1. kulauradorpon@gmail.com : কুলাউড়ার দর্পণ : কুলাউড়ার দর্পণ
  2. info@www.kulaurardarpan.com : কুলাউড়ার দর্পণ :
শনিবার, ০১ নভেম্বর ২০২৫, ১২:১৯ পূর্বাহ্ন

১৯৭১ সনে আমি ছিলাম কুলাউড়ায় , উছলাপাড়া খান সাহেবের বাড়ীতে

  • প্রকাশিত: শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২৫
  • ৪ বার পড়া হয়েছে

৭১ এর স্মৃতি —( ২)

সৈয়দ শাকিল আহাদ

১৯৭১ সনে আমি ছিলাম কুলাউড়ায় ,

উছলাপাড়া খান সাহেবের বাড়ীতে ।

খান সাহেব এ এম আশরাফ আলী ছিলেন আমার নানা , নানার বাবা ছিলেন আমতৈল নিবাসী মৌলবী আমজদ আলী , মৌলবী আমজদ আলী ছিলেন তৎকালিন সময়ের , আই জি পি ( ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পোস্টেজ ) ব্রিটিশরা উনাকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভুষিত করেছিল এবং তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এই বলে যে তিনি ইংরেজদের তাবেদার হয়ে থাকবেন না তার পরও লোকেমুখে তা রয়ে যায় এবং তার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল ,সবাই তাকে খান বাহাদুরই ডাকতো ,তিনি ১৯২৩ সালে হিন্দু জমিদার ভারত চন্দ্র দাস এর কাছ থেকে জমি কিনে এই উছলাপারা এলাকায় খান সাহেবের বাড়ীটি তৈরী করেন ।

ঐ এলাকায় তিনিই প্রথম পাকা দালান ( ১৯২৩ সালে )তৈরী করেন , যা আজও কালের স্বাক্ষী বহন করে আছে , মৌলবী আমজদ আলীকেই সকলে খান সাহেব বলেই ডাকতো , পরবর্তীতে তার বড় ছেলে আমার নানাকেও এ এম আশরাফ আলীকে সবাই খান সাহেব হিসাবে জানতো , যদিও , তিনি সাব রেজিষ্টার সাহেব হিসাবেই বেশি পরিচিতি ছিল , যেহেতু পেশায় তিনি ছিলেন সাব রেজিষ্টার , কর্মপরিচালনা ও সরকারী দায়িত্ব পালনের জন্য দেশের বিভিন্ন জেলায় যেতে হয়েছে এবং তিনি অবসরের আগে পদোন্নতি পেয়ে জেলা রেজিষ্টার হয়েছিলেন বরিশাল জেলায় ।উনারা ছিলেন দুই ভাই ও তিন বোন ।

নানা বাড়ীর সামনে বিরাট পুকুর ও পিছনেও পুকুর ছিল ।

বলছিলাম ১৯৭১ সালের কথা ,

আমি আমি তখন নিতান্তই শিশু। তারপরেও আমার কিছু স্মৃতি মনে আছে যেগুলো সারাক্ষণ জ্বলজ্বল করে। আমার স্পষ্ট খেয়াল আছে সে বছর বর্ষার সময়ে আমাদের পরিবারের সাথে আশ্রয় নিয়েছিলো

