
৭১ এর স্মৃতি -পর্ব – ৩৬ (দক্ষিন বাজার )
সৈয়দ শাকিল আহাদ
৭১ সালের অনেক কথাই এখন অনেকের মনে নেই , তবে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের কথা এবং তার পরবর্তী সময়ের বেশ কিছু স্মৃতি , উল্লেখযোগ্য ঘটনা , স্থান, স্থাপনা , ব্যক্তির কথা ইত্যাদি স্বরণ করে মনে কিছুটা স্বস্তি পাই বলেই ততকালীন সময়ের কথা বার বার বলতে চেষ্টা করছি ।
কোন রকম ভুলত্রুটি হলে অবশ্যই তা ক্ষমার চোখে দেখার জন্য অনুরোধ রইল ।সেই সময়ের অনেক কথা কিছুটা সম সাময়িক এবং অনেক সিনিয়রদের সাথে কথা বলে উল্লেখযোগ্য ঘটনা সমুহের সত্যতা যাচাই করে কিছু কিছু সময়ে তাদের মতামত সহ , তা তুলে ধরার চেষ্টা করে চলেছি , এবং সত্বিই ৭০ এর দশকের শুরুর দিকের কথা লিখে অনেক পুলকিত হই তাই কিছু কথা না বললেই নয় ,তখন কুলাউড়ায় ছিলাম তাই কুলাউড়ার কথাই বলছি ..
কুলাউড়া জামে মসজিদের বিপরীতেই ছিল আলাউদ্দিন চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ী , যিনি একাধারে ১০ বছর কুলাউড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন উনার আরেক ভাই ছিল গিয়াসউদ্দিন আহম্মেদ বা জননেতা গিয়াস ভাই ৭১ এর ৭ ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সের ময়দানে সেই ঐতিহাসিক ভাষনের পর ৮ ই মার্চ ঢাকা থেকে কাগজের তৈরী এই স্বাধীন বাংলার পতাকা কুলাউড়ায় নিয়ে আসেন এবং ২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবসে কুলাউড়ার বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ঘরে , বাড়িতে সৈয়দ জামালউদ্দিন , গিয়াসউদ্দিন সহ আরো কয়েক জনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তা উত্তোলিত হয় ।ছাত্রলীগ নেতা গিয়াস ভাই পরবর্তীতে স্বাধীনতার পর জাসদের রাজনীতিতে সক্রিয় হন । কুলাউড়ার স্বাধীনতার ইতিহাসে গিয়াস উদ্দিনের কথা তার পরিবারের কথা না লিখে তা পরিপুর্নতা পাওয়া সম্ভব নয় ।
কুলাউড়ার সকলেই বাচ্চু মিয়ার বাড়ী বললেই সকলেই এই বাড়িটিকে চিনতো . বাড়ীর সামনে দুইটি দোকানের কথা হয়তো এখনও অনেকের মনে আছে “ আহমেদ ক্লথ ষ্টোর এবং রিয়াজ ক্লথ ষ্টোর , তবে আমরা বাচুচু মিয়ার বাড়ী বা বাবুল কামরুলদের বাড়ী হিসাবেই চিনতাম ।বাচ্চু মিয়ার ছেলে কামরুল বা ইফতেখারই আমার সাথে বি এইচ স্কুলে পড়তো , খুউব মিস্টি হাসির একটি হেংলা পাতলা ছেলে ছিল । সেই সুবাদে ঐ বাড়ীর ভীতরে যাওয়া আসার সুযোগ হয়েছিল , একে বারেই
