1. kulauradorpon@gmail.com : কুলাউড়ার দর্পণ : কুলাউড়ার দর্পণ
  2. info@www.kulaurardarpan.com : কুলাউড়ার দর্পণ :
শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:৫৬ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
মৌলভীবাজার -২,কুলাউড়া সংসদীয় আসন পরিবর্তনের পর তা ডাঃ জুবায়দার প্রতি উৎসর্গ করবো …..সিলেট বিভাগবন্ধু আবেদ রাজা কুলাউড়ায় ১শ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি: ভারত সীমান্তবর্তী কর্মধায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে হুহু করে : ২ জনের মৃত্যু পাকিস্তানের সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও “ডন” পত্রিকার সম্পাদক কুলাউড়ার আলতাফ হোসেন দি মৌলভীবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’র পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত “দুই সেতুর ঝুঁকিতে হাজারো মানুষের জীবন—ভবানীপুর ও লক্ষীপুরে জরুরি সংস্কারের দাবি” জুড়ীতে স’মিল ৩ লক্ষ টাকার বেশি বকেয়া বিল নিয়ে মালিকের নাটকীয় কাণ্ড কুলাউড়ার গৌরব ব্যারিস্টার মোন্তাকীম চৌধুরী: সংগ্রাম, রাজনীতি ও রাষ্ট্রগঠনের এক জীবন্ত ইতিহাস কাতার যাচ্ছেন সশস্ত্র বাহিনীর ৮০০ সদস্য গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ: কুলাউড়ার তরুণীর মৃত্যু, আরেকজন লাইফ সাপোর্টে কুলাউড়ার কাদিপুরের গৌরব: ক্ষীরোদ বিহারী সোম ও তাঁর উত্তরসূরি

৭১ এর স্মৃতি -পর্ব – ২১   ( নর্তন সৈয়দ বাড়ি এবং সৈয়দ আকমল হোসেন)

  • প্রকাশিত: শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২৫
  • ৫১ বার পড়া হয়েছে

৭১ এর স্মৃতি -পর্ব – ২১

( নর্তন সৈয়দ বাড়ি এবং সৈয়দ আকমল হোসেন)

 

সৈয়দ শাকিল আহাদ

 

কুলাউড়ার পুর্বদিকে ,দানাপুর দতরমুরি ,লষ্করপুর কামারকান্দি , ঘাগটিয়া ,রঙ্গীরকুল বিজয়া , দিলদারপুর, ক্লিবডন,গাজিপুর এবং এর আশে পাশের গ্রাম গুলোর ও চা বাগান গুলোর অনেক তথ্যই বর্তমান প্রজন্মের কাছে অজানা ।যুদ্ধকালিন সময়ে যখন প্রথম গাজিপুর যাই সেই স্মৃতিও বেশ মধুর , রাস্তার দুইধারে ফসলের মাঠ , বড় বড় গাছ গাছালী পরিবেষ্টিত সড়ক , সেই সড়কটি ও ছিল পাথরের নুড়ি বিছানো , উচুনীচু রাস্তায় রিকশাই ছিল অন্যতম বাহন , বাগানের কিছু জীপ ও ট্রাক্টর ও মাঝে মাঝে চলতে দেখা যেতো , তবে সচরাচর সাইকেলে চড়ে ও পায়ে হেটে চলাচল করতে দেখা যেত বেশী ।, বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক মোহাম্মদ ওয়াহিদ মুরাদের লেখা “ইতিহাসের দর্পনে কুলাউড়া “নামক বইয়ে উল্লেখ রয়েছে “হযরত শাহ হেলীম উদ্ভিদ কুরেশী ও তোয়ারিখে সাহাবউদ্দিন পাশা নামক দুইটি বই থেকে জানা যায় , হযরত শাহাজালাল ( রঃ) এর নির্দেশে শাহ হেলীম উদ্দীন কুরেশী ( রঃ) নামে একজন দরবেশ লংলা পরগনায় এসে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন ।তিনি ছিলেন চৌকি পরগনার শাহ তাজ উদ্দিন কুরেশীর ভাই ।সেই সময়ে লংলা অন্চলে পাহাড়ীয়াদের প্রাধান্য ছিল ।লংলা অন্চলটি তখন নামে মাত্র সিলেটের অধীন ছিল , সিলেট তখন গৌড় রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল যা ত্রিপুরার রাজার কর্তৃত্বে ছিল ।

তখন শাহ হেলিম উদ্দিন কুরেশী লংলার একটি পাহাড়ীয়া এলাকায় ভয়ংকর স্থানে বসবাস শুরু করেন ও আরাধনায় নিমগ্ন হন ।জনশ্রুতি আছে একদিন সকালে বনের মধ্যে শাহ হেলিমউদ্দিন রোদ পোহাচ্ছিলেন তাকে ঘিরে ছিল বেশ কয়েকটি বাঘ ।এই দৃশ্য দেখামাত্রই আশেপাশের লোকজন সকলে ভয়ে এই এলাকা ছেড়ে লুসাই পাহাড়ের দিকে চলে যায় ।একদিন এক অসুস্ত রোগাকান্ত হিন্দু মহিলা এই দরবেশের কাছে এসে তার কাছে রোগথেকে মুক্তি কামনা করেন । তিনি তখন আল্লাহ পাকের নামে নিজের হাতের একটি ফল খেতে দেন । ফলটি খেয়ে কিছুক্ষনের মধ্যেই মেয়েটি সুস্ত হয়ে উঠে । পরবর্তীতে ঐ মহিলাটি ইসলাম ধর্ম গ্রহন করলে হযরত শাহ হেলীমউদ্দিন কুরেশী তাকে বিয়ে করেন । ওয়েজউদ্দিন এবং তয়েজউদ্দিন নামে তাদের দুইটি ছেলে সন্তান ছিল ।

দরবেশ হযরত শাহ হেলীম উদ্দিন কুরেশীর মৃত্যুর পুর্বেই তার অধিকারভুক্ত জমির মধ্যাংশে একটি বিশাল দীঘি খনন করে ঐ দীঘির উত্তর অংশ ওয়েজউদ্দিন এ

দক্ষিন অংশে তয়েজউদ্দিন কে ভাগ করে দেন , এই দীঘিটি হদের দীঘি নামে আজও পরিচিত ।ঐ দীঘির পাশ্বে শাহ হেলীম উদ্দিন কুরেশীর মাজার রয়েছে ।বর্তমান কুলাউড়া রবিরবাজার রাস্তার পশ্চিম পাশ্বে ও ফানাই নদীর দক্ষিনে এই মাজার ও দীঘির অবস্তান । শাহ হেলীম উদ্দিন কুরেশীর অধঃস্তন বংশধরদের মধ্যে অনেক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব রয়েছেন এই বংশের অনেকেই কিয়াতলা,কাদিপুর,জয়পাশা,

নজাতপুর , রাউৎগাও , কর্মধা, পৃথিমপাশা, ঘাগটিয়া প্রভৃতি এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করছেন ।জনশ্রুতি আছে ওয়েজউদ্দিন ও তয়েজউদ্দিনের মধ্যে জমি ভাগ হবার পর এর উত্তরাংশ উত্তরভাগ পরবর্তীতে উত্তর লংলা এবং দক্ষিণাংশ দক্ষিণভাগ পরবর্তীতে দক্ষিন লংলা নামে পরিচিত হয় ।

ওয়েজউদ্দিনের পুত্র বুরহান উদ্দিন তার একমাত্র চাচাতো বোনকে বিয়ে করেন ।বুরহান উদ্দিন ও নুরউদ্দিন সময় সিলেটের শাসনকর্তার সাথে ত্রিপুরার রাজার বিরোধ বাধে ।সিলেটের শাসনকর্তার পক্ষে বুরহান উদ্দিন ও নুরউদ্দিন বীরত্ব দেখান ।এই কারনে দিল্লীশ্বর তাদেরকে “খান ই খানান “ উপাধী দান করেন ।নুরউদ্দিনের পুত্র জালালউদ্দিন , দরিয়া উদ্দিন ও বরকতউদ্দিনের মধ্যে জালাল উদ্দিন একজন বিখ্যাত ব্যাক্তি ছিলেন ।

দিল্লির রাজ দরবার থেকে তিনি “মজলিশ জালাল খান “ হিসাবে ভুষিত হন ।তার পুত্র গওহর খাঁ , গহর খাঁর পুত্র গাজি খান সৌখিন বাঘ শিকারী ছিলেন । দিল্লীর জনৈক শাহজাদা একবার শ্রীহট্ট বেড়াতে এলে গাজি খান তার শিকারের সঙ্গী হন ।তারা গভীর জংগলে শিকারের অপেক্ষা কালে হটাৎ একটি বাঘ এসে তাদেরকে নিয়ে আসা হাতিকে আক্রমন করে বসে ,তখন গাজি খান অসীম সাহসের সাথে বাঘটিকে উপর্যপুরি গুলি করে হত্যা করেন।শাহজাদা দিল্লী ফিরে গিয়ে উক্ত ঘটনা সম্রাটকে জানালে , সম্রাট গাজি খানকে ‘গাজি শের খান ‘ উপাধী দিয়ে একটি সনদ পাঠান । এই গাজি খানের নাম অনুসারেই গাজিপুর নামটি হয়েছে ।সেখানে তার মাজার রয়েছে ।

উল্লেখ্য হযরত শাহ হেলীম উদ্দিন নারলুলী নামে আরও একজন দরবেশ কুলাউড়ার পাহাড়ীয়া অন্চলে মনু নদীর তীরবর্তী এলাকায় বসবাস করে ধর্ম প্রচার করেন ।তিনি তার অলৌকিক ক্ষমতা বলে তৎকালে হিন্দু রাজা কর্তৃক তার রানী কনকরানী ও রাজকন্যা কমলা কে ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত করে রাজ্যের অংশ বিশেষ প্রাপ্ত হন ।যা কনকহাটি বা কানিহাটী নামে পরিচিত ।ঐ বংশের অনেক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব রয়েছেন যাদের নিয়ে পর্যায় ক্রমে আগামীতে বিষদ আলোচনা করার আশা রয়েছে ।

