউদ্দিনের পুত্র জালালউদ্দিন , দরিয়া উদ্দিন ও বরকতউদ্দিনের মধ্যে জালাল উদ্দিন একজন বিখ্যাত ব্যাক্তি ছিলেন ।

দিল্লির রাজ দরবার থেকে তিনি “মজলিশ জালাল খান “ হিসাবে ভুষিত হন ।তার পুত্র গওহর খাঁ , গহর খাঁর পুত্র গাজি খান সৌখিন বাঘ শিকারী ছিলেন । দিল্লীর জনৈক শাহজাদা একবার শ্রীহট্ট বেড়াতে এলে গাজি খান তার শিকারের সঙ্গী হন ।তারা গভীর জংগলে শিকারের অপেক্ষা কালে হটাৎ একটি বাঘ এসে তাদেরকে নিয়ে আসা হাতিকে আক্রমন করে বসে ,তখন গাজি খান অসীম সাহসের সাথে বাঘটিকে উপর্যপুরি গুলি করে হত্যা করেন।শাহজাদা দিল্লী ফিরে গিয়ে উক্ত ঘটনা সম্রাটকে জানালে , সম্রাট গাজি খানকে ‘গাজি শের খান ‘ উপাধী দিয়ে একটি সনদ পাঠান । এই গাজি খানের নাম অনুসারেই গাজিপুর নামটি হয়েছে ।সেখানে তার মাজার রয়েছে ।

উল্লেখ্য হযরত শাহ হেলীম উদ্দিন নারলুলী নামে আরও একজন দরবেশ কুলাউড়ার পাহাড়ীয়া অন্চলে মনু নদীর তীরবর্তী এলাকায় বসবাস করে ধর্ম প্রচার করেন ।তিনি তার অলৌকিক ক্ষমতা বলে তৎকালে হিন্দু রাজা কর্তৃক তার রানী কনকরানী ও রাজকন্যা কমলা কে ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত করে রাজ্যের অংশ বিশেষ প্রাপ্ত হন ।যা কনকহাটি বা কানিহাটী নামে পরিচিত ।ঐ বংশের অনেক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব রয়েছেন যাদের নিয়ে পর্যায় ক্রমে আগামীতে বিষদ আলোচনা করার আশা রয়েছে ।

কুলাউড়া রবির বাজার রোডে শাহ হেলিম উদ্দিন (রঃ) এর মাজারের একটু দক্ষিনে নর্তন গ্রামের আমঝুপ এলাকায় রেল লাইনের পশ্চিমে রয়েছে সৈয়দ বাড়ী যা নর্তন সৈয়দ বাড়ী নামে পরিচিত নয়নাভিরাম এই বাড়িটি মুলত একজন পীর সাহেবের বাড়ী উনার নাম ছিল সৈয়দ আবুল বাশার মোহাম্মদ রেজওয়ান যিনি অত্র এলাকায় ‘রেজান পীর’ নামে সুপরিচিত । তিনি অত্যান্ত ধার্মিক ও পরহেজগার ব্যক্তি ছিলেন , তিনি আধুনিকতার ছোয়ায় পুর্ন একজন সাধক ছিলেন ।গতানুগতিক দাড়ি টুপি আলখেল্লা না পড়ে প্যান্ট শার্ট ,স্যুট পড়তেন ,তার পিতা সৈয়দ রমুজ আলীও অত্যানত ধার্মিক ও মজ্জুব ব্যক্তি ছিলেন । রেজান পীর সাহেব বিয়ে করেছিলেন আমার আব্বার এক মামাতো বোনকে ,মামা হবিগঞ্জের সুলতানশী হাবেলীর সৈয়দ আব্দুস সালাম সাহেবের ছোট মেয়ে সৈয়দা তহুরা আক্তার খাতুন কে ।সৈয়দ এ বি এম রেজওয়ান সাহেব সম্পর্কে জনশ্রুতি রয়েছে তিনি বাঘের সাথে কথা বলতেন , তাকে রাতের বেলা যখন খাবার খেতে দেওয়া হতো তিনি সেই খাবারটি কিছুটা দুরত্বে গিয়ে সাথে কাউকে নিয়ে বসে খেতেন এবং খাবার শেষে আর ঐ আগন্তুককে আর দেখা যেতো না গায়েব হয়ে যেতো , ভক্তরা দাওয়াত দিলে তিনি তা কবুল করতেন ।অনেকেরই দাবীতে তিনি এক সাথে কয়েক টি ভক্তের বাড়ীতে দাওয়াত খেয়েছেন , যা ছিল একরকম অবিশ্বাস্য । রেজান পীর সাহেবের মাজার ও মসজিদও ও সৈয়দ বাড়ি নামে একটি ডাকঘরও রয়েছে ।

