 
							
							 
                    
৭১ এর স্মৃতি -কুলাউড়া-২ সৈয়দ শাকিল আহাদ
৭১ সালের কথা কোন ভাবেই ভোলার মত নয় , মে মাসে যখন কুলাউড়াতে পাকিস্তানী মিলিটারীরা এলো ,ঢাকা সহ সারাদেশেই পাকিস্তানী মিলিটারীরা ঢুকে পড়েছিল আগেই এবং ঢুকেই ঐ সকল এলাকার মুক্তি কামী বীর সেনাদের ধরে ধরে ক্যাম্পে এনে নির্মম ভাবে হত্যা করতো , যেহেতু যুদ্ধের বছর তখন সকলেই ছিলেন সতর্ক ,
প্রয়োজন ছাড়া কেউই তেমন কারো বাড়িতে আসা যাওয়া করতেন না , তবে আমাদের কুলাউড়ার উছলাপারা নানা বাড়ীতে প্রায়শই কৌলা থেকে আসতেন আমাদের এক মামা খুউব সুন্দর চেহারা , চোখে চশমা থাকতো ,ছিম ছাম গড়ন , তার ছিল একটি সুন্দর সাইকেল ও তিন ব্যাটারীর টস লাইট , তিনি ঐ সাইকেল যোগে কুলাউড়া শহরে আসার প্রাক্কালে বটগাছের নীচ থেকেই টিং টিং শব্দ করে এসেই ডাক দিতেন , ফুফু ফুফু বলে , আমার নানা বাড়ীর সামনে অর্থাৎ কুলাউড়ার ফিল্ডের পশ্চিম দিকে বাড়িতে ঢুকার মুখেই ছিল একটি বিরাট বট গাছ ,সেই রাস্তার মুখেই যখন সাইকেলটি ঢুকতো কৌলার জুনেদ মামা তখন রিং বাজাতেন ,সাইকেলের ঐ রিংয়ের শব্দ শুনেই নানী দৌড়ে বেরুতেন , ব্যস্ত হয়ে পরতেন কৌলার মামাতো ভাইয়ের বড় ছেলে আব্দুল মুসাবিবর চৌধুরী ওরফে জুনেদ চৌধুরী কে দেখতে উনাদের মূল বাড়ী কানিহাটিতে , কৌলা উনাদের নানা বাড়ী ,জুনেদ মামা নিয়ম করেই আত্বীয় স্বজনদের খেয়াল রাখতেন , আমাদের বাড়িতে সকলের খোঁজ খবর শেষে যেতেন তাদের মাগুরাস্ত বাসায় , জুবেদ মামার বাসায় ,সময় কাটাতেন হেসাম ভাই , তাহরাম , তারাজ দের সাথে , আরো সময় কাটতো তার কুলাউড়ার অন্যান্য অনেক আত্বীয় স্বজন দের সাথে ,রামগোপাল ফার্মেসী র উপরে ঐ দোতালা বিল্ডিং এর উপরের তলায় চেয়ার ফেলে কুলাউড়ার তৎকালীন তার সমসাময়িক স্বজনদের নিয়ে আড্ডা মারতেন , তার পকেটে থাকতো বনেদী লোকদের মত ক্যাপস্টেন সিগারেটের সিগার ও ছোট্ট কাগজের বক্স ,তিনি সেই প্যাকেটটি খুলে একহাতে সিগারেট তৈরী করে মনের সুখে টান দিতেন , কি যেন মিষ্টি একটা ধুয়ার গন্ধে আসে পাশে ছড়িয়ে যেত তার উপস্থিতি।হাফ হাতা শার্ট পড়তেন হাতে একটি দামী ঘড়ি , ছোট বড় সকলের খোঁজ নিতেন ।
আমার নানী ছিলেন ভানুগাছের
করিমপুর চৌধুরী বাড়ীর কমরুল হাসান চৌধুরী ,কমরু মিয়া চৌধুরীর ছোট মেয়ে মনিরুন্নেছা খাতুন ওরফে কুটি বিবি ,