কুলাউড়া রবির বাজার রোডে শাহ হেলিম উদ্দিন (রঃ) এর মাজারের একটু দক্ষিনে নর্তন গ্রামের আমঝুপ এলাকায় রেল লাইনের পশ্চিমে রয়েছে সৈয়দ বাড়ী যা নর্তন সৈয়দ বাড়ী নামে পরিচিত নয়নাভিরাম এই বাড়িটি মুলত একজন পীর সাহেবের বাড়ী উনার নাম ছিল সৈয়দ আবুল বাশার মোহাম্মদ রেজওয়ান যিনি অত্র এলাকায় ‘রেজান পীর’ নামে সুপরিচিত । তিনি অত্যান্ত ধার্মিক ও পরহেজগার ব্যক্তি ছিলেন , তিনি আধুনিকতার ছোয়ায় পুর্ন একজন সাধক ছিলেন ।গতানুগতিক দাড়ি টুপি আলখেল্লা না পড়ে প্যান্ট শার্ট ,স্যুট পড়তেন ,তার পিতা সৈয়দ রমুজ আলীও অত্যানত ধার্মিক ও মজ্জুব ব্যক্তি ছিলেন । রেজান পীর সাহেব বিয়ে করেছিলেন আমার আব্বার এক মামাতো বোনকে ,মামা হবিগঞ্জের সুলতানশী হাবেলীর সৈয়দ আব্দুস সালাম সাহেবের ছোট মেয়ে সৈয়দা তহুরা আক্তার খাতুন কে ।সৈয়দ এ বি এম রেজওয়ান সাহেব সম্পর্কে জনশ্রুতি রয়েছে তিনি বাঘের সাথে কথা বলতেন , তাকে রাতের বেলা যখন খাবার খেতে দেওয়া হতো তিনি সেই খাবারটি কিছুটা দুরত্বে গিয়ে সাথে কাউকে নিয়ে বসে খেতেন এবং খাবার শেষে আর ঐ আগন্তুককে আর দেখা যেতো না গায়েব হয়ে যেতো , ভক্তরা দাওয়াত দিলে তিনি তা কবুল করতেন ।অনেকেরই দাবীতে তিনি এক সাথে কয়েক টি ভক্তের বাড়ীতে দাওয়াত খেয়েছেন , যা ছিল একরকম অবিশ্বাস্য । রেজান পীর সাহেবের মাজার ও মসজিদও ও সৈয়দ বাড়ি নামে একটি ডাকঘরও রয়েছে ।

পীর আওলীয়া পরিবেষ্টিত এই কুলাউড়ার এই নর্তন সৈয়দ বাড়ীর প্রধান ব্যক্তি সৈয়দ রেজওয়ান আলী ওফাত হন ১৯৭০ সালের ৬ ই ডিসেম্বর , ফলে ৭১ এর যুদ্ধচলাকালে এ বাড়ীর সকল সদস্য ঢাকাতে থাকায় আমি আর ছোট মামা মনির আলমকে নিয়ে একবার সেই বাড়িতে গিয়ে কাউকে না পেয়ে ফিরে আসি । পরবর্তীতে তার কনিষ্ঠ ছেলে সৈয়দ এ বি এম মান্নান ও অত্যান্ত আমলদার ও ধার্মিক ছিল । বর্তমানে তার বড় ছেলে সৈয়দ এবিএম হান্নান এই বিশাল অবিভক্ত সৈয়দ বাড়ীর গদ্দীনশীন।

অত্যান্ত সুন্দর ছিমছাম ঐ সৈয়দ বাড়ীর সামনে দিয়ে সংগ্রামের সময় ট্রেনে করে যাবার কালে অনেক বার চেষ্টা করেছি লংলা ষ্টেশনে নেমে ,ঐ বাড়ীতে যাবার কিন্তু যাওয়া হয়নি ।পরবর্তীতে বহুবার গিয়েছি এবং নর্তন সৈয়দ বাড়ীর প্রচুর স্মৃতি বয়ে চলেছি যা বলে শেষ করতে পারবো না হয়তো ।

বড় কাপন নামের একটি গ্রাম এই কুলাউড়ার ইতিহাসের অগ্নীস্বাক্ষী হয়ে আছে কারন এই বড়কাপনেরই ছেলে হচ্ছেন “ সৈয়দ আকমল হোসেন ।”

সৈয়দ আকমল হোসেন নাম মনে হতেই একজন জন্মবিদ্রোহী মানুষের কথা মনে পড়ে। মনে হয় জন্মেই এ মানুষ যেন, কমরেড লেনিনের ভাষায় সমাজটাকে পা উপর দিকে এবং মাথা নিচু দিকে দিয়ে উল্টোভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেছে। মনে হয় সমস্ত উলট-পালট করে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়েই তাঁর জন্ম। প্রয়াত কমরেড তারা মিয়া এবং কমরেড আসাদদর আলী ছাত্র ইউনিয়ন সংগঠনের কাজে বেরিয়েছিলেন । কমরেড আসদ্দর আলীর ভাষ্যে যা বিভিন্ন যায়গায় প্রকাশিত হয়েছে , তিনি বলছেন “কুলাউড়ামুখী হওয়ার সাথে সাথে তারা মিয়া বললেন, আকমল হোসেনকে নিশ্চয়ই কুলাউড়ায় পাব। আরও বললেন, সে মুসলিম লীগের দুর্দান্ত কর্মী ছিল। আমি মুসলিম লীগে ছিলাম না। মুসলিম লীগের যে কয়েকজন নেতা এবং কর্মীর সাথে আমার পরিচয় ও সম্পর্ক তারাও কমিউনিস্ট মার্কা। খাঁটি মুসলিম লীগের দুর্দান্ত কর্মী সম্বন্ধে আমার খুব আগ্রহ থাকার কথা না। তারা মিয়ার কথায় বেশী উৎসাহ বোধ করলাম না।

কুলাউড়া পৌঁছে সৈয়দ আকমল হোসেনের সাথে দেখা হল। তাঁর সঙ্গে পাকিস্তান ডান পত্রিকার বর্তমান নির্বাহী সম্পাদক মজিদ সাহেবও ছিলেন। এক যুবককে দেখিয়ে তারা মিয়া বললেন এই হচ্ছেন সৈয়দ সাহেব। তরুণ বয়সে মুখভরা চাপ দাঁড়ি, সরস সোজা দেহ যষ্টি। অশান্ত উদ্যত বাচন ভঙ্গী। কথাবার্তার মধ্য দিয়ে সহসা মনটাই যেন উদ্দাম আবেগে বেরিয় আসছে। চলার ভঙ্গীতে কোন বাধা মানবো না ধরনের নাজরুলিক এক বিমুক্ত ছন্দ। দেখেই মনে হল একজন নতুন মানুষ দেখা হল। কমরেড আসাদ্দর আলী বলছেন “আমার মারাত্মক ত্রুটি ,প্রথম সাক্ষাতেই পরিচয় দূরে থাক্, হৃদ্যতা করা আরও দূরে থাক, সাধারণ কথাবার্তা বলতেও আড়ষ্টতা বোধ করি। কিন্তু সৈয়দ আকমল আমার সম্পূর্ণ বিপরীত। তাঁর হাতে পড়ে আমার আড়ষ্টতা বিপন্ন হয়ে পড়ল। প্রশ্নের পর প্রশ্নের বান ছুঁড়ে ছুঁড়ে আমাকে ঘর্মাক্ত, রক্তাক্ত করে তিনি যখন আবিষ্কার করলেন যে, আমি পাকিস্তান আন্দোলনের মত পূতঃ পবিত্র মহান কর্মে শরীক ছিলাম না, তিনি স্বস্তিই বোধ করলেন। বললেন, এই জন্যই এতদিন আপনার সাথে সাক্ষাত হয়নি। অর্থাৎ আমি সিলেট জেলার একজন জলজ্যান্ত মানুষ হয়েও সৈয়দ আকমলের সঙ্গে পরিচিত নই। এমন বিষ্ময়কর অবস্থাটা এতক্ষন তাঁর কাছে অসহনীয় ছিল। পরবর্তী সময়ে দেখেছি সৈয়দের অপরিচিত মানুষ এই জেলাতে সত্যিই বিরল ছিল।

আমরা অনেক সময় সভা সমিতিতে নীরবে নিভৃতে থেকে প্রায় অদেখা অজানা অবস্থায় যাওয়া আসা করতে পারতাম। কিন্তু সৈয়দ আকমলের উপস্থিতি যে কোন আসরে তাঁকে মনে রাখার মত করে সকল মানুষের দৃষ্টি আকর্ষন না করে পারতো না।

ছাত্র আন্দোলন, রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন, যুবলীগ সংগঠন, কৃষক শ্রমিকের সংগ্রাম, যুক্তফ্রন্টের কাজকর্ম সহ বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগঠনে সৈয়দ আকমল হোসেনের সঙ্গে আমরা যারা কাজ করেছি সকলেই তাঁকে একটু সমীহ করে চলতো । কাজ কর্মের ফাঁকে ত্র“টি বিচ্যুতি চোখে পড়লে ক্ষমাহীন আক্রমণ। প্রগতিশীল আন্দোলনে বৃহত্তর সিলেট জেলায় কুলাউড়া ও শমসেরনগরকে কেন্দ্র করে একটি বিরাট কর্মী বাহিনী গড়ে উঠেছিল। রাজা সাহেব, সালাম সাহেব, সৈয়দ আকমল, সৈয়দ ছয়ফুল হোসেন এবং মফিজ আলীই এই বাহিনীর সেনাপতি মন্ডলীর ভূমিকা পালন করতেন। মফিজ আলী বয়সে সকলের ছোট হলেও সাংগঠনিক কাজে বিশেষতঃ শ্রমিক কৃষক সংগঠনে তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ছিল। রাজা সাহেব এবং সালাম সাহেবও নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে অদ্বিতীয় ছিলেন। সৈয়দ সাহেবের কাজ ছিল সর্বব্যাপী। তাঁকে ছেড়ে কোন কাজই যেন পূর্ণ হতনা। ডাঃ পবন, সৈয়দ বশির আলী, মোঃ আজম, তাহির মাষ্টার, শরীফ উল্লাহ ভাই, আবু কায়সার খান, সীতারাম বর্মন, রাধাকিষণ কৈরী, বেচু হরিমন, আজির উদ্দিন খান, আব্দুল মালিক, তাহির আলম, পংকুমিয়া, সুনীল লৌহ, আফজন, শিশির দে, ফৌরদৌস, স্বপন, ছাত্রনেতা শফকাতুল ওয়াহেদ, গজনফর আলী প্রমুখ কর্মীর বয়সের ব্যবধান যতই থাকুক, সৈয়দ আকমল যখন একসঙ্গে বসে আলাপ আলোচনা করতেন মনে হতো একটি বিরাট পরিবারের কয়েকজন ভাই যেন একত্রে বসেছেন। সৈয়দ সাহেব যেন সকলের বড় ভাই। ভাষা আন্দোলনের পর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কমিউনিস্টরা যুক্তফ্রন্ট গঠন করার কাজে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। তখন কমিউনিস্টরা পার্টির নামে প্রকাশ্যে একটি ছোট টিম রেখে আওয়ামীলীগ ও গণতন্ত্রী দলের ভিতরে থেকে কাজ করার কৌশল গ্রহণ করেন। আসদ্দর আলীরা আওয়ামীলীগে এবং অন্য কয়েকজন গণতন্ত্রী দলে কাজ করতেন। সৈয়দ আকমল গণতন্ত্রী দলে। কিন্তু পার্টি কর্তৃক সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর সকলেই সুশৃংখলভাবেই পার্টির সিদ্ধান্ত অনুসারে কাজ করেন ।যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পরে ৯২(ক) ধারা জারী করে প্রায় আড়াই হাজার রাজনৈতিককে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গে দু’ভাগ হয়। কমিউনিস্ট পার্টিরকে বেআইনী ঘোষনা করা হয়। কিছুদিন আত্মগোপনে থাকার পর মনিরউদ্দিন সাহেব এবং কমরেড আসদ্দর আলী এক সঙ্গে ধরা পড়ন।মনির উদ্দিন সাহেব গণতন্ত্রী দলের জেলা কমিটির সম্পাদক। মাহমুদ আলী সাহেব তখন লোকদের ডেকে নিয়ে পৃথকভাবে আলাপ আলোচনা করতেন। আকমল হোসেন তাঁর খুবই ঘনিষ্ট লোক ছিলেন। পার্টির পক্ষ থেকে আসদ্দর আলীকে সৈয়দ সাহেবের সাথে যোগাযোগ করতে বলা হয়।