হিন্দু এক পরিবার ,তাদের কথা না বললেই নয় ,

পাকিস্তানি মিলিটারীরা এবং এই এলাকার কিছু চিন্হিত রাজাকারেরা যখন হিন্দুদের ধরে ধরে এনে নির্যাতন করতো কুলাউড়া হাসপাতালের ক্যাম্পের যমঘরে এবং কুলাউড়া গার্লস স্কুলের ক্যম্পে , পরবর্তীতে চোখ বেধে হত্যা করতো রেল লাইনের পূর্বপাশ্বে , সিগনাল পয়েন্টে নিয়ে , তখন কোন এক রাতে ,ভয়ে বাড়ীঘর , গরুছাগল , জরুরী জিনিষপত্র যেটা যেখানে ছিল তা ফেলে রেখে , তারা হানাদার বাহিনীর আক্রমণ থেকে প্রাণ বাচানোর জন্য পরিবার পরিজন নিয়ে পালিয়ে চলে এসেছিল আমাদের মুসলমান বাড়ীতে ,সম্প্রিতির বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন উনারা , তাদের ধারনা ছিল যে এই বাড়ীটি যেহেতু মুসলমানদের সুতরাং এই বাড়িতে আসলে কোন বিপদ হবে না , খান সাহেব অত্যান্ত ভাল লোক এবং সত্বিকার অর্থে তখন কোন বিপদই হয়নি তাদের পরিবারের । সেদিন আমি ও আমার বড় বোন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমাদের বাড়িতে অনেক অচেনা লোক , বিস্মিত হই , তখন

এই পরিবারের সাথে এসেছিল কয়েকজন সদ্য কিশোর ও কিশোরী যাদের সাথে আমি অনেক খেলাখুলা করেছি , বড় বড় তিন ভাইয়ের কথা মনে আছে , রামব্রীজ ভাল নাম চন্দন ঘোষ বর্তমানে শিক্ষকতা পেশায় জড়িত , সাদাব্রীজ ( বর্তমানে প্রয়াত )

ও সুন্দর ,ছোট ছোট দুইটি ভাই ও ছিল , নাম প্রবির ও সুবীর , তিনটি বোনের নামও মনে আছে , সুন্দরী, চম্পা ও মেরী ।অদের সাথে আমরা দুই ভাই বোন দৌড়ানো দৌড়ানো খেলতাম , কার আগে কে যেতে পারে ?

একদিনের ঘটনা ,আমরা খেলার ছলে মাঠ পেরিয়ে

রেল লাইন পর্যন্ত গিয়েছিলাম , তখন সাদাব্রীজ দাদা আমাদের সাথে ছিল , ওর প্রস্তাবেই রেল লাইন ধরে আমরা কজন চলে গিয়েছিলাম ওদের বাড়ি ঠিক ঠাক আছে কিনা দেখার জন্য , ওদের বাড়িটা ছিল দক্ষিন দিকের নবীন চন্দ্র স্কুলের চৌরাস্তা সংলগ্ন রেল ক্রসিংয়ে পেরিয়ে যে রাস্তাটি গাজিপুর বাগানের দিকে গেছে , সেই খানেই , অর্থাৎ রেল লাইন সংলগ্ন পুর্ব দিকের বাড়িটি , সেদিন সবাই মিলে বাড়িটি দেখেও এসেছিলাম , আসার পথে গাড়ি দেখার জন্য সড়ক পথ বেছে নেই , হাফিজ সাহেবের বাড়ি ও সালাম মিয়া চেয়ারম্যানের বাড়ি পেরিয়ে একটি উচু কালভার্ট ছিল , কালভার্ট পেরিয়েই ছিল ছত্তার মিয়ার বাড়ি , পেট্রল পাম্প , হাসিম ডাক্তার এর বাড়ি ঐ বাড়ির সামনে হ্যানিম্যান ফার্মেসি নামে একটি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসালয় ছিল ও তার বিপরিতে ইদ্রিস মিয়ার বাড়ি ।

সেই দিন অনেক ক্ষন পরে বাড়ি ফিরে এসে অনেক বকাও খেয়েছিলাম নানী সহ অন্যান্য মুরববী দের কাছ থেকে ,আমাদের কে কড়া শাসনে রাখতেন বড় মামা আমির আলী , ভয় দেখাতেন ,বাড়ীর পুর্বদিকে , বড় রাস্তায় যাওয়া নিষেধ ছিল আমাদের জন্য, কারন রাস্তায় মিলিটারীরা বন্দুকের নল উঁচু করে টহল দেয় , যে কোন সময় ঘটতে পারে যে কোন ধরনের দুর্ঘটনা ,গুলি করে হত্যাও করে ফেলতে পারে ।হত্যা কি আর মেরে ফেলা কি এগুলি কি আর কিছু বুঝি ?

কে শোনে কার কথা ?

