
৭১ এর স্মৃতি – ১
সৈয়দ শাকিল আহাদ
১৯৭১ সালে আমি অনেক ছোট , তবে কয়েকটি ঘটনা এত স্পষ্ট মনে আছে যা স্মৃতিতে দাগ কেটে আছে ।আমি তখন নানা বাড়ীতে সিলেট জেলার অন্তর্গত , বর্তমানে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া থানার ঊছলাপারা এলাকায় ,কুলাউড়া শহরের দক্ষিন দিকে স্কুল চৌমুহনী থেকে শুরু করে উত্তরে রেলক্রসিং পর্যন্ত এক রাস্তার শহর কুলাউড়া ,তার ঠিক মাঝামাঝি তেই আমাদের ঐ নানাবাড়ী , বিরাট দীঘিওয়ালা ঐতিহ্য মন্ডিত খান বাহাদুর মৌলভী আমজদ আলীর বাড়ি । বাড়ীর পূর্ব পাশ্বেই বড় রাস্তা , রাস্তার একপাশ্বে শহরের একমাত্র ফুটবল খেলার মাঠ অন্যপাশ্বে আমাদের বাড়ি ।
১৯৭১ সালে মার্চে ঢাকায় গন্ডোগোল শুরু হয়, ঢাকাতে পাকিস্তানি মিলিটারীদের হামলায় জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছিল , নিরাপদ মনে না হওয়াতে আত্বীয় স্বজনেরা গ্রামের বাড়ীতে নিরাপদ মনে করেই ছুটে আসছিলেন প্রত্যন্ত অন্চল গুলোতে ,যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল ট্রেন , ঢাকার সাথে যোগাযোগ হতো ঐ মেইল ট্রেনের মাধ্যমে , হাতে গোনা কয়েকটি টেলিফোন ও ছিল ,সবাই তখন তাজা খবর পেতেন রেডিওর বদৌলতে , এবং ঢাকা থেকে আসা ট্রেন যাত্রীদের মাধ্যমে ।
তা ছাড়া রেডিও ছিলই অন্যতম সর্বশেষ খবর পাওয়ার বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যম ।
আমাদের বাড়িতেও একটি রেডিও ছিল , তা দিয়েই সবাই জানতে পারতাম দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতির কথা ।বাড়ির সামনে বড় রাস্তা হওয়াতে রাসতায় চলাচল রত যানবাহনের কথা ও মনে আছে ,কুলাউড়া মৌলভীবাজার সড়ক পথে বাস চলাচল করতো , এবং কুলাউড়া থেকে জুড়ি হয়ে বড়লেখা বাড়ইপাড়া সড়কেও দু একটি বাস চলাচল করতো তা ও দিনের আলোতে , সন্ধার পর সড়কে তেমন একটা গাড়ী চলাচল করতে দেখা যেতো না , রেলওয়ে জংশন হওয়াতে কুলাউড়ার গুরুত্ব ছিল অনেক , সিলেট আখাউড়া রেল লাইন ছাড়া ও কুলাউড়া থেকে একটি রেল পথ ,দক্ষিন ভাগ , কাঁঠালতলি , ফুলতলা, লাতু , শাহবাজপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তখন ঐ পথে ট্রেনই ছিল একমাত্র বাহন , বর্তমানে রাস্তাঘাট উন্নত হওয়াতে সড়কপথে যোগাযোগ সহজ তাই ট্রেনের গুরুত্ব কমে গিয়েছে ।
স্পষ্ট মনে আছে সেই দিনটির কথা মে মাসের ৭ তা এ সকাল ১০ টা সাড়ে দশটা হবে ,
হটাৎ ফাঁকা গুলির শব্দ শুনতে পেলাম এবং রাস্তা দিয়ে কয়েকটি জীপের আনাগোনা দেখতে পেলাম , বড় মামা এসে জানালেন সময় খুউব কম , জান বাঁচাতে চাইলে এক্ষুনি পালাতে হবে , মিলিটারীরা যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই ধরে নিয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পে , আর যারা অবাধ্য হচ্ছে তাদের গুলি করে মারছে , আশে পাশের সব বাড়ীঘরের লোকজনেরা যে যেভাবে পারছে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে ,বুঝতে পারলাম মিলিটারীরা এসেছে , আর রক্ষা নেই, নানা জানালেন তিনি অবসর প্রাপ্ত সরকারি অফিসার , তিনি কোথাও যাবেন না ,থাকবেন তার বাড়ীতেই , নানী বললেন তিনিও যাবেন না থাকবেন বাড়ীতে তবে মৃত্যু ভয় সকলেরই ছিল ,সিদ্ধান্ত হলো , ঐ দিন আমরা ছোটরা সহ আম্মাকে নিয়ে বড়মামা , ছোটমামা , আমরা বাড়ীর পশ্চিম দিক দিয়ে মনসুর , আমতৈল , কাদিপুর, ভাগমতপুর পেকুরবাজার পেড়িয়ে ,পালিয়ে যাবো হাসিমপুর গ্রামে আমাদের এক আত্বীয় মকবুল আলী নানার বাড়ীতে । সেখানেই নিরাপদ থাকবো , ঐ মোতাবেক যাত্রার প্রস্তুতি চলছিল ।
হটাৎ খেয়াল করলাম ছোটমামা সম্ভবত দক্ষিন বাজার থেকে একটা রিক্সা নিয়ে এসেছেন , ঐ রিক্সায় করেই তিনটি ট্রাংকের ভিতর রক্ষিত বাড়ীর মুল্যবান সামগ্রী দলিল দস্তাবেজ ইত্যাদি নিয়ে ট্রাংক তিনটি সহ রিক্সাটি নিয়ে ছোট মামার সাথে রিক্সার পিছনে পিছনে ছুটলাম , ছোটমামা কোনদিন রিক্সা চালিয়েছেন বলে মনে হয়নি , সেদিনই টেনে টেনে নিয়ে যাচছিলেন ।মক্তদির নানার রেশন দোকানের বিপরিতের মাগুরা মুখী ইটসুরকির পথ ধরে আমাদের রিক্সাটি এগিয়ে চলছিল , বি এইচ স্কুলের সামনে আসতেই পিছন থেকে একটি খোলা জীপ এসে থামলো, জীপ চালাচছিল ছোট মামার ই এক আত্বীয় বন্ধু , সাথে আরো কয়েকজন , ওরাও মিলিটারীর ভয়ে কুলাউড়া থেকে পালাচ্ছিল , ওদের কাছ থেকেই খবর পেলাম , মিলিটারী রা কুলাউড়া হাসপাতালে অস্থায়ী ক্যাম্প করেছে , ওখানে একটি কোয়ার্টার কে ‘যমঘর ‘ বানিয়ে সেখানে সকল পুরুষদের বন্দি করে রাখছে , এবং নির্যাতন করছে ইত্যাদি ,
কে ,কোথায় যাচ্ছে বলার পর মামার অনুরোধে , আমাকে জীপে তুলে দিলো যাতে আমি ছোট মানুষ এবং আমার কষ্ট একটু কম হয় , সম্ভবত জীপে চড়ার সেটাই ছিল আমার প্রথম অভিজ্ঞতা , মাটির রাস্তা দিয়ে সেই জীপটি চললো , কয়েক টি গ্রাম পেরিয়ে প্রায় চার মাইল পরে এক সময় একটি তিন রাস্তার মোড়ে আমাকে নামিয়ে দিল । ঐ মামা টি ,যে কে ছিল তা আজো জানিনা , তবে তিনি আমায় বলেছিলেন ,খোকা তুমি এখানেই অপেক্ষা করো , তোমার ছোট মামা পিছনে আছে , আমরা ব্রাম্মনবাজার হয়ে টেংরা যাবো , আর তোমাদের যেতে হবে ঐ পথে ,কিছুক্ষন পরেই চলে আসবে তোমার মামা , আমি তার কথা মত নেমে পরলাম এবং অপেক্ষা করতে থাকলাম , একটি আমগাছের নিচে বসে ,অপেক্ষা তো আর শেষ হয়না , কয় ঘন্টা যে পেরিয়েছিল তা বলতে পারবো না , তবে মনে আছে অপরিচিত কৌতুহলী কিছু পথচারী আমার পরিচয় ইত্যাদি জেনেছিল , কেউ আবার তাদের বাড়িতেও নিয়ে যেতে চেয়েছিল , আমি যাইনি ।
অনেক ক্ষন পর ছোট মামা আসছে না দেখে আমি সাহস করে ঐ পথ ধরেই কুলাউড়া ফেরত আসতে শুরু করলাম ।কিছুদুর আসার পর দেখলাম ছোটমামা রিক্সাটি টেনে টেনে আসছেন ভারী ঐ ট্রাংক তিনটি সহ ।
মামা ভাইগনাার মিলন হওয়াতে যেন স্বস্তির আনন্দ হয়েছিল তাৎক্ষনিক ভাবে ।
আস্তে আস্তে আমরা মামা ভাগিনা মিলে প্রায় সন্ধায় ,কাংখিত গন্তব্য হাসিমপুরের মকবুল আলী নানার বাড়ীতে পৌঁছাই , পৌঁছেই আমি কান্না কাটি শুরু করে দিয়েছিলাম । বাড়ী যাবো , বাড়ি যাবো ,আম্মার কাছে যাবো , ইত্যাদি বলে কারন আমি পালানোটা খুউব আনন্দের মনে করেই ছোট মামার সাথে কিছু না ভেবেই রওয়ানা হয়েছিলাম ।পালানোর মানে কি এবং তা যে অনেক কষ্টের সেটা বুঝতে পারিনি তখন আমার বয়স মাত্র ৫ বছর , ঐ টুকু শিশুর তো কিছুই বোঝার কথা নয় ।তবে হাসিমপুরের মামা খালারা আমাকে আদর সোহাগ দিয়ে আপন করে নিয়ে ছিলেন বলে পরবর্তীতে তেমন কষ্ট হয়নি ।