সৈয়দ সাহেব প্রথমে পার্টির সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। তাঁর মতে পার্টির লেজুর বৃত্তি ছাড়াই কাজ করা উচিত ছিল। পার্টির কৌশল সম্পর্কে তাঁকে ব্যাখ্যা করা হলে তিনি অবশেষে এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হন। অনেকের ধারণা ছিল সৈয়দ সাহেব কোন নিয়ম মানেন না। কিন্তু জনশ্রুতি আছে , অনেকের মতে সৈয়দ সাহেব বিদ্রোহী ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি বিশৃঙ্খল ছিলেন না। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সৎ, নিয়মনিষ্ঠ, রুচিবান ও ন্যায়পরায়ণ লোক ছিলেন। শ্রমিক কৃষক ছাত্র জনতার প্রত্যেকটি আন্দোলন সংগ্রামের পুরোভাগে সৈয়দ আকমল হোসেন ছিলেন। রাজাসাহেবের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল খুবই মধুর। রাজা সাহেব তাঁর নিজের সঙ্গে সৈয়দ সাহেবের প্রথম সাক্ষাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রায়ই সরস ভাষায় বলতেন, একদিন তাঁর সম্মুখ দিয়ে কট কট আওয়জ তুলে দ্রুতগতিতে একজন লোক বেপরোয়াভাবে ‘হায়দার মঞ্জিলে’ প্রবেশ করেন। তাঁর ব্যতিক্রমর্ধী গতিবিধিতে রাজাসাহেবের মনে ঔৎসুক্যের সৃষ্টি হয়। ফেরার পথে তিনি আগন্তুককে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, তিনি কোথায় কার কাছে গিয়েছিলেন? উত্তরে আগন্তুক তার নিজস্ব বিশিষ্ট ভঙ্গিতে বলেন, “আমি হায়দার খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করে এলাম।” রাজা সাহেব অবাক বিষ্ময়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বললেন, আমি এই সর্বপ্রথম আমাদের বাড়ীতে আব্বা হুজুরের নাম উচ্চারণ করতে শুনলাম। এই বাড়িতে রেওয়াজই ছিল বড় হুজুর-ছোট হুজুর, বলে তছলিম করে এই বাড়ির পুরুষদের উল্লেখ করা।

পরবর্ত্তী সময়ে যতটি আন্দোলন হয় তার সঙ্গে সৈয়দ সাহেব কোন না কোন ভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৫৬ সালে ফুলবাড়ী নামক স্থানে পৃথ্বিমপাশা কৃষি খামার সম্প্রসারনের জন্য কৃষকদের উচ্ছেদ শুরু হয়। হাতি দিয়ে কৃষকদের ঘরবাড়ি ভাংগার জন্য জমিদারের বাহিনী অগ্রসর হতে থাকে। রাজা সাহেব, সৈয়দ আকমল, তারা মিয়া, সৈয়দ সাইফুল হোসেন প্রমুখ নেতার নেতৃত্বে কৃষক সমিতি প্রতিরোধ গড়ে তুলে। আন্দোলনের চাপে তৎকালীন সরকার জমিদারদের মাহফিজখানা বাজেয়াপ্ত করে এবং সেই স্থানে পুলিশ ক্যাম্প বসায় জমিদারী জুলুমের বিরুদ্ধে।

১৯৫৬ সালে রেলওয়ে ধর্মঘটকে উপলক্ষ করে সৈয়দ সাহেবকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৬৭ সালে বড়লেখার ধামাই চা বাগানের শ্রমিকরা ধর্মঘট করে। সিলেটের ৮৭টি চা বাগানের শ্রমিক এই ধর্মঘটে প্রতি সমর্থন জানায়। ধর্মঘট ১৪দিন চলে। কর্তৃপক্ষ ধর্মঘটের শ্রমিকদের খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে। বাহির থেকে ধামাই এর শ্রমিকদের জন্য খাদ্য সাহায্য বন্ধ করার উদ্দেশ্যে পুলিশ এবং ই, পি, আর সকল সড়ক পথ অবরোধ করে রাখে। তখন মফিজ আলী, আবু কায়সার খান, সুনীল লোহ, পংকু মিয়া প্রমুখ সহযোগে গঠিত কমিউনিস্ট পার্টির টিমই চা শ্রমিক আন্দোলনের দায়িত্বে ছিলেন। জেলা কেন্দ্র থেকেও পার্টি নেতারা প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রাখতেন। রেলযোগে খাদ্য সরবরাহ করে ধামাই অবরোধের প্রতিবিধান চিন্তা করা হয়। ধামাইয়ে রেল ষ্টেশন ছিল না। রেল কর্মীদের উপর সৈয়দ সাহেবের বিরাট প্রভাব ছিল। তাঁর সাহায্যে ধামাইয়ের নিকট রেল থামানোর ব্যবস্থা করে খাদ্য দ্রব্য ফেলে দেয়া হত। সেখান থেকে মহিলা শ্রমিকগণ কাপড়ের আঁচলে করে চাল ডাল গোপন পথে বাগানে নিয়ে যেতেন।

১৯৭০ সালে নির্বাচন বানচাল করার ষড়যন্ত্রের (?) অপরাধে অন্যান্যদের সঙ্গে সৈয়দ সাহেব এবংকমরেড আসদ্দর আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়। অন্যদিকে সেই সময়ে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির কোন কোন নেতা আসদ্দর আলীর উপর খুব বিক্ষুব্ধ ছিলেন। তাদের অভিযোগ ছিল (১) সোভিয়েত রাশিয়া সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বলে আসদ্দর আলী বিশ্বাস করতেন না না। (২) তিনি নির্বাচনের পক্ষে ছিলেন । (৩) কমরেড চারু মজুমদারের লাইন সঠিক মনে করতেন না। (৪) তখন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্খাই প্রধান জাতীয় প্রবণতা ছিল বলে কমরেড আসদ্দরের ধারণা ছিল সৈয়দ আকমলও কমরেড আসদ্দরের প্রতি এই অভিযোগ বিরুপ ছিলেন। জেলে প্রথম আলাপেই তিনি অকপটে এ কথা স্বীকার করেন। তিনি মুখ কাটা বলেই সবাই জানতেন। আসদ্দরকে কিছু কাটা কাটা কথাও তিনি শুনান। তাঁর অভিযোগের উত্তরে কমরেড আসদ্দর বলেছিলেন “আমার বিরুদ্ধে উপরোক্ত অভিযোগগুলো সত্য। কিন্তু এতে আমার দোষ কোথায়? আমার বিশ্বাস বা ধারণার কথাতো আমি নির্দিষ্ট ফোরামের কাউকে বলিনি। দ্বীতিয়তঃ আমি পার্টির নিয়ম শৃংখলার বিরোধী কোন কাজ করেছি বলে পার্টি থেকে আমার বিরুদ্ধে কোন নির্দিষ্ট অভিযোগ তো আনা হয় নাই। আমার কথায় বিশ্বাসগুলোর পক্ষে বিশেষ কোন যুক্তি না দেখিয়ে ১৯৬৯ সালের বাস্তব অবস্থা এখানেও বর্ণনা করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করছি।

ষাট দশক থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট ও বামপন্থিরা ‘মস্কো লাইন’ ও ‘চীনা লাইন’ এর পথ ধরে বিভক্ত হয়ে দুই বিপরীত ধারায় কাজ করেছেন। এই দশকের শেষ দিকে দুই ধারার অনুসারীদের বিশেষ করে কৃষক শ্রমিক ছাত্র বুদ্ধিজীবী মহলে তীব্র বিক্ষোভ ও বিদ্রোহের মন মানসিকতা বিরাজ করছিল।