সুযোগ পেলেই ছুটতাম বড় রাস্তায় , গাড়ি ছুটতে দেখলেই ভাল লাগতো , গাড়ি ছুটতো রাস্তা দিয়ে , আমরা দৌড়াতাম পুকুর পাড় দিয়ে , বটগাছ পর্যন্ত , গাড়ি ছুটে চলে যেতো উত্তর দিকে আর আমরা উল্টা দৌড়ে ফিরে আসতাম ফটিকের ( বৈঠক খানা) সামনে ।

আমার স্পষ্ট মনে আছে আমাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে উত্তরদিকে থানার একটু আগেই ছিল দক্ষিন বাজার , থানার আগে যে রাস্তা পেকুর বাজার , বরম চাল ও ব্রাম্মন বাজার গিয়েছে ,একটু এগুলেই

বি ,এইচ প্রাইমারি স্কুলের যাবার পথে এক পাশে দুইটা মুদীর দোকান ছিল , একটিতে ভীর থাকতো অনেক বেশি , সেটিকে সম্ভবত সবাই মোমিনের দোকান বলতো ,তিনি ছিলেন নোয়াখালীর লোক , অনেক ভাল একজন লোক , সর্বদা সাদা পান্জাবী পরতেন ও মাথায় থাকতো সাদা কিস্তি টুপি ,যুদ্ধের সময় তিনি সমগ্র কুলাউড়ার জনগনকে যথাসাধ্য বাকিতে পন্য সামগ্রী সরবরাহ করেছিলেন ,

১৯৭১ সালে এই অন্চলে বিদ্যুৎ ছিল না , রাতের অন্ধকারে আলোর জন্য অন্যতম ভরসা ছিল

হারিকেন ও কুপি বাতি , যা কেরোসিন দিয়ে জ্বলতো , কেরোসিন তেলও তখন ১২ আনা আশি পয়সা সের দরে বিক্রি হতো ।সেই দক্ষিন বাজার যাবার বিপরিতে ছিল একটি গলি ঐ গলিটি দিয়ে রেলওয়ে কলোনি পেরিয়ে , রেলওয়ে ডাক্তার সাহেবের বাসা ও রেলওয়ে স্কুল পেরিয়ে রেল স্টেশনে যাবার পথটি ছিল সকলের পরিচিত স্টেশনে যেতে হলে সকলেই এই পথটি বেছে নিতেন , সেই গলির মুখে ছিল মক্তোদির মিয়ার রেশনের দোকান এবং এই দোকানের সামনেই রাস্তায় বসে বিক্রি হতো চারকোনা টিনের তবে উপরের অংশের কিছুটা কাটা পাশা পাশি রক্ষিত দুটি কেরোসিন ভরা তেলের দোকান থেকে কেরোসিন তেল , যা কুলাউড়া ও আশে পাশের বাড়ীঘরের আলো জানানোর জন্য এই দোকান থেকেই কেরোসিন নেয়া হতো বেশি

কুলাউড়ায় নামাজ পড়ার জন্য সবাই মসজিদে যেত ,কুলাউড়া জামে মসজিদ টি ছিল দক্ষিন বাজারের বড় মসজিদ , লম্বা পাগড়ীওয়ালা ইমাম সাহেব ছিলেন যার নাম সম্ভবত ছিল সৈয়দ ওবায়েদউললাহ ,মসজিদের পাশেই ছিল রামগোপাল ফার্মেসি ঐ বিল্ডিং এর উপরেই ছিল মুক্তিযোদধা সংগঠক জুবেদ চৌধুরীর সাহেবের অফিস , সেখানে জুবেদ চৌধুরী,আবুল চৌধুরী ,জব্বার মামা, সৈয়দ আকমল হোসেন ও সৈয়দ জামালের মত লোকেরা বসে নিয়মিত ঐ সময় কি করে মুক্তিযোদধাদের সংগঠিত করে দেশকে শত্রুমুক্ত করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করতেন ।