ভোলার মত নয় তাদের বাড়ীর সুন্দর পরিবেশ, ভেতরটা ছিল খুবই চমৎকার , ভীতরে একটি পুকুর ও ছিল , খালাম্মা খুউব আদর করতেন ,খালাম্মার নাম ছিল আংগুরী খালা , তিনি সবসময় ঘোমটা দিয়ে থাকতেন ,উনার এক বোন ছিল যার নাম মনে আছে , তিনি হলেন “খেজুর খালা “বরমচালে থাকতেন । ইফতেখারদের এক বোন ছিল , সম্ভবত উনার নাম চামেলী , খালাম্মাদের বাড়ী ছিল বরমচাল এলাকায় । আর ইফতেখার দের চাচাতো চাচা ছিলেন হাজী জহির আলী এবং ইরফান আলী মামা ,উনারা মোটর গাড়ীর ব্যবসা করতেন তখন উনাদেরই বাস চলতো কুলাউড়া মৌলভীবাজার রুটে ,উনারা দক্ষিন বাজার মাগুরাতে বাসা তৈরী করে থাকতেন মুল বাড়ী ছিল সম্ভবত ভুকশীমইল। উনাদেরকে ও মামা ডাকতাম , তবে ইরফান আলী মামাকে দেখি নাই , তিনি চাতলগাও এলাকায় বাড়ী করেছিলেন এবং তার চেহারাও মনে নাই উনার ছেলেদের কথা মনে আছে , ফজলু ভাই , ফয়সল ভাই , মুনসী, ও রুমেল ।জহির আলী মামা একটু মোটা ছিলেন , প্রচুর পান খেতেন এবং মোটরষ্ট্যান্ড এ উনার গাড়ী ( বাস ) থাকতো , মোটর স্স্ট্যান্ড এ বেশ কয়েকটি দোকানের মধ্যে আলালপুরের হাফিজ সাহেবের ছোট ছেলের একটি চায়ের দোকান / হোটেল ছিল এবং মসজিদের পাশে কনা মিয়ার একটি রেষ্টুরেন্ট ছিল যাকে সবাই নাজমা হোটেল বলে চিনতো মোমিন মিয়ার ভুষি মেইলের দোকান , মক্তদির নানার রেশনের দোকান ইতাদি ,
জহির আলী মামার একটি পার্টস এর দোকান ছিল ,উনার বড়ছেলে মতলিব ভাই সেটি চালাতেন উনাকে পীর সাহেব বলে জানতো কুলাউড়ার জনগন , দীর্ঘদিন কুলাউড়া জামে মসজিদের কোষাধক্ষ ছিলেন তিনি ,মতলিব ভাইয়ের ছেলের নাম ছিল লিটন , সে এখন যুক্তরাজ্যে। জহির আলী মামার অপর ছেলেরা হলেন মাক্কু ভাই ও মহিব ভাই , মাসুম ।
মাক্কু ভাই এলাকার কাউন্সিলর হিসাবে অনেক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন , তিনি ও একজন দারুন ক্রীড়া অনুরাগী ছিলেন ।জায়েদা আপা নামে জহির আলি মামার এক মেয়ের সাথে এখনও যোগাযোগ আছে , তিনি আমার বড় বোন এডভোকেট সৈয়দা ফেরদৌস আরা লাকীর বান্ধবীদের অন্যতম একজন । এই পরিবারের ভাইদের মধ্যে কে যে কোন মামার ছেলে ? তা নিয়ে প্রায়ই আমার গন্ডোগোল হয়ে যেতো , হয়তো এখনও লেগেছে ।
আলাউদ্দিন চেয়ারম্যান সাহেব এর পাশের বাসার আর এক বোনের কথা মনে আছে তিনি হলেন আলেয়া আপা বা আইলা আপা , বহুবছর পর ফেস বুকের কল্যানে এবং এই গ্রুপে লেখালেখীর সুবাদে উনার সাথে যোগাযোগ হয়েছে । তবে অদ্যাবধী উনার সাথে দেখা হয়নি , বর্তমানে ঐ “ আলেয়া আপা বা আইলা আপা “ ব্রাম্ব্রনবাড়ীয়াতে আছেন , শীঘ্রই তার সাথে দেখা করবো সংকল্প করেছি । আইলা আপার আব্বা পুলিশের কর্মকর্তা ছিলেন ,আলাউদ্দিন চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ীর পুর্বদিকে রেলওয়ে কোলোনীতে থাকতো আরো দুইটি বোন , তাদের এর কথা ও মনে পড়ছে উনারা হলো নাদিরা আপা ও সেতারা আপা , নাদিরা আপার ভাইদের কথাও মনে আছে একজন হলেন মকবুল ভাই ওঅন্যজন হলেন হাবিব ভাই , উনাদের আব্বা “ আবুল ফজল “ টি টি ই “ অনেক ফর্সা সুন্দর ও একজন ভাল লোক ছিলেন , উনাদের কোয়ার্টারের পাশেই ছিলেন , আসাদুল হক ( গার্ড) নানার বাসা , তিনি ও রেলে চাকরী করতেন , ট্রেনের পরিচালক ( গার্ড) ছিলেন । পরবর্তীতে আমাদের বাড়ীর পাশে রহমান দের কাছ থেকে জমি কিনে বাড়ী তৈরী করে স্থিত হন । তার ছেলে মেয়েদের কথাও মনে আছে , এরা হলো লাবলু , লিটু , জলি , ডলি , লুসি ও হ্যাপি । এরা সকলেই এখন যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী বাসিন্দা ।
কুলাউড়া জামে মসজিদ সংলগ্ন রামগোপাল ফার্মেসীর কথা বার বার মনে হয় । কারন এই ফার্মেসীতে ডুকেই দুই দিকে দুইটি হাতাওয়ালা কাঠের বেন্চ ছিল । এই ফার্মেসীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন অত্যন্ত্য বিনয়ী একজন মানবতাপরায়ন ব্যক্তি , নাম তার শ্রী রসেন্দ্র কুমার ভ্ট্টাচার্য্য , এই ফার্মেসীর মাধ্যমে এই এলাকার অর্থাৎ সমগ্র কুলাউড়া , জুড়ি , ব্রাম্বনবাজার , টেংরা , রবির বাজার , শমশেরনগর ,লংলা , টিলাগাঁও , ভাটেরা, বরমচাল ইত্যাদি এলাকার এবং সকল চা বাগান সমুহের ঔষধ এই রাম গোপাল ফার্মেসী থেকেই যেতো , রামগোপাল ফার্মেসী ফেনীর জেনিথ ল্যাবরেটরী থেকে ঔষধ আনতো ॥
কুলাউড়া মসজিদের কিছুটা পিছনে পশ্চিমে ছিল রসেন্দ্র ভটের বিশাল বাড়ি যাকে সবাই ভটের বাড়ী বলেই জানতো ।
তার এক ছেলে ছিল চুনু ভট , তিনি চিকিৎসা শাস্ব্রে নিয়োজিত ছিলেন , অত্যন্ত্য দক্ষতার সাথে রোগীদের রোগের বর্ননা শুনে ফার্মেসীর ভীতরে পর্দা সরিয়ে কাঁচের শিশিতে মিকচার তৈরী করে দিতেন । মিকচারের শিশিতে দাগ কাটা থাকতো , সেই দাগ কাটার ঔষধের দুই তিন দাগ খাওয়ার পর রোগ ভাল হয়ে যেতো , আঁশে পাশের দশ গ্রামে এই মিকচারের খ্যাতি ছিল প্রচুর ।রসেন্দ্র ভটের তিন ছেলে ও সাত মেয়ে ছিল । বড় ছেলে ইন্ডিয়াতে থাকতেন , দ্বিতীয় ছেলে ছিলেন ঐ চুনু ভট আর ছোট ছেলের নাম ছিল ভানু ভট্টাচার্য , ভানু ভট একটু লাজুক প্রকৃতির ছিলেন ।
ঐ বাড়ীর এক দিদির নাম ছিল পম্মাদি , উনাদের আম্মা অর্থাৎ পম্পাদির আম্মা বা কাকিমা খুউব সুন্দরী ছিলেন সম্ভবত উনিই সজল দার আম্মা , উনিই পুরো সংসার চালাতেন , উনাদের বাড়ীতে অনেক কামলা ( কাজের লোক ) থাকতো ।আলাদা অনেক গুলো ঘর ছিল , বাড়ীতে গোলাপ ফুলের গাছ , পাতা বাহার , জবা মেহেদী ইত্যাদির গাছ ছিল । একজন ঠাকুমা ও ছিলেন তবে তিনি কখনই বারান্দা বা উঠানে বের হতেন না ।
ছোট বেলায় বহুবার শুনেছি রসেন্দ্র ভট তার সাত মেয়ের সাথে একজন পালক মেয়েকে ও বাডিতে রেখেছিলেন । বিভিন্ন এলাকার অনেক পীসি মাসি ও বিধবা এই ভটের বাড়ীতে থাকতেন, রসেন্দ্র ভট তাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্তা করতেন ।এবং পুরো পরিবারের সকল চাপ সামাল দিতেন কাকিমা অর্থাৎ পম্পাদীর আম্মা ।তা ছাড়াও অনেক বিপদ গ্রস্ত লোকের আস্রয়স্থল ছিল ঐ ভটের বাড়ী ।