১৯৬৯ সালে সমশেরনগর চা বাগানের শ্রমিক কর্মী নীরাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। খবর পেয়ে গভীর উৎকন্ঠা নিয়ে সবাইসসিলেট থেকে রওয়ানা হয় কিন্তু সমশেরনগর পোঁছেই দেখে এলাহী কান্ড। হাজার হাজার শ্রমিক কৃষক পাহাড় কামলা ও ছাত্র কর্মীদের সমাগমে শোভাযাত্রার শ্লোগনে সমশেরনগরে সেদিন সংগ্রামের জোয়ার ডেকেছিল। সৈয়দ আকমল তখন জেলা কৃষক সমিতির সম্পাদক। শ্রমিক নেতা সৈয়দ আকমল হোসেনের নেতৃত্বে শ্রমিক কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে দূর্বার দুর্ণিবার জনসংগ্রামের উজ্জ্বল সম্ভাবনা সেদিন সমশের নগরে তৈরী হয়েছিল। তার সঙ্গে জেলার আন্দোলন সংগ্রামের যোগাযোগ রক্ষা করা কঠিন ছিল। চীন সোভিয়েত বিরোধের দিকে না তাকিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সকল কমিউনিস্ট ও বামপন্থিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে যদি সকল শ্রেণী সংগ্রামের স্রোতধারার গতিমুখ সার্বিক মুক্তির দিকে প্রবাহিত করতে পারতেন তখন সকল গণতন্ত্রকামী ও স্বাধীনতাকামী শক্তিকে সংগঠিত করা সম্ভ হতো। মাওলানা ভাসানী সহ জাতীয় নেতারা তখন কমিউনিস্টদের সঙ্গে দৃঢ় মৈত্রী স্থাপনকে পূন্যের কাজ মনে করতেন। সোভিয়েত রাশিয়া, ভারত প্রভৃতি দেশ মুক্তি সংগ্রামের প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন জানাত।কমরেড আসদ্দরের আলোচনা শেষ হওয়ার আগেই সৈয়দ সাহেব বললেন, “আপনি আপনার কথা পার্টির কাছে লিখিত ভাবে জানান।” এই বলে নিজস্ব ভঙ্গিতে দ্রুতবেগে বেরিয়ে গিয়ে তিনি অন্যান্য কাজে লেগে গেলেন।॥জেলেও তাঁর এক মুহুর্ত অবসর থাকার জো ছিল না। জেলে ফল ফুলের বাগান ও সব্জী বাগানের কাজ কর্ম ছাড়াও কয়েদীদের বিভিন্ন কাজ করতেন তিনি ১৯৭১ সালে সংবাদের আহমেদুল কবির সহ আবার গ্রেফতার হন এবং ছাড়া পান । সংগ্রামের সময় চাপের মুখে বিতর্কিত ভুমিকার জন্য ৭২ সালে আত্মগোপন করেন ।১৯৮৫ সালে ৩০ শে জানুয়ারী সদাহাস্য উজ্জল এই সংগ্রামী নেতা ইহলোক ত্যাগ করেন । ( চলবে )

 

৭১ এর স্মৃতি — কুলাউড়া -পর্ব – ২৫

 

সৈয়দ শাকিল আহাদ

 

মুক্তি যুদ্ধ তো আর এক মাসে হয়নি , দীর্ঘ নয় মাস এই যুদ্ধের সময় কত কষ্টে কেটেছে জীবন তার বর্ণনা কি এত সহজে বলে শেষ করা সম্ভব ? তবুও কিছু ঘটনা , কিছু বর্ণনা উল্লেখ করে নতুন প্রজন্মের কাছে কিছু তথ্য দেবার তাগিদ অনুভব করেই এই লেখা , অসাবধানতাবশত ভুল ত্রুটি মার্জনীয় ।

৭১ সালে ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় শুরু হয় পাকিস্তানি হানাদার দের বর্বর আক্রমন , ক্রমেই তা সারাদেশে ছড়িয়ে পরে , তারই ধারাবাহিকতায় মৌলভীবাজার মহকুমা শহর থেকে ১৯ মাইল দুরে সিলেট জেলার অন্যতম উল্লেখযোগ্য থানা ‘কুলাউড়া’য় হানাদার বাহিনীরা আসে ৪১ দিন পরে অর্থাৎ ৬ই মে সোমবার রাতে , আর আমি তখন কুলাউড়ার উছলা পাড়া খান সাহেবের বাড়ীতে ছোট্ট শিশু , এই ৪১,দিন কুলাউড়া ছিল শত্রু মুক্ত ,

পাকিরা এসেই ওরা অবস্তান নেয় ও ক্যাম্প তৈরী করে কুলাউড়া হাসপাতালে , গার্লস স্কুলে , নবীন চন্দ্র স্কুলে এবং পৃথ্বিমপাশা নবাব বাড়ির একাংশে ।

কুলাউড়া আসার পথে পাকিস্তানী সৈন্যদের বহনকারী বহর ব্রাম্মনবাজার পৌছালে সেখানকার ঐ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এ কে এম ইউসুফ আলী সহ বেশ কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ী ও একদল সাধারন লোকজন নিয়ে পাকিস্তান জিন্দাবাদ , পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দিতে দিতে পাকিস্তানী পতাকা হাতে নিয়ে ঐ বহরের সাথে যোগ দেন ও কিছু সংখ্যক সিপাহীর সমন্ন্বয়ে বাজারের হিন্দু মালিকানাধিন দোকান গুলি ভাংচুর ও লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ করে ।তার কিছু সময় পরেই সেই সৈন্যবহর কুলাউড়ার দিকে অগ্রসর হতে থাকে ।

ইতিমধ্যে কুলাউড়ায় পৌছে যায় পাকিস্তানী মিলিটারীদের কুলাউড়া আগমনের সংবাদ ।

প্রসংগত উল্লেখ্য কুলাউড়ার কয়েকজন সাহসী বীর সন্তানের অবদানের কথা ,আত্বত্যাগের কথা উল্লেখ না করে পারছি না যাদেরকে সব সময় স্যালুট জানাই।যারা সেদিন বীরত্বের সাথে তৈরি করেছিলেন প্রতিরোধ বাহিনী

নেতৃত্বে ছিলেন বেশ কয়েক জন যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন , জুবেদ চৌধুরী ,জয়নাল আবেদিন,ব্যরিষটার আব্দুল মোন্তাকিম চৌধুরী , আব্দুল জব্বার ,আব্দুল লতিফ খান ,নওয়াব আলী সরওয়ার খান চুন্নু ,নওয়াব আলী সফদর খান রাজা সাহেব ,মছাদুর রহমান , আব্দুল মতিন ,তজম্মুল আলি ,সৈয়দ জামাল উদ্দিন ,আজির উদ্দিন আহম্মেদ , মুকিম উদ্দিন আহম্মেদ , অমিয়াংসু সেন ,লুৎফুর রহমান চৌধুরী হেলাল , মতি উদ্দিন আহম্মেদ, আসকির মিয়া সহ আরো অনেকেই ।

মৌলভীবাজার থেকে পাক বাহিনী কুলাউড়া আসছে শুনে সেদিন প্রতিরোধ বাহিনীর পুর্বের সিদ্ধান্ত মোতাবেক নির্দেশমতে, কামারকান্দি গ্রামের মুজাহিদ সদস্য আসকীর আলী , রামপাশা গ্রামের হাবিবউল্লাহ যিনি জীপ চালাচ্ছিলেন এবং রহিম খান ,চাতলগাও এলাকার কাফুয়ার পুলের সামনে এরাই প্রথম মুখামুখি হন এবং পাক বাহিনীর কুলাউড়া প্রবেশে বাঁধা দেন , আছকীর মিয়া যিনি অস্রচালনাতে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন প্রচন্ড সাহসীকতার পরিচয় দেন , ঐ মুহুর্তে ,শুরু হয় গোলাগুলি ,

তাৎক্ষনিক খবর পেয়ে আওয়ামী লীগের অফিস থেকে এসে যোগ দেন আব্দুল জব্বার , মছাদুর রহমান মুকিমউদ্দিন আহম্মেদ,

ঐ সম্মুখযুদ্ধে গুলি বিনিময়ের এক পর্যায়ে আসকীর মিয়া ও

হাবিব উল্লাহর জীপ উল্টে যায় । ঘটনা স্থলেই শহীদ হন হাবিব উল্লাহ ,আসকীর মিয়া গুলিবিদ্ধ অবস্তায় গাজিপুরের দিকে যাওয়ার পথে শাহাদত বরণ করেন । মুক্তি যুদ্ধে কুলাউড়ার এই দুই জনই প্রথম শহীদ হোন ।রহিম মিয়া ও অন্যান্যরা কোন রকমে পাশ্ববর্তী গ্রামে দৌড়ে পালিয়ে বেঁচে যান ।

প্রতিরোধকারীদের হত্যার পর মিলিটারীরা পাশ্ববর্তী চাতল গাঁও গ্রামে ঢুকে অত্যাচার নির্যাতন শুরু করে পাকিস্তানী সৈন্যদের অত্যাচার থেকে রেহাই পাবার আশায় ঐ গ্রামের অনেকেই পাকিস্তানী পতাকা হাতে নিয়ে পাকিস্তান জিন্দাবাদ , পাকিস্তান জিন্দাবাদ, স্লোগান দিতে দিতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন , কিন্তু তাতেও কোন ফল হয়নি ।সবাই কে ধরে এনে ,এক সারীতে দাঁড় করিয়ে এর মধ্যথেকে পাঁচজনকে মসজিদের সামনে এনে হত্যা করে মিলিটারীরা ,হতভাগ্য এই পাঁচ জন ছিলেন চাতলগাঁওয়ের কটু মিয়া ,ও আব্দুল কুদ্দুস ,টেংরা এলাকার দুজন ও হিংগাজিয়া এলাকার একজন ।

পাকিস্তানী আর্মিরা তান্ডব শেষে কুলাউড়ার দিকে এগুলে পরে আস্তে আস্তে বেড়িয়ে এসে গ্রামবাসী চারজন শহীদদের লাশ পাশবর্তী একটি গোরস্তানে নিয়ে সমাহিত করেন।হিঙ্গাজিয়া এলাকার অপর শহীদের লাশ তার গ্রামবাসী এসে ,তাদের গ্রামে নিয়ে গিয়ে কবর দেন।

ইতোমধ্যে পাক বাহিনী কুলাউড়াতে প্রবেশ করে ।সেখানে পলায়নপর অবস্থায় গুলি করে হত্যা করে ছাত্রলীগ নেতা নূরুল ইসলাম ভুইয়া ও অপর একজন ছাত্রলীগ কর্মীকে , কুলাউড়া সিলেট রেলপথের সিগন্যাল পোস্টের কাছে চন্দন দা বা রামব্রীজ দা দের বাড়ীর পাশ্বে এই দুই সম্ভাবনা ময় তরুনকে সেদিন