পীর আওলীয়া পরিবেষ্টিত এই কুলাউড়ার এই নর্তন সৈয়দ বাড়ীর প্রধান ব্যক্তি সৈয়দ রেজওয়ান আলী ওফাত হন ১৯৭০ সালের ৬ ই ডিসেম্বর , ফলে ৭১ এর যুদ্ধচলাকালে এ বাড়ীর সকল সদস্য ঢাকাতে থাকায় আমি আর ছোট মামা মনির আলমকে নিয়ে একবার সেই বাড়িতে গিয়ে কাউকে না পেয়ে ফিরে আসি । পরবর্তীতে তার কনিষ্ঠ ছেলে সৈয়দ এ বি এম মান্নান ও অত্যান্ত আমলদার ও ধার্মিক ছিল । বর্তমানে তার বড় ছেলে সৈয়দ এবিএম হান্নান এই বিশাল অবিভক্ত সৈয়দ বাড়ীর গদ্দীনশীন।

অত্যান্ত সুন্দর ছিমছাম ঐ সৈয়দ বাড়ীর সামনে দিয়ে সংগ্রামের সময় ট্রেনে করে যাবার কালে অনেক বার চেষ্টা করেছি লংলা ষ্টেশনে নেমে ,ঐ বাড়ীতে যাবার কিন্তু যাওয়া হয়নি ।পরবর্তীতে বহুবার গিয়েছি এবং নর্তন সৈয়দ বাড়ীর প্রচুর স্মৃতি বয়ে চলেছি যা বলে শেষ করতে পারবো না হয়তো ।

বড় কাপন নামের একটি গ্রাম এই কুলাউড়ার ইতিহাসের অগ্নীস্বাক্ষী হয়ে আছে কারন এই বড়কাপনেরই ছেলে হচ্ছেন “ সৈয়দ আকমল হোসেন ।”

সৈয়দ আকমল হোসেন নাম মনে হতেই একজন জন্মবিদ্রোহী মানুষের কথা মনে পড়ে। মনে হয় জন্মেই এ মানুষ যেন, কমরেড লেনিনের ভাষায় সমাজটাকে পা উপর দিকে এবং মাথা নিচু দিকে দিয়ে উল্টোভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেছে। মনে হয় সমস্ত উলট-পালট করে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়েই তাঁর জন্ম। প্রয়াত কমরেড তারা মিয়া এবং কমরেড আসাদদর আলী ছাত্র ইউনিয়ন সংগঠনের কাজে বেরিয়েছিলেন । কমরেড আসদ্দর আলীর ভাষ্যে যা বিভিন্ন যায়গায় প্রকাশিত হয়েছে , তিনি বলছেন “কুলাউড়ামুখী হওয়ার সাথে সাথে তারা মিয়া বললেন, আকমল হোসেনকে নিশ্চয়ই কুলাউড়ায় পাব। আরও বললেন, সে মুসলিম লীগের দুর্দান্ত কর্মী ছিল। আমি মুসলিম লীগে ছিলাম না। মুসলিম লীগের যে কয়েকজন নেতা এবং কর্মীর সাথে আমার পরিচয় ও সম্পর্ক তারাও কমিউনিস্ট মার্কা। খাঁটি মুসলিম লীগের দুর্দান্ত কর্মী সম্বন্ধে আমার খুব আগ্রহ থাকার কথা না। তারা মিয়ার কথায় বেশী উৎসাহ বোধ করলাম না।