চলছিল দিনগুলি আনন্দেই ।কয়েকদিন পরে কাউকে না জানিয়ে একা একা হাটতে হাটতে ঐ মাটির সড়ক দিয়ে কুলাউড়ার উদ্দেশ্য রওয়ানা দেই , কিছুদুর পাড়ি দিয়ে কাদিপুর গ্রাম পেরিয়ে পেকুর বাজার এসে রাস্তা হারিয়ে কাঁদতে থাকি , তখন ঐ বাজারে আমি কে ? কোথায় যাবো ? ঐখানে কিভাবে এলাম ? এত লোকের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আমি সঠিক জবাব দিতে পারি নাই , শুধু বলছিলাম , কুলাউড়া যাবো , সেখানে কেউ একজন হিন্দু ভাল লোক বুঝতে পেরেছিল যে আমি হারিয়ে গেছি , তাই আমাকে যতদুর মনে পরে জিলাপি , পানি খাইয়ে তার বাড়ীতে নিয়ে গিয়েছিল । এক পর্যায়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ি ।
সন্ধায় ঘুম থেকে উঠে দেখি মকবুল আলী নানা , আমাকে খুঁজে বের করে পেয়েছেন এবং ঐ বাড়ীর সকলকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমাকে বাড়ী নিয়ে গেলেন ।
ভীষন ক্ষেপে ছিলেন আমার প্রতি , বলেছিলেন , তোমার মাকে দেখার জন্য ইচ্ছে হচ্ছিল তো আমাকে বলতে পারতে , আমি তোমাকে নিয়ে যেতাম তোমার মায়ের কাছে , এভাবে না জানিয়ে কি কেউ একা একা যায় ? আজ যদি ছেলেধরারা তোমাকে ধরে নিয়ে যেতো তো কোথায় পেতাম তোমাকে ? অনেক আদর করতেন তিনি শুনেছিলাম সেদিন আমাকে না পেয়ে পুকুরে জাল ফেলেছিলেন ডুবে গেছি কিনা তা দেখার জন্য ? সেখানে সাইফুল মামা , কয়েস মামা , সুরাইয়া খালা , রাজিয়া খালা, নুর মামা,শিপলু মামা , জাকারিয়া মামা সহ সবাই আমাদেরকে তাদের সাথে এক করে নিয়ে ছিলেন , নানী ও অনেক আদর করতেন ।
মকবুল আলী নানা ছিলেন অত্যান্ত পরোপোকারী ও অতিথী বান্ধব এবং শুধু আমাদেরকে নয় উনার বাড়ীতে তখন বেশ কয়েকটি হিন্দু পরিবার ও আশ্রয় নিয়ে আত্মগোপন করেছিল ।
যতদুর মনে আছে সেখানে ছিল ছকাপনের বিনষ ভুষন দেব
তিলক পুরের ধীরু বাবু সহ আরো বেশ কয়েক জন ।
কয়েক দিন পর একদিন ভোরেই ঘুন থেকে উঠে দেখি ঐ বাড়ীতে আম্মা , নানী , নানা সবাই এসেছেন । কুলাউড়াতে অবস্তা খারাপ হওয়াতে এবং আমাদের বাড়ির সামনেই সড়কের উত্তর পুর্ব পাশ্বে গার্লস স্কুলে মিলিটারীরা ক্যাম্প করাতে বাড়িঘর ফেলে সবাই হাসিমপুর চলে এসে কিছু দিন ছিলাম , পাকিস্তানিরা কুলাউড়ার ক্যাম্প ছাড়ার পর আমরা সবাই আবার উছলাপারায় চলে আসি । যুদ্ধ তখনও চলছিল ।
মুক্তিযুদ্ধের দুঃসহ সময়ের কথা অনেকই মনে হচ্ছে ,তবুও তখনকার সেই সহযোগীতাকারী দের কথা শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করছি ।ইতি মধ্যে অনেকেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন । আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন তাদের জান্নাত নসীব করুন । আমিন ।( চলবে)
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।