কবরস্ত করা হয়েছিল ,

যে কবরটির চিন্হ আজ বিলীন হয়ে গেছে ।

আওয়ামী লীগ করতেন হোটেল ব্যবসায়ী মোবারক আলী , পাকিস্তানীরা তাকে খুঁজে না পেয়ে তার ম্যানেজার আব্দুর রহমানকে ধরে নিয়ে হাসপাতালের সামনে গুলি করে হত্যা করে ।একই সাথে হত্যা করে ছলিম উল্লাহ কে ঐ দিনই কয়েকজন অতি উৎসাহী মীরজাফরের সহায়তায় বাড়ি থেকে ধরে আনে কুলাউড়ার পশ্চিমদিকের হোসেনপুর গ্রামের নানু মিয়া ও ধীরেন্দ্র শীলকে ,হস্তান্তর করে জল্লাদদের কাছে , কি ভয়ংকর পরিস্থিতি ?অনেক কাকুতি মিনতি করেও প্রান বাঁচাতে পারেন নি কেউই .. পরিণামে তাদেরও মৃত্যু হয় ।এ ভাবেই হত্যার খেলা চলতে থাকে কুলাউড়া মুক্ত হওয়ার পুর্ব পর্যন্ত ।

কুলাউড়ায় গঠিত হয়েছিল তথাকথিত শান্তি কমিটি ,যে কমিটির অন্যতম সদস্যের মধ্যে ছিল মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ,এ,কে,এম ইউসুফ ,বাতিন মিয়া , বদরুদ্দিন আহম্মেদ বদই মিয়া ,চেরাগ আলী ,আব্দুল বারী , ইউসুফ মিয়া ,মমরোজ মিয়া ,চটই মিয়া ,দরজ মিয়া , আলী ইয়াত্তর খান ,ছালেকুর রহমান , রিয়াজুল্লাহ মাস্টার , আফ্তাব উদ্দিন চৌধুরী সহ বহু পাকিস্তান পন্থিরা এই কমিটিতে যোগ দিয়েছিলেন

দেশ স্বাধীনের পর আমার মনে আছে কুলাউড়া রেল ষ্টেশন থেকে কোন ট্রেন লংলা হয়ে আখাউড়ার দিকে গেলে শেষ সিগন্যালটি অর্থাৎ নবীনচন্দ্র স্কুল থেকে গাজিপুর গামী রাস্তার পয়েন্ট এর পুর্ব পাশ্বে চিড়ল নামক অতিক্রমের সময় যাত্রীরা জানালা দিয়ে দেখাতো , ঐ যে ,ঐ জায়গায় পাকিস্তানীরা বাঙ্গালীদের গুলি করে মারতো , সারা ট্রেনের যাত্রীরা তখন খুউব আক্ষেপ করতো ,, ঠিক তেমনি বিপরীত দিকে কুলাউড়ার উত্তর দিকের শেষ সিগন্যাল পয়েন্টেও , যে রেলপথটি বরমচাল হয়ে সিলেট গিয়েছে ,সড়ক পথটি জুড়ি বড়লেখার দিকে গিয়েছে ঐ পয়েন্টে অনেক কেই গুলি করে মেরেছে এবং এদের অনেকের ই অন্যান্য আপনজনদেরকেও ধরে এনে হত্যা করা হয়েছিল যাদের লাশ তাদের স্বজনদের কাছে পৌছায়নি ,এখন আর কেউ ঐ সিগনাল পয়েন্ট অতিক্রম কালে ৭১ এর বধ্য ভুমির কথা বলে না।( চলবে)

 

৭১ এর স্মৃতি ৩৮ ( কুলাউড়া -৪)

সৈয়দ শাকিল আহাদ

 

১৯৭১ সালের ৬ ই মে র কথা , যখন পাকিস্তানি হানাদারেরা কুলাউড়া এসে পড়েছে , সেদিন সবাই হন্তদন্ত হয়ে দিগ্বিদিক ছুটছিল তখন ১০ টা ১১টার দিকে আমার ছোট মামা মনির আলম কাকে যেন বলে দক্ষিন বাজার থেকে একটি রিক্সা নিজে চালিয়ে নিয়ে এসেছিলেন , বাড়ি থেকে মুল্যবান ট্রাংক গুলো নিরাপদ স্থান অর্থাৎ আমাদের এক নানা মানে হাসিমপুরের মকবুল আলী (মহরী )নানার বাড়ীতে পৌছানোর জন্য । তিনটি বড় বড় ট্রাংক , জমিজমার দলিলাদি মুল্যবান কাগজপত্র , গয়নাগাটি সহ , আমাকে সাথে নিয়ে ছোট মামা রিকশাওয়ালা সেজে পাকিদের সামনে দিয়ে এই দক্ষিন বাজারের উপর দিয়ে হাসিমপুর মকবুল আলী নানার বাড়িতে গিয়েছিলাম , যুদ্ধের সময় বেশ কিছুদিন আমরা সেখানে নিরাপদে ছিলাম ।

দক্ষিন বাজারকে তাই সর্বদাই মনে পড়ে ।কুলাউড়াতে কাটানো শৈশবের সেই দিনগুলোতে তো আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয় তবে সেই স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য আমার সাথে অনেকেই আছেন যারা ঘাপটি মেরে চুপচাপ বসে আছেন , মাঝে মাঝে নিজেদের মোবাইল বা সেলফোনটি নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে থাকেন শৈশবের স্মৃতি মনে করে , বন্ধু বান্ধবদের খোঁজেন , কিছু কথা বলার জন্য এবং পুরোনো স্মৃতি রোমমন্থন করো আনন্দ নেবার জন্য , কোন একটা ভাল লাগা নিয়ে তো সময় কাটাতে হবে ? তাদের জন্য কিছু একটা করতে ইচ্ছে হয় , সেই দায় থেকেই আমার চেষ্টা , কিছু একটা লিখে রাখতে পারলে হয়তো আগামীতে কারো না কারো কাজে লাগবে । কি কাজে লাগবে ? কিভাবে লাগবে ? কেন লাগবে ? কখন লাগবে সেটা ভেবে কোন সুরাহা করতে পারবো বলে মনে হয় না । কিন্তু আমি বিশ্বাস করি কিছু লেখে রাখা ভাল , কিন্তু লিখবো কি করে ? লেখা তো আসে না , লিখতে হলে পড়তে হয় । সময় করে মনোযোগ দিয়ে পড়তে হয় , কখন পড়বো ? পড়ার সময় কোথায় ? গত কিছু কালে যে পরিমান বই পেয়েছি পড়ার জন্য , যদি আজ থেকেই পড়া শুরু করি ,এক নাগাড়ে পড়লেও কমপক্ষে বিশ বছর সময় লাগবে শেষ করতে , এর ভিতর তো আগামীতে আরো বই সংগ্রহ হবে , মাঝে কয়েক বছর আগে ভেবে রেখেছিলাম এক নাগারে প্রথমে এক সপ্তাহ বই পড়বো তারপরে এক মাস তার পর তিন মাস তারপর এক বছর ক্রমান্নয়ে বই পড়বো , কি হবে জানিনা ইহজীবনে সেই ইচ্ছার “ বই পড়া হবে কিনা ? বই পড়ার ইচ্ছা ছিল ছোট বেলা থেকে , পারিনি তা পুরন করতে , আগামীতে তা পুরণ হবে কিনা তারও কোন নিশ্চয়তা নেই ।

একটু একা থাকলেই শুধু মনে পড়ে অতীতের কথা , পুরোনো দিনের কথা ঃ-

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন “

“পুরানো সেই দিনের কথা

ভুলবি কিরে হায়

ও সেই চোখের দেখা প্রাণের কথা

সে কি ভোলা যায় ?”সত্বিই ভোলা যায় না , যেমনি ভুলতে পারছি না কুলাউড়ার পাঠশালার কথা , পাঠশালা বলতে দক্ষিন বাজার বি.এইচ ( বশিরুল হুসেন ) প্রাইমারী স্কুলকেই বুঝাতে চেষ্টা করছি ।

১৯৭২ সালে আমার নানা মরহুম এ এম আশরাফ আলী খান সাহেব যাকে কুলাউড়ার জনগন সাবরেজিষ্টার সাহেব বলতো , আমাকে ঐ স্কুলে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করান ও ভর্তি করিয়ে ফেরত আশার সময় একটি কাঠের শ্লেট ও চকপেন্সিল এবং কমলা / গোলাপী রংগের বাল্যশিক্ষা বই কিনে দিয়েছিলেন ।ফেরার পথে মোড়ে মোমিনের দোকান থেকে কাঁচের বয়ামে রক্ষিত ছিল , লুডুর ছক্কার মত রং বেরং এর ছোট ছোট কয়েকটি চকলেট ও লেবেন চুস কিনে দিয়েছিলেন । সেই মমিন সাহেবের দোকানের সামনেই রাস্তার মুখে একটি ছোট কালভার্ট ছিল যা অনেকের হয়তো মনে আছে , দুই পাশ্বে চারজন লোক বসার উপোযোগী একটু উচুকরে বাঁধানো পাকা করা ওয়ালও ছিল । মমিন সাহেবেরা দুই ভাই ঐ দোকানে বসতেন , উনাদের ব্যবহার অনেক ভাল ছিলো এবং সব ভাল ভাল জিনিষ পাওয়া যেতো তাদের দোকানে , উনারা নোয়াখালীর লোক ছিলেন এবং কুলাউড়ায় এসে ব্যবসা শুরু করেন এবং ঐখানে অনেক দিন ভাল ব্যবসা করেছেন , হারিস নামে তাদের দোকানের একজন সহযোগী ছিল যিনি পরবর্তীতে দুইটা দোকান পরে আরেকটি দোকান শুরু করেছিলেন । যুদ্ধের সময় একমাত্র উনাদের দোকানই সবসময় খোলা পাওয়া যেতো এবং তারা সকলকেই ততকালীন সেই কঠিন সময়ে কুলাউড়াবাসীদের অনেক সহযোগীতা করেছেন । এই রাস্তাই ঐ দিকে অর্থাৎ মনুর , মইন্তাম , আমতৈল , কাদিপুর , ব্রাহ্মনবাজার ,কিয়াতলা , পেকুর বাজার , হাসিমপুর ,বরমচাল , ভাটেরা ইত্যাদি জায়গায় যাবার জন্য অন্যতম রাস্তা ছিল , তাও ইঁটের হেরিংবুন দেওয়া রাস্তা মাগুরার পর্যন্ত ছিল এর পরে তা সম্পুর্নই মাটির রাস্তাই ছিল ।মমিনের দোকানের পুবপাস্বে মক্তোদিন নানার রাইস মিল ও রেশনের দোকানের পাশ দিয়ে একটি চিপা গলি রেল ষ্টেশনের দিকে গিয়েছে , ঐ রাস্তায় ও রেলের খালের উপর একটি কালভার্ট ছিল , সেই ইঁটের রাস্তা যোগে রেলওয়ে হাসপাতালের পাশদিয়ে সহজে ষ্টেশনে গিয়ে পৌছানো যেত ।