উনার অনেক মানবিক গুনাবলীর মাঝে একটি গল্প আমি বহুবার বহু লোকের মুখে শুনেছি যা উল্লেখ না করে পারছি না । কুলাউড়াতে এস এস সি পরীক্ষা উপলক্ষে বিভিন্ন স্কুলের পরীক্ষার্থীরা বিভিন্ন বাড়িতে মেস করে থেকে পরীক্ষা দিতো । এবং তা পরীক্ষার কিছুদিন আগে থেকেই এসে থাকা শুরু করতো । এক মেট্রেকুলেশন বা এস এস সি পরীক্ষার্থী মেয়ে টাইফয়েডের কারনে হটাৎ হটাৎ অস্বাভাবিক আচরণ করায় ফলে বিরক্ত হয়ে ,তার রুমের অন্যান্য মেয়েরা মেয়েটিকে ট্রাংক ও বিছানা পত্র সহ বের করে দেয় । এবং মেয়েটি বি এইচ স্কুলের বারান্দায় ট্রাংক সহ এসে কান্না শুরু করে ।ঐ দিন স্কুলে বড় দা সহ সকল শিক্ষকেরা মিলে মেয়েটিকে বুঝিয়ে শান্ত করে , সিদ্ধান্ত নিলেন তাড়াতাড়ি মেয়েটির অভিভাবককে গাজীপুর বা ঐদিকের কোন এক গ্রামে খবর দেবেন ।
ইতিমধ্যে ঐ ঘটনা আঁশে পাশে জানাজানি হওয়াতে রসেন্দ্র ভট্ট মেয়েটির কথা শুনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলতে লাগলেন “ এত বড় ঘটনা ঘটে গেলো আমি জানলাম কেনে ? আমারে কেউ কুনতা কইলো না ?
আমরা সবাই তার পিতার মত , পিতা হয়ে কি তার নিরাপত্তা দিতে পারবো না ? এই মেয়েটি এখন চলে গেলে তার শিক্ষা জীবন শেষ হয়ে যাবে , না আমরা তা হতে দেবো না , একে আমি আমার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি , আমার মেয়েদের সাথে থাকবে , তখন বড়দা ইতস্থত করছিলেন এই বলে “ কি বলেন দাদা ?
মেয়েটি তো মুসলমান !!এবং সে সম্পুর্ন সুস্ত ও নয় ।
রসেন্দ্র ভট্ট তখন বলেছিলেন । তাতে কি ? সে আর আমি আমরা সকলেই মানুষ , মানুষ বলেই কথা ,
তিনি আর কথা না বাড়িতে একটি রিক্সা ডেকে মেয়েটির ট্রাংক ও বিছানা সহ তাকে বাড়ি নিয়ে গেলেন । কিছুক্ষন পর মেয়েটিকে তার বাড়িতে থাকার ব্যবস্তা করে দিয়ে স্কুলে এসে শিক্ষক “বড়দা “কে বলেছিলেন “ বড়দা আজ আমরা একজন পিতার দায়িত্ব পালন করেছি । তোমাকে ধন্যবাদ তুমি খবরটি তার পিতার কাছে পৌঁছায় নি “তা হলে হয়তো আমি এই দায়িত্ব নিতে পারতাম না । উল্লেখ্য মেয়েটি এস এস সি পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়েছিল ।
এক বার রসেন্দ্র ভট্ট ফেনী থেকে ফেরার পথে একটি এতিম ছেলে ও মেয়েকে বাড়িতে এনে থাকার ব্যবস্তা করেছিলেন ।
তার মহানুভবতার কথা বলে শেষ করার মত নয় ।
আজ তিনি নেই তার সম সাময়িক বা আগে পরে অনেকেই নেই , কুলাউড়া কুলাউড়ার জায়গায় রয়ে গেছে , কুলাউড়াতে বেড়েছে অনেক অচেনা লোকের দাপট , উঁচু উঁচু বাড়ীঘর , নতুন নতুন রাস্তা ঘাট , গাড়ী , বাড়ী , দালান কোঠা , রংবেবং এর মোটর সাইকেল , হোন্ডা ও পান্ডা বাহিনী , নতুন নতুন অফিস আদালত , বেড়েছে রেস্তোরা , রিসোর্ট ,স্কুল কলেজ মসজিদ মাদ্রসা, মন্দির , গির্জা ইত্যাদি তবে