নানী সব সময় একটু গর্ব করেই বলতেন আমরা ভানু নারায়নের বংশধর ,আর তার মামাতো ভাই ছিলেন কানিহাটির এক প্রতাপ শালী “আব্দুল মান্নান চৌধুরী “উনার আর এক চাচাতো ভাই ছিলেন নাম করা ,তিনি হচ্ছেন ব্যারিস্টার আব্দুল মুন্তাকিম চৌধুরী ,যিনি মৌলভীবাজার মহকুমার তথা সিলেট জেলার রাজনীতির উজ্জলতরদের মধ্যে অন্যতম। তার কিছু বিশেষত্ব ছিল।যা বর্তমান প্রজন্মের কাছে অজানা ।
কুলাউড়ার উপজেলার হাজিপুর ইউনিয়নের কানিহাটিতে জন্ম নেয়া এই প্রবীণ ব্যক্তিত্ব হজরত শাহ্ জালালের (রঃ) ঘনিস্ট সহযোগী হজরত শাহ্ হেলিম উদ্দিন নারলুলী (রঃ) এর বংশধর ।
ইটার রাজবংশের সাথে তার আত্মীয়তা ছিল।
তার পিতা খান বাহাদুর তজমুল আলি আমার জানা মতে প্রথম মুসলিম বাঙালি জেলা প্রশাসক। তিনি প্রথম জীবনে মৌলানা ভাসানির একজন ঘনিস্ট জন ছিলেন। তার সাথে হুসেন শহীদ সোরওয়ারদির যোগাযোগ ছিল খুবই অন্তরঙ্গ।
১৯৬২ সালে তিনি প্রথম কুলাউড়া বড়লেখা ও শ্রীমঙ্গলের একাংশ নিয়ে গঠিত নির্বাচনী এলাকার এম এন এ নির্বাচিত হন।
মৃত্যুপূর্বে সোহরোয়ার্দী বঙ্গবন্ধুকে পরামশ দেন যাতে মুন্তাকিম চৌধুরীকে তার দলে অন্তরভুক্ত করেন। ১৯৬৩ সালে বঙ্গবন্ধু তাকে আওয়ামী লীগে যোগদানের আহবান জানান। বঙ্গবন্ধু যোগ্য লোকদের তখন দলীয় নেতা হিসাবে নির্বাচন করছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি পুনরায় এম এন এ হিসাবে নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি ৪ নং সেক্টরের রাজনৈতিক সমন্বয়কের ভুমিকা ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব জোনের অফিস পরিচালনা ও মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন।
১৯৭২ সালে প্রথমে তিনি সংবিধান কমিটির গুরুত্ব পূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন । পরে জাপান ও জার্মানির রাষ্ট্রদুত হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধু পরবর্তী কালে তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান। তিনি বহুদিন সৌদি আরব ও অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী জীবন যাপন করেন ।তার ঘনিস্ট রাজনৈতিক সহযোগী ছিলেন জনাব আজিজুর রহমান একসময় মৌলভী বাজারের জেলা পরিষদ প্রশাসক ছিলেন ,
আরো ছিলেন নবাব সফদর আলী খান রাজা সাহেব ,জয়নাল আবেদিন, লতিফ খান, আব্দুল জব্বার, নওয়াব আলী সরওয়ার খান চুন্নু , জুবেদ চৌধুরি, মুকিমুদ্দিন, আতাউর রহমান, সৈয়দ জামালুদ্দিন সহ আরো অনেকেই ..
বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই ভুলতে বসেছে তাদেরকে ইদানিং , কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে কে এই এই ব্যারিষটার মুন্তাকিম চৌধুরী ?