মমিনের দোকানের পরেই কয়েকটি দোকান ছিল তারপর ছিল কালীবাড়ী পাশ্বেই ছিল একটি টিউবঅয়েল যা থেকে স্বচ্ছ খাবার পানি বের হতো এবং আঁশে পাশের বেশ কয়েকটি বাড়ী দোকানপাট ও হোটেল সমুহে এই টিউবঅয়েল এর পানি নিয়ে পানির চাহিদা পুরণ হতো । সাপ্লাই থেকেও সারাক্ষন খাবার পানি আসতো এমনি একটি কল ছিল ইউনিয়ন অফিসের পশ্চিম পাশে কুলাউড়া থানার উত্তরে মোবারকের হোটেলের পাশ্বে ।

বিপরীতে দক্ষিন বাজার বা সকালের বাজার ছিল , বিকাল বেলা বাজার বসতো উত্তর বাজারে । দক্ষিন বাজারের গলির মুখে লাগোয়া একটি ছোট্ট মিষ্টির দোকান ছিল , যেখানে গরম গরম পরটা সুজীর হালুয়া বা তুষা শিরনী ও রং বেরং এর বুন্দিয়া বা বুরিন্দা পাওয়া যেতো ।

মাঝে মাঝে জিলাপী ও সমুচা ও বিক্রি হতো । সেই দোকানের সামনেই ছিল লাকড়ীর চুলা । সবসময় একটা ধুয়া ধুয়া পরিবেশ লক্ষ্যনীয় ছিল ।

বি এইচ স্কুলের সাথীদের মধ্যে , বুলন , নান্টু , মতিন এরা উত্তর বাজারের দিক থেকে আসতো আর আমাদের পাশ্বের বাড়ীর ফখরু ( মোকাবি্বর হোসেন ) সাফী , ও লষ্করপুরের মামুনের কথা বেশ মনে আছে । মনে আছে কনা স্যারের কথা , মুনিম স্যারের কথা , শহীদ স্যারের কথা , শহীদ স্যার একটু গাট্টাগুট্টা টাইপের ছিলেন , হাটতেন বেত হাতে নিয়ে । তিনি রেলওয়ে স্কুল থেকে বদলী হয়ে বি এইচ স্কুল বা পাঠশালায় এসেছিলেন ।

আরো মনে আছে বড় দা র কথা এবং আমিরুননবী সারের কথা , তিনি অনেক ফিটফাট থাকতেন এবং আরবী পড়াতেন ।

স্কুল থেকে ফেরার পথে মাঝে মাঝে মিষ্টির দোকান থেকে জিলাপী কিনতাম তাও আবার বাকিতে , মামা পরে পয়সা দিয়ে দিবেন এই রকম প্রতিশ্রুতিতে বাকি পাওয়া যেতো আর তখন সব দোকানীরাই কুলাউড়ার সকলকেই চিনতো । একটি বেকারীর বিস্কিট ই ছিল ভাল কিছু খাবার । যা কিনে বাড়িতে এনে খেতে হতো , তাও মচা বা ঠোংগায় ভরে , তখন তো আর পলিথিনের ব্যাগ ছিল না , খাকী কাগজের ঠোংগাই ছিল অন্যতম ভরসা ।

শৈশবের সেই ফেলে আসা দিনগুলোতে টাকার অভাবে অনেক স্বপ্ন পুরন করা হয়নি , ইতিমধ্যে অনেক স্বপ্নই মরে গেছে, আজ টাকা আছে বটে কিন্তু সেই স্বপ্নও নেই এবং তা পূরণের ইচ্ছেটা আর নেই ।

ফেলে আসা সেই শৈশবের সময় যেন বিকেলের স্মৃতি, এখন সময় চলে একমুখী হয়ে এক দেয়ালের ভেতরে সারাক্ষন মোবাইল টিপে মাঝে মাঝে খোলা আকাশের দিকে তাকালে মন ছুটে যায় বৃষ্টি ভেজা সেই দিনে যেদিন টাকার অভাবে ফুটবল কিনতে পারি নাই আমরা অনেকেই , মাঠে খেলায় নাম লেখাতে পারি নাই বুট কেনা ছিল না বলে , আমাদের অনেক স্মৃতি , বৃষ্টিতে ভিজে জাম্বুরা কে ফুটবল বানিয়ে কামাল ভাই , মলাই ভাই , রহমান ( লন্ডন প্রবাসী ) , রুমেল , সুলতান দের সাথে নিয়ে কাদায় ফুটবল খেলতাম বাড়ীর পিছনের বন্দে । আহারে কি সেই মধুর স্মৃতি

খুব ইচ্ছে হয় শৈশবের সেই বেলায় ফিরে যেতে। ইচ্ছে হয় সেই সব সাথী বন্ধুদের ডেকে বলি , চলনা আবার হারিয়ে যাই স্মৃতিগুলো কুড়িয়ে সঙ্গে করে সেই শৈশবে।

আসলে শৈশবকাল হল মানুষের এমন একটি সময় যেখানে থেকে যায় শুধু স্মৃতি এবং সেই সময়েই একটি শিশু চায় তার জীবনের মূল লক্ষ্যের দিকে যাওয়ার সঠিক পথ বেছে নিতে। আমার মনে নেই তখন কেউ কি আমাদেরকে বলেছিল কিনা যে তোমরা এই পথ বেছে নাও .. এভাবে চল .

শুধু সবাই বলতো ভাল করে পড়ালেখা কর , বড় হও , বড় হলে ডাক্তার ইন্জিনিয়র হতে পারবে , মানুষের মত মানুষ হতে পারবে ।

কুলাউড়ার সেই ময়মুরব্বী , বড়দের কথা , উপদেশ আজও কানে বাজে , তাদের অধিকাংশরাই আজ বেচে নেই , তাদের আত্বার শান্তি ও জান্নাত কামনা করছি । আমিন ।( চলবে)

 

।( ছবি কৃতজ্ঞতায় ঃ লিটন আহমেদ , ইউ এস এ , এবং তথ্য সংশোধন কৃতজ্ঞতায় আলেয়া আপা – ব্রাম্মনবাড়ীয়া )

৭১ এর স্মৃতি — (৮)

 

সৈয়দ শাকিল আহাদ

 

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ের দুর্দান্ত ঘটনাবহুল স্মৃতি ,বিশেষ করে সিলেট অন্চলের সীমান্ত ঘেষা চাবাগান পরিবেষ্টিত থানা শহর কুলাউড়ার উল্লেখ যোগ্য কিছু ঘটনার সাথে কিছু লোকের নাম ও চেহারা স্বয়ংক্রিয় ভাবেই চোখের সামনে ভাসতে থাকে । তেমনি এক জন হলেন রাজা সাহেব ,যেহেতু তখন আমার বয়স কম , বুদ্ধিসুদ্ধি তেমন হয়নি তবে ‘রাজা’বলতে , সেই এলাকার প্রধান ব্যাক্তি কেই বুঝতাম । মজার ব্যপার হলো রাজা সাহেব যেদিন কুলাউড়া আসতেন , সেদিন আমি আমাদের উছলাপারা খান সাহেবের বাড়ি থেকে দৌড়ে ফিল্ডের পশ্চিমে বটগাছের নিচে গিয়ে অপেক্ষায় থাকতাম কখন তিনি এই বড় রাস্তা দিয়ে ফিরবেন , তাকে একনজর দেখবো তার বহর সহ , অপেক্ষা করতে করতে কখন বেলা গড়িয়ে যেত তা টের পেতাম না আর রাজা সাহেবকেও দেখা হতো না ।তিনি কুলাউড়া আসলে মসজিদ সংলগ্ন রামগোপাল ফার্মেসির দোতালায় আড্ডা মারতেন , সকল রথী মহারথীর মিলন ঘটতো তখন সেখানে , মাঝে মাঝে থানার বিপরিতে ডাকবাংলায়ই বসতেন , তা ছাড়া মোবারক মিয়ার আজম বোডিংয়ে বসতো তাদের আড্ডা ।কুলাউড়াতে সেদিন পাকিস্তানী মিলিটারীদের আগমনের খবর পেয়ে পৃ্থিমপাশা ইউনিয়নের নবাব পরিবারের একাংশের অবাধ্য সদস্য রাজা সাহেবের চাচাতো ভাই মুসলীম লীগ নেতা নবাব আলী ইয়াওর খান দ্রুত দুইজন দূত মারফতে মিলিটারীদেরকে তার নিজ এলাকা পৃথিমপাশায় যাবার জন্য ,দূতদের নাম নাম সোনা মিয়া এবং আব্দুল খালেক বলে জানা যায় ,তাদের মারফতে দাওয়াত পাঠান ।

দাওয়াত পেয়ে ঐ মোতাবেক ক্যাপ্টেন দাউদের নেতৃত্বে চারটি জীপে করে ৭ ই মে বিকালে পাকবাহিনীর সদস্যরা রবির বাজার আলিনগর সীমান্ত ফাঁড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় ।

পাক সেনাদেরকে আলী নগর সীমান্ত ফাঁড়ীর দিকে রওয়ানা হওয়ার খবর পেয়ে নবাব ইয়াওর আলী খান রবির বাজারে এসে অপেক্ষা করতে থাকেন । মিলিটারীদের সাথে দেখা হওয়ার পর বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসাবে কিছু দিতে হয় মনে করে তাৎক্ষনিকভাবো রিক্সাচালক কুনুরকে তার জয়বাংলার খবর কি জানতে চাইলেই সে সালাম না দিয়ে গান শুরু করাতে তাকে ‘মুক্তিকামী ‘ উল্লেখ করে তাদের হাতে সোপর্দ করেন এবং নিজেও তাদের সাথে কুলাউড়ায় চলে আসেন । তিনি ছিলেন ঐ পরিবারের বেপরোয়া সদস্য ও পাকিস্তান পন্থী , অথচ ঐ নবাব বাড়ীরই প্রধান অংশের অন্যতম জনপ্রিয় সদস্য ছিলেন ,নবাব আলী সফদর খান ‘রাজা সাহেব ‘ অত্র অন্চলের যে সকল মানুষ , ও পরিবার পরিবার পরিজনদের নিয়ে সীমানা পেরিয়ে ভারতের কৈলাশহর , আগরতলা , কুকিশহর প্রভৃতি স্হানে ছিলেন , তিনি পরিবার সহ কৈলাস শহরে একমাস থাকার পর গৌড় নগরে , বর্তমানে জেলা শহর ছিলেন । তিনি পরিবারদের রেখে এসে কালাইজুড়ির নিজস্ব মুক্তি যোদ্ধার ক্যাম্পে থেকে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন সেখান থেকে ভারত গামী শরনার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও তাদের গমনপথে সর্বাত্তক সাহায্য সহযোগীতা করেন ।