যুদ্ধ কালীন সময়ে হাতে গোনা কয়েক টি পরিবারের কথা , কিছু স্থাপনার কথা ,অনেক জনের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য কিছু ব্যক্তি বর্গের কথা
বিশেষ করে রসেন্দ্র ভট্ট ,গিয়াস উদ্দিন , মোমেন মিয়া দের সহ জব্বার মিয়া , জুবেদ চৌধুরী , জয়নাল মিয়া , মবুব মিয়া ইত্যাদি বীরদেরকে শ্রদ্ধা জানাই , তাদের বিদ্বেহী আত্বার শান্তি এবং জান্নাত কামনা করছি । আমিন ।
( চলবে )
৭১ এর স্মৃতিতে কুলাউড়া-
“রামগোপাল ফার্মেসী “
সৈয়দ শাকিল আহাদ
কুলাঊড়ায় অনেক অনেক গুনীজনের জন্ম হয়েছে আমার এই ক্ষুদ্র ও সীমাবদ্ধ সামান্য জ্ঞান দ্বারা তাদের সবাইকে তুলে ধরা আমার পক্ষে সম্ভব নয় তবু ও যতটুকু মনে আছে সেই স্বরণশক্তি দিয়েই তাদের কারে কারো কথা কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করছি , এই মুহুর্তে একজনের কথা বিশেষ ভাবে মনে পড়ছে , চিকিৎসা সেবার যাঁদের অনবদ্য অবদান রয়েছে কুলাউড়ার জনগনের কাছে আমার জানামতে “রসেন্দ্র ভট “ ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম উল্লেখ্যযোগ্য একজন ভাল লোক ,
তিনি ছিলেন কুলাউড়ার নামকরা “রামগোপাল ফার্মেসির” প্রতিষ্ঠাতা যা এখনো দাড়িয়ে আছে কুলাঊড়া দক্ষিন বাজার মেইন রোডে।
১৯৭১ সালে এই ফার্মেসি সর্বদা খোলা থাকতো এবং সকলের কাছে একটি নিরাপদ প্রাথমিক চিকিৎসা সেবার স্থান , ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে সকলেই বিশেষ করে দুর দুরান্ত থেকে আগত খাসিয়া উপজাতীয় নারী পুরুষের বসার জায়গা হিসাবে পরিচিত ছিল , এই ফার্মেসী , ঢুকেই দুই পাশ্বে লম্বা কাঠের হাতল ওয়ালা বেন্চ ছিল , সামনে ছিল তিন চারটি চেয়ারও
রশেন্দ্র ভটের মাগুরাস্থ বসত বাড়িটিকে সবাই “ভটের বাড়ি “ বললে একনামে তখনও চিনতো এখনও চিনে । তিনি ছিলেন খুব মানবিক এবং খুবই সামাজিক। রসেন্দ্র ভট এর সুযোগ্য পুত্র চুনু ভট সবসময় বসতেন ফার্মেসীতে উভয়ের সাথেই আমার নানা মরহুম এ এম আশরাফ আলী (সাব রেজিষ্টার) সাহেব সহ সমগ্র কুলাউড়ার সম্ভ্রান্ত শ্রেনীর ও গরীব দুখী সকলের সাথেই ছিল একটা সুন্দর সৌজন্য সম্পর্ক ,
যা আজও আমাদের সকলের মনকে পোড়ায়। রামগোপাল ফার্মেসীতে একজন রাশভারী গম্ভীর প্রকৃতির খাটোমত কম্পাঊন্ডারও ছিলেন। যাকে খোকন বাবু নামে সবাই জানত। বাড়ীতে কারো ও যে কোন অসুখ হলেই আমরা রামগোপাল ফার্মেসীতে চুনু ভটের কাছে যেতাম।