তার উল্টা দিকেই ছিল আলাউদ্দিন চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি আর উত্তর বাজারের মসজিদটিও ছিল বড় সেই মসজিদ পেরিয়ে একটু সামনে গেলেই ছিল উত্তর বাজার যা প্রতিদিন বিকালে বসতো এবং পাসেই ছিল কয়েকটি দলিল লেখকের দোকান , যাদের মধ্যে হাসিমপুরের মকবুল আলি মহরী যিনি সম্পর্কে আমার নানা হন এবং যুদ্ধচলাকালিন সময়ে আমরা তার হাসিমপুরের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম,কাদিপুরের সিতাব মহরীর নাম মনে পড়ছে , তাদের দোকানের বিপরীতেই ছিল লাল একটি বিল্ডিং “ সাব রেজিষ্টারের অফিস “একটু সামনে ই ছিল লংলা প্রেস ,এর একটু উল্টা দিকে ছিল আলাউদ্দিন হাজি নানার পরিপাটি সুন্দর বাড়ি , একটু সামনে গেলেই ছিল ডান দিকে হাসপাতাল , বহুদিন সেই হাসপাতালে ডাঃ হিসাবে ছিলেন ডা: আজহারুন্নেছা যার অকৃত্তিম স্নেহের কথা সবসময় মনে হয় এবং

ষ্টেশন রোডে ষ্টেশনের পাশে রেলওয়ে মসজিদের কথাও বেশ মনে আছে , প্রতিটি মসজিদের পাশ্বেই ছিল অযু করার জন্য পুকুর , যা এখন কোন মসজিদের সাথেই নেই ।আর দক্ষিন দিকে হাফিজ সাহেবের বাড়ির সামনে কবরস্থান সংলগ্ন আরেকটি মসজিদের কথা মনে আছে ।

কোন একদিনের কথা বিশেষ করে বার বার মনে পড়ে , সেদিন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন দাউদ এর নির্দেশে , মিলিটারীরা একটি জীপের পিছনে সিরাজুল ইসলাম সিরাজ নামের এক ছেলেকে বেধে সারা কুলাউড়া শহর ঘুরিয়েছে বার বার ,সিরাজের বাবা আবুল কালাম পাটোয়ারী চাঁদপুর থেকে এসে উত্তর বাজারে টেইলারিং দোকান খুলে সুখের সংসার চালাচ্ছিলেন। ১৯৭০ এর নির্বাচনী প্রচারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর বহমান যখন কুলাউড়া সফরে আসেন তখন এই সিরাজ সুরেলা কন্ঠে“ মজিব বাইয়া যাওরে “ গানটি গেয়ে বঙ্গবন্ধুর মনজয় করেন , বঙ্গবন্ধু তার গলাথেকে খুলে একটি ফুলের মালা উপহার দেন সিরাজের গলায় , এই মাল্যদানের একটি ছবি ছিল মোবারক আলির আজম বোডিং এক কাউন্টারে ,মিলিটারীরা কুলাউড়ায় এলে আজম বোডিং এ এই ছবিটি দেখে , ছবির পাত্রের খুঁজে বের করে , তাদের ধরে এনে নির্যাতন করে , তাদের কাছ থেকে মুক্তিবাহিনীর খোজ জানতে চায় ,

সিরাজ ছিল তেমনি এক নির্যাতনের স্বীকার ,

মুক্তি বাহিনীতে যারা গেছে তাদের পরিবারের সদস্যদের ধরে নিয়ে আসে এবং কারো কারো বাড়ি ঘরে আগুন দেয়।

প্রচুর ঘটনা রয়েছে কুলাউড়ার যা এই ক্ষুদ্র পরিসরে লিখে শেষ করা সম্ভব নয় । ভবিষ্যতে বড় পরিষরে লেখার ইচ্ছা রাখি ।( চলবে)

 

৭১ এর স্মৃতি —( 1)

“কুলাউড়ার কনিষ্ঠ ভাষাসৈনিক ছালেহা বেগম: কালো পতাকা হাতে ইতিহাস গড়েছিলেন ১৬ বছরের কিশোরী”

আরো সংবাদ পড়ুন

পুরাতন সংবাদ পড়ুন

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।

ওয়েবসাইট ডিজাইন : ইয়োলো হোস্ট