লোকমুখে প্রচলিত আছে ওপারে যাবার পথে লুটেরারা অসহায় শরনার্থীদের কাছ থেকে মুল্যবান জিনিষপত্র নিয়ে যেত এবং অনেক ক্ষেত্রেই রাজা সাহেব তাদেরকে লোক মারফত ধরে এনে শাস্তি দিয়েছেন ।আসাম প্রাদেশিক পরিষদের মন্ত্রী পৃথিমপাশার নবাব আলী হায়দার খানের বড় ছেলে নবাব আলী সফদর খান রাজা সাহেব জন্মেছিলেন ১৯১৯ সালে ,তিনি ছিলেন অত্যানত্য অমায়িক , গরীব দু:খী ও মেহনতী মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের সংগ্রামের সাথী, জমিদার পরিবারে জন্মালেও তার চাল চলন স্বভাবে জমিদারী দাপট ছিল না ,১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে অত্যানত্য গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালন করেন ।পাকিস্তানী মিলিটারীরা কুলাউড়া আসলে পরে বহুবার তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল ।কিন্ত তিনি বেঁচে যান , এবং বাড়ি ঘর ফেলে ভারতের আগর তলায় স্ত্রী পুত্রদের অন্যত্র রেখে নিজে থেকেছেন শরনার্থী ক্যাম্পে ।তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন জমিদার পিতার বিরুদ্ধে , অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে , ১৯৭৪ সালে তিনি মারা যান ।আমরা তার বিদেহী আত্বার শান্তি কামনা করি আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন তাকে জান্নাত নসীব করুন । আমিন ।( চলবে )

৭১ এর স্মৃতি – জয়পাশা -পর্ব-২

 

যখন থেকে জ্ঞান হয়েছে তখন থেকেই জেনেছি ঐ জয়পাশা খন্দেগার বাড়ী বা জয়পাশা জমিদার বাড়ী আমার আব্বার মামার বাড়ী ,আর ঐ বাড়ীর সব মুরব্বীরা আমার দাদা অর্থাৎ মবুব দাদা , মাখন দাদা , অলি দাদা ও হবিব দাদা আমার আব্বার মামা মানেই আমার দাদা ,উনাদের বাবার নাম ছিল মৌলবী সৈয়দ হেদায়েত উল্লাহ , এই সৈয়দ হেদায়েত উল্লাহ আর আমার আব্বার নানা কিশোরগন্জের অন্যতম জমিদার দেওয়ান মান্নান দাদ খান যিনি বাংলার বার ভুইয়ার অন্যতম ঈশাখার ১৩ তম পুরুষ , তিনি সম্পর্কে আপন ভায়রা ভাই উনাদের শশুরালয় ছিল বর্তমান হবিগন্জ জেলার শায়েস্তাগন্জের দাউদনগর সৈয়দ বাড়ী ।

কুলাউড়ার অন্যতম সিংহপুরুষ হিসাবে খ্যাত জমিদার সৈয়দ কেফায়েত উল্লাহর দানকৃত জমির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কুলাউড়া রেল ষ্টেশন ও প্রথম কুলাউড়ার হাসপাতাল । কুলাউড়া স্টেশন রোডস্থ ডাকবাংলো , হাকালুকী হাওরের বাঁধ যা আজও খন্দেগার বাঁধ নামে পরিচিত , এই হাকালুকি হাওরে আজও তার ৭৫০ হালের ও অধিক জমি রয়েছে । জনাব কেফায়েত উল্লাহ ছিলেন অনারারী মেজিষ্ট্রেট ও দিল্লি কাউন্সিলের মেম্বার ।

জনাব কেফায়েত উল্লাহ বিয়ে করেন সিপাহসালার হযরত নাসিরউদ্দিন ( রঃ) এর বংশধর কুলাউড়া উপজেলার গিয়াসনগর গ্রামে ।তার ছেলে মৌলভী হেদায়েত উল্লাহ ও ছিলেন শৌর্য বির্যে মহান সুপুরুষ ও দানশীল জমিদার । তার দানকৃত জমিতে আজও দাড়িয়ে আছে কুলাউড়া ইউনিয়ন অফিস , কুলাউড়া থানা , কুলাউড়া সড়ক ও জনপথ অফিস । তিনি কয়েকটি চা বাগানের ও স্বত্বাধিকারী ছিলেন , যে গুলি হচ্ছে ,গাজিপুর , মেরীনা, দিলদারপুর , ক্লিবডন,বিজয়া ইত্যাদি ।

আর ঐ জয়পাশা জমিদার বাড়িতে আমার আব্বা সৈয়দ আব্দুল আহাদ মশকুর যেখানে ৫০ এর দশকের শেষে এবং ৬০ এর দশকের শুরুতে প্রচুর সময় কাটিয়েছেন , সেখানে ঐ বাড়ীটির সাথে সম্পৃক্ততাকে ভুলে গেলে চলবে কি করে ?

বিশেষ করে ৬০ এর দশকের শুরুতে আব্বা সৈয়দ আব্দুল আহাদ মশকুর যখন তার মামাতো বোন অর্থাৎ সৈয়দ মাহবুব উল্লাহ সাহেবের দ্বিতীয় মেয়ে সৈয়দা রাশিদা বেগমের সাথে বর্তমান কিশোরগন্জ জেলার বাজিত পুর নিবাসি জনাব ওয়াজেদুল ইসলাম বাচ্চু মিয়ার সাথে বিয়ে হয় , এই বাচ্চু মিয়া যিনি বাংলাদেশের সর্বপ্রথম সবচেয়ে বড়লোক হিসাবে খ্যাত ইসলাম গ্রুপের কর্নধার প্রয়াত জহিরুল ইসলাম সাহেবের ছোটভাই , বাচুচু মিয়াও ইসলাম গ্রুপের একজন পরিচালক এবং অত্যন্ত বিনয়ী ও পরোপোকারী এবং বিনয়ী ছিলেন ,তাদেরই বিয়ে উপলক্ষে মাসব্যাপি আনন্দ উৎসবে অংশগ্রহন করেছিলেন । আব্বার লেখালেখীর হাত ছিল অনেক ভাল ইতিমধ্যে বাংলা ও ইংরেজীতে “ জয়পাশার খন্দেগার পরিবারের “ নামক গ্রন্থ রচনা করে আব্বা ঐ পরিবারের কাছে সুলেখক , সাহিত্যিকে পরিনত হয়েছিলেন এবং রশিদা ফুপুর বিয়ে উপলক্ষে “ ফুল ও ভ্রমর “ নামে একটি উপহার পত্র লিখে ব্যপক জনপ্রিয়তা ও সুনাম অর্জন করেন তার উপর আবার আব্বার গানের গলা অনেক মিষ্টি ছিল তিনি যতেষ্ট সুন্দর গান করতেন এবং প্রতিদিনই সন্ধার পর এই বিয়ে উপলক্ষে জমজমাট গানের আসর বসতো , আশে পাশের অনেক আত্বীয় স্বজনের আসা যাওয়ায় মুখরিত থাকতো প্রতিদিনই ,তেমনি একদিন সন্ধায় বেড়াতে এসেছিলেন আমার নানী মরহুম মনিরুন্নেছা খাতুন , গান শুনে অনেক তারিফ বা প্রশংসা করেছিলেন , আর সেই সুবাদেই আমার প্রিয় লাকসামের লনী দাদী প্রস্তাব দিয়ে বসেন আমার নানীর কাছে ,

আম্মাকে তার ভাগিনা বউ হিসাবে পেতে চান ।

নানী প্রস্তাব গ্রহন করে বাড়ীতে এসে নানার সাথে কথা বলে সম্মতি জানান এবং অল্পদিনের মধ্যেই সৈয়দ মাহবুব উল্লাহ সাহেবের দ্বিতীয় মেয়ে রসিদা বিবির বিয়ের পরপরই মহাধুমধামে তাদের ভাগিনা সৈয়দ আব্দুল আহাদ মশকুরের সাথে বিয়ে সম্পন্ন হয় উছলাপারা খান বাহাদুর আমজদ আলীর বড়ছেলে খান সাহেব আশরাফ আলীর ছোট মেয়ে তখনকার কুলাউড়া গার্লস হাই স্কুলের সহকারী শিক্ষিকা ভাষাসৈনিক ছালেহা বেগমের সাথে ।পরপর দুইটি বিয়ে জয়পাশা সাহেব বাড়ীতে সমপন্ন হওয়াতে তখন ছোট্ট শহরের কুলাউড়ার সবচেয়ে আলোচিত ও উল্লেখ যোগ্য ঘটনা ছিল , যার ফলে ঐ বাড়িতে উৎসবমুখর এ

আনন্দঘন পরিবেশ বজায় ছিল দীর্ঘদিন । রশিদা ফুপুরা ছিলেন ১০ ভাইবোন ।দাদা সৈয়দ মাহবুবুল্লাহ আলিগড় বিশ্ব বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন ,তিনি কুলাউড়া আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন ,বিয়ে করেছিলেন অত্যান্ত সুন্দর পুতুলের মত এক রাজকন্যাকে , যিনি চাঁদপুরের বিখ্যাত রুপসা জমিদার বাড়ীর কন্যা ।

সৈয়দ মাহবুবুল্লাহ ওরফে মবুব দাদার সন্তান গন হলেন ঃ-

১) সৈয়দ ওবায়েদউল্লাহ মাসুম

২) সৈয়দা হুমায়রা বেগম

৩) সৈয়দা রাশিদা বেগম

৪) সৈয়দ শাব্বির উল্লাহ

৫) সৈয়দ বেবী বেগম বেবী

৬) সৈয়দা রেহানা বেগম খুকী

৭) সৈয়দা যুগনু বেগম

৮) সৈয়দ আহলুল্লাহ উজের

৯) সৈয়দা মুসাররাত বেগম

১০) সৈয়দা নাহিদ বেগম ।

উল্লেখ্য সর্বদা হাসিখুশী সবার বড় ছেলে মাসুম চাচা এই ইহজগতে নেই , ইন্নাল্লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহির রাজিউন ।