চুনু ভট তখন অসুখের বিবরন শুনে ঐ খোকন নামের লোকটিকে কি কি যেন বলে দিতেন।খোকন বাবু সেই কথামালা অনুযায়ী পিছনে পর্দা সরিয়ে ল্যাবরেটরীতে ডুকে কাজ করতেন এবং বেশ কিছুক্ষন পরে এসে খাঁজ কাটা ছয় দাগের একটা কাগজ লাগানো তরল ঔষধে ভরা কাঁচের শিশি হাতে দিয়ে বলতেন দিনে তিনবাব খাবে।
আম্মা , নানু সহ বাড়ীর মুরব্বী রা খুউব মনোযোগের সাথে সেই ওষুধ খেতেন এবং খুব তারাতাড়ীই সেরে উঠতেন।
আমি কখনোই এসব ঔষধ ভাল করে খেতাম না। ঐ তরল ঔষধটাকে “মিকচার “বলা হত। আমারও আমার বোনের জ্বর হলে মিকচার দিয়ে যেতেন খোকন বাবু। আমরা কোনরকমে একদুই ডোজ খেয়ে বাকিটা ফেলে দিতাম। এই ছিল আমার মিকচার খাওয়ার দিনগুলি।
তো যাই হোক আমরা রসেন্দ্র ভটের কথায় ফিরে যাই , তিনি সামাজিক ও মানবিক কাজে খুবই উজ্জল একজন মানুষ ছিলেন।
রসেন্দ্র ভটের ছোট মেয়ে অন্জনা ও নাতনী পম্পা র কথাও মনে আছে ,উনারা আমাকে বেশ আদর করতেন , আমার নানাবাড়ী অর্থাৎ উছলা পাড়া খান সাহেবের বাড়ীতে একটি তেঁতুল গাছ ছিল , আর ঐ গাছের তেঁতুল আমি উনাদেরকে বেশ কয়েক বার খাওয়াছিলাম , আমার স্কুল ছিল কুলাউড়া পাঠশালা বলে খ্যাত বি এইচ স্কুল , সেই স্কুলে যাওয়া আসার জন্য আমরা পিছনে খোলা জমিন পেরিয়ে এই রশেন্দ্র ভটের বাড়ীর উপর দিয়ে চলাফেরা করতে পারতাম । সহজ দুরত্ব ও কাছে
থাকায় আমি ভটের বাড়ীর উপর দিয়ে বার বার গিয়েছি। দেখেছি ওদের বাড়ীতে উঠানের চারপাশে অনেক ছোট ছোট ঘর। বাঁশের বেড়া ও ছনের ছাউনি দেওয়া পরিচ্ছন্ন পরিবেশ।
জানতে চেয়েছি এত ঘরে কে থাকে ? সেই ছোটবেলার কথা অন্জনা দিদির কাছে শুনেছি বয়েজ স্কুলের বেশ কয়েকজন শিক্ষক থাকেন ঐ ঘরগুলোতে ।
বালিকা বিদ্যালয়ের দূর দূরান্তের অনেক ছাত্রীও থাকতেন তাদের কাউকেই থাকা খাওয়া বাবত কোন টাকা দিতে হত না। কোথাও কারো বিপদ হলে রসেন্দ্র ভট দ্রুত ছুটে এসে বলতেল আমি জানলাম না কেন। দেশভাগের পর শিলচর আসাম কাছার ইত্যাদি এলাকা থেকে বদলে আসা মানুষদের পাশে দাড়িয়েছিলেন ভিন্নধর্মী একজন অসাধারন মানুষ । তিনি তার দয়াদ্রতা ও মানবিক মানসিকতা দিয়ে আমাদেরকে অনেক কিছু শিক্ষিয়ে গেছেন । উল্লেখযোগ্য কিছু তো দিয়েছেন যা আমরা মনে রেখেছি , রাম গোপাল ফার্মেসির বর্তমান সত্ত্বাধিকারী তারই উত্তরসুরী সৌম্য প্রদীপ ভট্টাচার্য্য সজল ।
কুলাউড়ার নতুন প্রজন্মের অনেকেই এই গুণীজনদের নাম শুনে থাকবেন কিন্তু বর্তমানে তাদের নিয়ে , তাদের ব্যাপারে কোথাও বিষদ কোন আলোচনা হবে কিনা জানিনা তবে এই গ্রুপ স্মৃষ্টির মাধ্যমে কেউ কেউ অনেক গুণীজনের কথা , সুখের স্মৃতিচারণ করছেন , উল্লেখযোগ্য স্থানের বর্ণনা তুলে ধরছেন দেখে ভাল লাগছে । গ্রুপের সকলকে ঈদ ও নববর্ষের শুভেচছা ।
তথ্য সহযোগীতা ও কৃতজ্ঞতায় – আলেয়া চৌধুরী
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।