কুলাউড়া পৌঁছে সৈয়দ আকমল হোসেনের সাথে দেখা হল। তাঁর সঙ্গে পাকিস্তান ডান পত্রিকার বর্তমান নির্বাহী সম্পাদক মজিদ সাহেবও ছিলেন। এক যুবককে দেখিয়ে তারা মিয়া বললেন এই হচ্ছেন সৈয়দ সাহেব। তরুণ বয়সে মুখভরা চাপ দাঁড়ি, সরস সোজা দেহ যষ্টি। অশান্ত উদ্যত বাচন ভঙ্গী। কথাবার্তার মধ্য দিয়ে সহসা মনটাই যেন উদ্দাম আবেগে বেরিয় আসছে। চলার ভঙ্গীতে কোন বাধা মানবো না ধরনের নাজরুলিক এক বিমুক্ত ছন্দ। দেখেই মনে হল একজন নতুন মানুষ দেখা হল। কমরেড আসাদ্দর আলী বলছেন “আমার মারাত্মক ত্রুটি ,প্রথম সাক্ষাতেই পরিচয় দূরে থাক্, হৃদ্যতা করা আরও দূরে থাক, সাধারণ কথাবার্তা বলতেও আড়ষ্টতা বোধ করি। কিন্তু সৈয়দ আকমল আমার সম্পূর্ণ বিপরীত। তাঁর হাতে পড়ে আমার আড়ষ্টতা বিপন্ন হয়ে পড়ল। প্রশ্নের পর প্রশ্নের বান ছুঁড়ে ছুঁড়ে আমাকে ঘর্মাক্ত, রক্তাক্ত করে তিনি যখন আবিষ্কার করলেন যে, আমি পাকিস্তান আন্দোলনের মত পূতঃ পবিত্র মহান কর্মে শরীক ছিলাম না, তিনি স্বস্তিই বোধ করলেন। বললেন, এই জন্যই এতদিন আপনার সাথে সাক্ষাত হয়নি। অর্থাৎ আমি সিলেট জেলার একজন জলজ্যান্ত মানুষ হয়েও সৈয়দ আকমলের সঙ্গে পরিচিত নই। এমন বিষ্ময়কর অবস্থাটা এতক্ষন তাঁর কাছে অসহনীয় ছিল। পরবর্তী সময়ে দেখেছি সৈয়দের অপরিচিত মানুষ এই জেলাতে সত্যিই বিরল ছিল।

আমরা অনেক সময় সভা সমিতিতে নীরবে নিভৃতে থেকে প্রায় অদেখা অজানা অবস্থায় যাওয়া আসা করতে পারতাম। কিন্তু সৈয়দ আকমলের উপস্থিতি যে কোন আসরে তাঁকে মনে রাখার মত করে সকল মানুষের দৃষ্টি আকর্ষন না করে পারতো না।

ছাত্র আন্দোলন, রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন, যুবলীগ সংগঠন, কৃষক শ্রমিকের সংগ্রাম, যুক্তফ্রন্টের কাজকর্ম সহ বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগঠনে সৈয়দ আকমল হোসেনের সঙ্গে আমরা যারা কাজ করেছি সকলেই তাঁকে একটু সমীহ করে চলতো । কাজ কর্মের ফাঁকে ত্র“টি বিচ্যুতি চোখে পড়লে ক্ষমাহীন আক্রমণ। প্রগতিশীল আন্দোলনে বৃহত্তর সিলেট জেলায় কুলাউড়া ও শমসেরনগরকে কেন্দ্র করে একটি বিরাট কর্মী বাহিনী গড়ে উঠেছিল। রাজা সাহেব, সালাম সাহেব, সৈয়দ আকমল, সৈয়দ ছয়ফুল হোসেন এবং মফিজ আলীই এই বাহিনীর সেনাপতি মন্ডলীর ভূমিকা পালন করতেন। মফিজ আলী বয়সে সকলের ছোট হলেও সাংগঠনিক কাজে বিশেষতঃ শ্রমিক কৃষক সংগঠনে তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ছিল। রাজা সাহেব এবং সালাম সাহেবও নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে অদ্বিতীয় ছিলেন। সৈয়দ সাহেবের কাজ ছিল সর্বব্যাপী। তাঁকে ছেড়ে কোন কাজই যেন পূর্ণ হতনা। ডাঃ পবন, সৈয়দ বশির আলী, মোঃ আজম, তাহির মাষ্টার, শরীফ উল্লাহ ভাই, আবু কায়সার খান, সীতারাম বর্মন, রাধাকিষণ কৈরী, বেচু হরিমন, আজির উদ্দিন খান, আব্দুল মালিক, তাহির আলম, পংকুমিয়া, সুনীল লৌহ, আফজন, শিশির দে, ফৌরদৌস, স্বপন, ছাত্রনেতা শফকাতুল ওয়াহেদ, গজনফর আলী প্রমুখ কর্মীর বয়সের ব্যবধান যতই থাকুক, সৈয়দ আকমল যখন একসঙ্গে বসে আলাপ আলোচনা করতেন মনে হতো একটি বিরাট পরিবারের কয়েকজন ভাই যেন একত্রে বসেছেন। সৈয়দ সাহেব যেন সকলের বড় ভাই। ভাষা আন্দোলনের পর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কমিউনিস্টরা যুক্তফ্রন্ট গঠন করার কাজে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। তখন কমিউনিস্টরা পার্টির নামে প্রকাশ্যে একটি ছোট টিম রেখে আওয়ামীলীগ ও গণতন্ত্রী দলের ভিতরে থেকে কাজ করার কৌশল গ্রহণ করেন। আসদ্দর আলীরা আওয়ামীলীগে এবং অন্য কয়েকজন গণতন্ত্রী দলে কাজ করতেন। সৈয়দ আকমল গণতন্ত্রী দলে। কিন্তু পার্টি কর্তৃক সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর সকলেই সুশৃংখলভাবেই পার্টির সিদ্ধান্ত অনুসারে কাজ করেন ।যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পরে ৯২(ক) ধারা জারী করে প্রায় আড়াই হাজার রাজনৈতিককে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গে দু’ভাগ হয়। কমিউনিস্ট পার্টিরকে বেআইনী ঘোষনা করা হয়। কিছুদিন আত্মগোপনে থাকার পর মনিরউদ্দিন সাহেব এবং কমরেড আসদ্দর আলী এক সঙ্গে ধরা পড়ন।মনির উদ্দিন সাহেব গণতন্ত্রী দলের জেলা কমিটির সম্পাদক। মাহমুদ আলী সাহেব তখন লোকদের ডেকে নিয়ে পৃথকভাবে আলাপ আলোচনা করতেন। আকমল হোসেন তাঁর খুবই ঘনিষ্ট লোক ছিলেন। পার্টির পক্ষ থেকে আসদ্দর আলীকে সৈয়দ সাহেবের সাথে যোগাযোগ করতে বলা হয়।