অথচ সকলেরই জানা উচিত তার কথা , জুবেদ চৌধুরীর কথা, এম. পি জব্বার মামার কথা , জয়নাল আবেদিনের কথা, সৈয়দ জামালের কথা,আকমল হোসেনের কথা , আলাউদ্দিন চেয়ারম্যানের কথা, রাজা সাহেবের কথা , আব্দুল গফুরের কথা , নাগেন্দ্র মালাকারের কথা, অনুপম কান্তির কথা , রসন্দ্র ভট্টের কথা , মুক্তিযুদ্ধে যাদের বলিষ্ঠ অবদানের কথা , যোগ্য নেতৃত্বর কথা , যাই হোক বলছিলাম তার ভাতিজা জুনেদ চৌধুরীর কথা যিনি প্রায়শই সকালে অথবা বিকালে তার ফুপুরবাড়ি উছলাপারা খান সাহেবের বাড়ীতে আসতেন এবং ছোটবড় সকলের খোঁজ খবর নিতেন সখ্যতা ছিল বড় মামা আমির আলী ও ছোট মামা মুনির আলমের সাথে , আমাদের নানা বাড়ীর সামনের ঘরটি ফটিক বা বৈঠক খানা , ঐ ফটিকের সামনে ছিল শতবর্ষী বিরাট দিঘী আকৃতির একটি পুকুর যা এখন একজন বিতর্কিত জনপ্রতিনিধির লোলুপ কুদৃষ্টির ফলে পনবিহীন জাল দলিল ও জালিয়াতির মাধ্যমে একজন বিপথগামী বংশধরের সহায়তায় বিক্রিত জমি দেখিয়ে প্রশাসন ও স্থানীয় জনগনের চোখের সামনেই বিলীন হওয়ার পথে ‘এজমালী ‘ঐ পুকুরটি যে পুকুরটির স্বচ্ছ পানি পান করেছেন মুক্তি যোদ্ধারা , তা ছাড়াও যে কোন ফুটবল খেলা হলেই ঐ পুকুরে গোসল করতে দেখেছি , স্থানীয় ও আশে পাশের দুর দুরান্তের অনেক খেলোয়ার দের ,ঐ সময় অনেক বিশাল ব্যক্তিত্ব রাও ঐ পুকুরের পানি পান করেছেন তা পূর্বাবস্তায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছি এবং এই ব্যাপারে কুলাউড়া বাসীর সকলের সহায়তা চাচ্ছি ।
বলছিলাম জুনেদ মামাদের কথা উনারা ছিলেন তিন ভাই , জুনেদ মামা , জুবেদ মামা ও জিন বিজ্ঞানী আব্দুল মুসাকাব্বির চৌধুরী বা আবেদ মামা । জুবেদ মামা বা আব্দুল মুক্তাদির চৌধুরী ছিলেন কুলাউড়ার স্বাধীনতা সংগ্রামী সংগঠকদের অন্যতম , মুক্তি যোদ্ধাদের সংগঠিত ও প্রশিক্ষন কালে তিনি ভারতের কৈলাশটিলা ও ধর্মনগরে অবস্তান করে , রাজা সাহেব , জব্বার মামা , সৈয়দ জামালসহ অন্যান্য নেতাদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন, সংগঠিত করতেন মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ,কিভাবে কুলাউড়াকে শত্রু মুক্ত করা যায় , তার পরিকল্পনা করতেন ,যুদ্ধের সময় সংরামী একজন অগ্রনায়ক ছিলেন এই মুকতাদির চৌধুরী বা জুবেদ মামা , তার একটি ল্যানডরোভার জীপ ছিল , আর একটি জীপ পোস্ট অফিসের গেট পার হয়ে ,দক্ষিন বাজার মসজিদের প্রবেশপথের আগখানেই বহুবছর পরিত্যাক্ত অবস্তায় পরে ছিল । ঐ জীপে চড়ে আমরা ছোটবেলায় আমি , সাফি ,তহশীলদার সাহেবের ছেলে , (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ), রহমান ( বর্তমানে যুক্তরাজ্য প্রবাসী )ও ডাকবাংলোর লিটন ( বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ) উত্তর বাজারের বুলন , মতিন সহ অনেকেই বি এইচ স্কুলে পড়ার সময় , আসা যাওয়ার পথে খেলতাম ,বন্ধ জীপের স্টিয়ারীং ঘুরিয়ে গাড়ী চালাতাম । আহা কি দারুন স্বরনীয় ছিল ৭১ এর সেই ছোট বেলার দিন সহ পরবর্তী সময়ের স্মৃতিময় গুলির কথা । (চলবে )
কুলাউড়া (সৈয়দ আকমল হোসেনের জীবনীর ছোট্ট একটা গল্প) বর্তমান বহুল পরিচিত সৈয়দ বাড়ি
“কুলাউড়ার কনিষ্ঠ ভাষাসৈনিক ছালেহা বেগম: কালো পতাকা হাতে ইতিহাস গড়েছিলেন ১৬ বছরের কিশোরী”
১৯৭১ সনে আমি ছিলাম কুলাউড়ায় , উছলাপাড়া খান সাহেবের বাড়ীতে
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।