এই বংশের অন্যতম সৈয়দ মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ বর্তমানে জীবিত আছেন এবং পরিবার পরিজন নিয়ে সুদুর আমেরিকাতে অবস্তান করছেন । তার সন্তান গনের নাম হচ্ছে ঃ-

১) সৈয়দ মোঃ পারভেজ

২) সৈয়দ মোঃ জারজিস

৩) সৈয়দ মোঃ সাদিক

৪) সৈয়দ মোঃ হাদী

৫) সৈয়দ রওশন জাহান বেগম রুবা

৬) সৈয়দা তাসলিমা বেগম রুনা

উল্লেখ্য মবুব দাদা , দাদী , মাখন দাদা , দাদী , ওলী দাদা ও দাদী এবং তাদের বোনেরা সহ সকল কয়েকজন মেয়ের জামাই ও কয়েক জন ছেলে সহ হারিয়ে যাওয়া বংশধরদের জন্য জান্নাত কামনা করছি । আমিন। ( চলবে)

ছকাপন ——

সৈয়দ শাকিল আহাদ

 

আখাউড়া থেকে ট্রেন যোগে সিলেট যাওয়ার পথে

ছকাপন রেলওয়ে স্টেশন বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলায় অবস্থিত একটি রেলওয়ে স্টেশন , এই ষ্টেশনের পাশে একটি স্কুল ও মসজিদ মাদ্রাসা রয়েছে , কুলাউড়া ও বরমচাল ষ্টেশনের মধ‍্যবর্তী ছোট এই স্টেশনটিকে ঘিরে রয়েছে অনেক সম্ভাবনা ।

জনবল সংকটের কারণে বর্তমানে স্টেশনটি বন্ধ আছে৷ সিলেট এবং কুলাউড়ার মধ্যে ১৯১২ থেকে ১৯১৫ সালেরেললাইন নির্মাণ করা হয়।

এসময় কুলাউড়া-সিলেট লাইনের স্টেশন হিসেবে ছকাপন রেলওয়ে স্টেশন তৈরী করা হয়।

ছকাপন রেলওয়ে স্টেশনের উপর দিয়ে চলাচলকারী ট্রেনের তালিকা নিম্নে দেওয়া হলো:

পাহাড়িকা এক্সপ্রেস

পারাবত এক্সপ্রেস

উদয়ন এক্সপ্রেস

জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস

উপবন এক্সপ্রেস

কালনী এক্সপ্রেস

সুরমা এক্সপ্রেস

জালালাবাদ এক্সপ্রেস

কুশিয়ারা এক্সপ্রেস

সিলেট কমিউটার , উল্লিখিত ট্রেনে চলাচল কারী সকল যাত্রীরাই কমবেশী ছকাপন স্টেশনকে চিনে থাকবেন ।একমাত্র সিলেট থেকে ছেড়ে আসা

লাতু র ট্রেন খ্যাত লোকাল ট্রেন ও আখাউড়া গামী মিক্সড ট্রেন আসা যাবার সময় এই ছকাপন স্টেশনে দাড়াতো ।আর অন‍্য কোন ট্রেন এই ষ্টেশনে দাড়াতো না । আশে পাশের গ্রামের লোকজন এই স্টেশন ব‍্যবহার করে অতীতে অনেক বেশি যোগাযোগের ক্ষেত্রে সুবিধা ভোগ করেছেন , বিশেষ ভাবে ছকাপন , কিয়াতলা, ফরিদপুর , গোপীনাথপুর , রাফীনগর ,কৌলারশী, কাদিপুর , গোবিন্দপুর , হাসিমপুর , মনসুর , আমতৈল , মৈন্তাম, ভাগমতপুর, ইত্যাদি গ্রাম ঊল্লেখ যোগ‍্য বর্তমানে সড়ক পথের উন্নয়নের ফলে রেলপথে ভ্রমন বা ছকাপনের মত রেল ষ্টেশন এর গুরুত্ব নাই বললেই চলে । তবে অনেক স্মৃতি বিজরিত এই স্টেশন কে দেখলে আজও সিলেট বাসীর হৃদয়ে স্পন্দন জাগে ।

৭১ এর স্মৃতি (১৪ )

 

সৈয়দ শাকিল আহাদ

 

আমির আলী ও মনির আলম নামে আমার দুই মামা ছিলেন , দুইজনই প্রয়াত ,বড় মামা আমির আলী ছিলেন অত্যান্ত্ সাহসী , অনর্গল ভাল ইংরেজী বলতে পারতেন , খুবই সৌখিনতায় ভরপুর ছিল তার জীবন তার সাথে সখ্যতা ছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে প্রায় সকল সংগঠকদের সাথেই , তিনি সরাসরি যুদ্ধ করেনি কিন্তু তাদের সাথে ছিলেন তবে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের মত কখনই বাহাদুরী করেন নাই বা মুক্তিযাদ্ধা হিসাবে কোথাও নিজেকে জাহির করেন নাই , তবে জুবেদ মামা , জব্বার মামা , জয়নাল মামা ও আত্তর আলী মামা দের সাথে বর্ডার ক্রস করে , ধর্মনগর ক্যাম্পে গিয়েছিলেন , আবার দেশের মাটিতে বাবা মা বোনদের অবস্তান ও নিরাপত্তার স্বার্থে ফিরেও চলে এসেছিলেন ,এমনকি যখন কুলাউড়াতে পাকিস্তানীদের হটিয়ে প্রশিক্ষন ক্যাম্প হয়েছিল তখন কি কারনে জানি কমান্ডারের সাথে কথা কাটাকাটি করে বড় মামা তাকে চড় মেরে বেড়িয়ে পড়েন আর ক্যাম্পে যান নাই তবে সার্বিক ভাবে সাহায্য সহযোগীতা করেছিলেন ক্যাম্পের সকলকেই ,উছলাপারার খান সাহেবের ছেলে আমির আলীকে চিনতো না এমন লোক খুউব কমই ছিল , তার সহযোগীতার জন্যই তখন অনেক বর্ষীয়ান নেতা ও সংগঠকদের দেখেছি আমাদের বাড়ীতে আসা যাওয়া করতে , এবং ঐ সময় যখনই কুলাউড়ার কোন নামী দামী লোক , মুক্তিযুদ্ধের সংগঠককে বড় মামা বাড়িতে নিয়ে আসতো সাথে সাথেই

নানীকে দেখতাম ব্যস্ত হয়ে যেতে , তেমনি একদিনের ঘটনা , বাড়িতে আসলেন জব্বার মামা ও হোসেনপুরের আত্তর আলী মামা, বসলেন ফটিকে , তাদের সাথে ধুতি পরা একজন লম্বা হিন্দু নেতাও ছিলেন , উনাদের দেখে নানী কি খাওয়াবেন ব্যস্ত হয়ে পরলেন ,উনি বাড়ীর পিছনের পুকুর ঘাটের কাছে গিয়ে

ডাক দিলেন ,একবার পশ্চিম দক্ষিনকোণে মুখ করে “ হেরে বে সাফিয়ার বউ “ হলে আও ,

আরেক বার পশ্চিম উত্তর কোণে মুখ করে “ ওগো মৌলা’র মা “ রুশে আও ,বাড়িত মেমান আইছোইন, বাড়ির পশ্চিম দিকের দেওয়ার ( মাটির সীমানা প্রাচীর )পেরিয়ে ছুটে এসেছিলেন ,, সাফিয়া মামুর বউ এবং ইদ্রিস মামুর বউ ‘ মৌলা ভাইয়ের আম্মা ,

তারা দ্রুত নানুকে সহযোগীতা করেছিলেন,সকলকে আপ্যায়ন করার জন্য ,

তখন আমাদের বাড়িতে আলাদা গরুর ঘর ছিল , চা বানানোর জন্য সেদিন গরুর দুধ দোহানোর দৃশ্যও মনে পরে ,আর একটি বিষয় রং চা বা লিকার চা আপ্যায়ন করতে অনেক বেশি বিব্রত বোধ করতো সকলেই কারন লিকার চা খেত কিছুটা অসচ্ছল ও গরীব লোকেরা এই জাতীয় একটা ধারনা সর্বত্র বিরাজ মান ছিল ,

রান্নাঘর বা উন্দাল ও দুরত্বে ছিল , এখনকার মত এটাচ্ড বাথরুম বা রান্নাঘর কারো বাড়িতেই তেমন একটা দেখা যেতো না ,

হ্যা, বলছিলাম

জব্বার মামা’র কথা ,আত্তর মামার কথা ,

সেদিন বড় মামা উনাদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ,

, “ওগু অইল আমার বাইগনা ,

ছুটো আফার ফুয়া , “

সেই থেকে উনাদের” মামা মামা” বলেই ডাকতাম ,

জব্বার মামা ছিলেন

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সাবেক সংসদ সদস্য,তিনি ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয়দফা, ঊনসত্তরের অভ্যূত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সংঘঠক ও যোদ্ধা।

তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সভাপতি ও ১৯৬৪ সালে কুলাউড়া আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক।

বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার প্রতিবাদ করায় ১৯৭৭ সালে ১১মাস কারাবদ্ধও ছিলেন আমাদের এই

আব্দুল জব্বার মামা

আব্দুল জব্বার মামার জন্ম হয়েছিল ২৭ শে নভেম্বর ১৯৪৫ সালে আলাল পুর গ্রামে , তার পিতা ছিলেন মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ ।

তিনি ২৮ আগস্ট ১৯৯২ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৪৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারে তাকে ২০২০ সালে মরনোত্তর একুশে পদক প্রদান করে।

জব্বার মামার দুই ছেলে এলাকার জনহিতকর কার্যে জড়িত ও কুলাউড়ার উন্নয়নে সম্পৃক্ত , এক ছেলে আবু জাফর মোঃ রাজু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার প্রটোকল অফিসার এবং অন্যজন উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম । দুই ভাই ই বর্তমানে কুলাউড়া বাসীর প্রিয় ব্যক্তিত্ব , জনগনের সুখে দুংখে দুজনকেই নিঃস্বার্থভাবে এলাকার উন্নয়নে সম্পৃক্ত থেকে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা পালন করতে দেখা যায় ।

 

আরো সংবাদ পড়ুন

পুরাতন সংবাদ পড়ুন

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।

ওয়েবসাইট ডিজাইন : ইয়োলো হোস্ট