সৈয়দ সাহেব প্রথমে পার্টির সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। তাঁর মতে পার্টির লেজুর বৃত্তি ছাড়াই কাজ করা উচিত ছিল। পার্টির কৌশল সম্পর্কে তাঁকে ব্যাখ্যা করা হলে তিনি অবশেষে এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হন। অনেকের ধারণা ছিল সৈয়দ সাহেব কোন নিয়ম মানেন না। কিন্তু জনশ্রুতি আছে , অনেকের মতে সৈয়দ সাহেব বিদ্রোহী ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি বিশৃঙ্খল ছিলেন না। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সৎ, নিয়মনিষ্ঠ, রুচিবান ও ন্যায়পরায়ণ লোক ছিলেন। শ্রমিক কৃষক ছাত্র জনতার প্রত্যেকটি আন্দোলন সংগ্রামের পুরোভাগে সৈয়দ আকমল হোসেন ছিলেন। রাজাসাহেবের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল খুবই মধুর। রাজা সাহেব তাঁর নিজের সঙ্গে সৈয়দ সাহেবের প্রথম সাক্ষাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রায়ই সরস ভাষায় বলতেন, একদিন তাঁর সম্মুখ দিয়ে কট কট আওয়জ তুলে দ্রুতগতিতে একজন লোক বেপরোয়াভাবে ‘হায়দার মঞ্জিলে’ প্রবেশ করেন। তাঁর ব্যতিক্রমর্ধী গতিবিধিতে রাজাসাহেবের মনে ঔৎসুক্যের সৃষ্টি হয়। ফেরার পথে তিনি আগন্তুককে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, তিনি কোথায় কার কাছে গিয়েছিলেন? উত্তরে আগন্তুক তার নিজস্ব বিশিষ্ট ভঙ্গিতে বলেন, “আমি হায়দার খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করে এলাম।” রাজা সাহেব অবাক বিষ্ময়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বললেন, আমি এই সর্বপ্রথম আমাদের বাড়ীতে আব্বা হুজুরের নাম উচ্চারণ করতে শুনলাম। এই বাড়িতে রেওয়াজই ছিল বড় হুজুর-ছোট হুজুর, বলে তছলিম করে এই বাড়ির পুরুষদের উল্লেখ করা।

পরবর্ত্তী সময়ে যতটি আন্দোলন হয় তার সঙ্গে সৈয়দ সাহেব কোন না কোন ভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৫৬ সালে ফুলবাড়ী নামক স্থানে পৃথ্বিমপাশা কৃষি খামার সম্প্রসারনের জন্য কৃষকদের উচ্ছেদ শুরু হয়। হাতি দিয়ে কৃষকদের ঘরবাড়ি ভাংগার জন্য জমিদারের বাহিনী অগ্রসর হতে থাকে। রাজা সাহেব, সৈয়দ আকমল, তারা মিয়া, সৈয়দ সাইফুল হোসেন প্রমুখ নেতার নেতৃত্বে কৃষক সমিতি প্রতিরোধ গড়ে তুলে। আন্দোলনের চাপে তৎকালীন সরকার জমিদারদের মাহফিজখানা বাজেয়াপ্ত করে এবং সেই স্থানে পুলিশ ক্যাম্প বসায় জমিদারী জুলুমের বিরুদ্ধে।

১৯৫৬ সালে রেলওয়ে ধর্মঘটকে উপলক্ষ করে সৈয়দ সাহেবকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৬৭ সালে বড়লেখার ধামাই চা বাগানের শ্রমিকরা ধর্মঘট করে। সিলেটের ৮৭টি চা বাগানের শ্রমিক এই ধর্মঘটে প্রতি সমর্থন জানায়। ধর্মঘট ১৪দিন চলে। কর্তৃপক্ষ ধর্মঘটের শ্রমিকদের খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে। বাহির থেকে ধামাই এর শ্রমিকদের জন্য খাদ্য সাহায্য বন্ধ করার উদ্দেশ্যে পুলিশ এবং ই, পি, আর সকল সড়ক পথ অবরোধ করে রাখে। তখন মফিজ আলী, আবু কায়সার খান, সুনীল লোহ, পংকু মিয়া প্রমুখ সহযোগে গঠিত কমিউনিস্ট পার্টির টিমই চা শ্রমিক আন্দোলনের দায়িত্বে ছিলেন। জেলা কেন্দ্র থেকেও পার্টি নেতারা প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রাখতেন। রেলযোগে খাদ্য সরবরাহ করে ধামাই অবরোধের প্রতিবিধান চিন্তা করা হয়। ধামাইয়ে রেল ষ্টেশন ছিল না। রেল কর্মীদের উপর সৈয়দ সাহেবের বিরাট প্রভাব ছিল। তাঁর সাহায্যে ধামাইয়ের নিকট রেল থামানোর ব্যবস্থা করে খাদ্য দ্রব্য ফেলে দেয়া হত। সেখান থেকে মহিলা শ্রমিকগণ কাপড়ের আঁচলে করে চাল ডাল গোপন পথে বাগানে নিয়ে যেতেন।

১৯৭০ সালে নির্বাচন বানচাল করার ষড়যন্ত্রের (?) অপরাধে অন্যান্যদের সঙ্গে সৈয়দ সাহেব এবংকমরেড আসদ্দর আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়। অন্যদিকে সেই সময়ে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির কোন কোন নেতা আসদ্দর আলীর উপর খুব বিক্ষুব্ধ ছিলেন। তাদের অভিযোগ ছিল (১) সোভিয়েত রাশিয়া সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বলে আসদ্দর আলী বিশ্বাস করতেন না না। (২) তিনি নির্বাচনের পক্ষে ছিলেন । (৩) কমরেড চারু মজুমদারের লাইন সঠিক মনে করতেন না। (৪) তখন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্খাই প্রধান জাতীয় প্রবণতা ছিল বলে কমরেড আসদ্দরের ধারণা ছিল সৈয়দ আকমলও কমরেড আসদ্দরের প্রতি এই অভিযোগ বিরুপ ছিলেন। জেলে প্রথম আলাপেই তিনি অকপটে এ কথা স্বীকার করেন। তিনি মুখ কাটা বলেই সবাই জানতেন। আসদ্দরকে কিছু কাটা কাটা কথাও তিনি শুনান। তাঁর অভিযোগের উত্তরে কমরেড আসদ্দর বলেছিলেন “আমার বিরুদ্ধে উপরোক্ত অভিযোগগুলো সত্য। কিন্তু এতে আমার দোষ কোথায়? আমার বিশ্বাস বা ধারণার কথাতো আমি নির্দিষ্ট ফোরামের কাউকে বলিনি। দ্বীতিয়তঃ আমি পার্টির নিয়ম শৃংখলার বিরোধী কোন কাজ করেছি বলে পার্টি থেকে আমার বিরুদ্ধে কোন নির্দিষ্ট অভিযোগ তো আনা হয় নাই। আমার কথায় বিশ্বাসগুলোর পক্ষে বিশেষ কোন যুক্তি না দেখিয়ে ১৯৬৯ সালের বাস্তব অবস্থা এখানেও বর্ণনা করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করছি।

ষাট দশক থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট ও বামপন্থিরা ‘মস্কো লাইন’ ও ‘চীনা লাইন’ এর পথ ধরে বিভক্ত হয়ে দুই বিপরীত ধারায় কাজ করেছেন। এই দশকের শেষ দিকে দুই ধারার অনুসারীদের বিশেষ করে কৃষক শ্রমিক ছাত্র বুদ্ধিজীবী মহলে তীব্র বিক্ষোভ ও বিদ্রোহের মন মানসিকতা বিরাজ করছিল।

১৯৬৯ সালে সমশেরনগর চা বাগানের শ্রমিক কর্মী নীরাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। খবর পেয়ে গভীর উৎকন্ঠা নিয়ে সবাইসসিলেট থেকে রওয়ানা হয় কিন্তু সমশেরনগর পোঁছেই দেখে এলাহী কান্ড। হাজার হাজার শ্রমিক কৃষক পাহাড় কামলা ও ছাত্র কর্মীদের সমাগমে শোভাযাত্রার শ্লোগনে সমশেরনগরে সেদিন সংগ্রামের জোয়ার ডেকেছিল। সৈয়দ আকমল তখন জেলা কৃষক সমিতির সম্পাদক। শ্রমিক নেতা সৈয়দ আকমল হোসেনের নেতৃত্বে শ্রমিক কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে দূর্বার দুর্ণিবার জনসংগ্রামের উজ্জ্বল সম্ভাবনা সেদিন সমশের নগরে তৈরী হয়েছিল। তার সঙ্গে জেলার আন্দোলন সংগ্রামের যোগাযোগ রক্ষা করা কঠিন ছিল। চীন সোভিয়েত বিরোধের দিকে না তাকিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সকল কমিউনিস্ট ও বামপন্থিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে যদি সকল শ্রেণী সংগ্রামের স্রোতধারার গতিমুখ সার্বিক মুক্তির দিকে প্রবাহিত করতে পারতেন তখন সকল গণতন্ত্রকামী ও স্বাধীনতাকামী শক্তিকে সংগঠিত করা সম্ভ হতো। মাওলানা ভাসানী সহ জাতীয় নেতারা তখন কমিউনিস্টদের সঙ্গে দৃঢ় মৈত্রী স্থাপনকে পূন্যের কাজ মনে করতেন। সোভিয়েত রাশিয়া, ভারত প্রভৃতি দেশ মুক্তি সংগ্রামের প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন জানাত।কমরেড আসদ্দরের আলোচনা শেষ হওয়ার আগেই সৈয়দ সাহেব বললেন, “আপনি আপনার কথা পার্টির কাছে লিখিত ভাবে জানান।” এই বলে নিজস্ব ভঙ্গিতে দ্রুতবেগে বেরিয়ে গিয়ে তিনি অন্যান্য কাজে লেগে গেলেন।॥জেলেও তাঁর এক মুহুর্ত অবসর থাকার জো ছিল না। জেলে ফল ফুলের বাগান ও সব্জী বাগানের কাজ কর্ম ছাড়াও কয়েদীদের বিভিন্ন কাজ করতেন তিনি ১৯৭১ সালে সংবাদের আহমেদুল কবির সহ আবার গ্রেফতার হন এবং ছাড়া পান । সংগ্রামের সময় চাপের মুখে বিতর্কিত ভুমিকার জন্য ৭২ সালে আত্মগোপন করেন ।১৯৮৫ সালে ৩০ শে জানুয়ারী সদাহাস্য উজ্জল এই সংগ্রামী নেতা ইহলোক ত্যাগ করেন । ( চলবে )

 

আরো সংবাদ পড়ুন

পুরাতন সংবাদ পড়ুন

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।

ওয়েবসাইট ডিজাইন : ইয়োলো হোস্ট