
৭১ এর স্মৃতি পর্ব – ৩৯ ( কুলাউড়া-৫)
সৈয়দ শাকিল আহাদ
কুলাউড়া শুধু বর্তমান সময়ের একটি মোটর সাইকেল বা অটোরিক্সার উঁচ্চ শব্দের শহর নয় , এদেশের একটি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর , সীমান্তঘেষা সম্ভাবনাময় উন্নত , শিক্ষিত উপজেলা , যেখানে রয়েছে বহু উজ্জল নক্ষত্রের জন্মভুমি , পীর ফকির অলী আওলীয়াদের পুন্যস্থান ,হাওরে পাহাড়ে ঘেরা সবুজে বর্নীল শ্যামল ভুমির ও চা বাগানের সমাহার , বিশাল জনগোষ্ঠির সমন্নয়ে সংগঠিত , ভাতৃত্ব ও সম্পৃতির বন্ধনে আবদ্ধ ,জাতি ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে সমুউন্নত বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য প্রিয় এই শহর ছোট্ট যা আমাদের গর্বের স্থান ,
“কুলাউড়া “ যার নামকরণের ইতিহাস জানতে ইচ্ছে জেগেছিল , বেশ কিছু তথ্য ও জনশ্রুতি পাই, ইতিহাস গবেষক হোসেনপুরের বাবু হীরেন্দ্র চন্দ্র দাসের লেখা ১৩৩৭ বাংলায় প্রকাশিত “ কুলাউড়ার জয়পাশার খন্দেগার পরিবার “ বইটি থেকে জানা যায় ,মনসুর গ্রামের প্রখ্যাত “দেওয়ান মামন্দ মনসুরের পিতামহ বা দাদা দেওয়ান মামন্দ মনোয়ারের ভাই মামন্দ কুলওয়ার বালক থাকাকালেই কুমার অবস্তায় মারা যান । তার স্মৃতি রক্ষার্থে তার ভাই জমিদার ‘মান মনোহর ‘তার জমিদারির পুর্ব অংশে একটি বাজার তৈরী করেন । সেই কুলা ওরের বাজার ই কালক্রমে “ কুলাউড়া “ রুপান্তরিত হয়েছে ।
এই এলাকার অধিকন্ত ইতিহাস জানার জন্যেও একটু আগে গিয়ে ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করা যেতে পারে।
ব্রিটিশরা এই অঞ্চলটিকে প্রায় দুইশ বছর শাসন-শোষণ করেছে। তাদের হাত থেকে স্বাধীনতার জন্যে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছে, জেল খেটেছে, দ্বীপান্তরে গিয়েছে। ১৯৪০ সালে ‘লাহোর প্রস্তাব’-এ ঠিক করা হয়েছিল ভারতবর্ষের যে অঞ্চলগুলোতে মুসলমান বেশি, সেরকম দুটি অঞ্চলকে নিয়ে দুটি দেশ এবং বাকি অঞ্চলটিকে নিয়ে আর একটি দেশ তৈরি করা হবে। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট যে এলাকা দুটিতে মুসলমানরা বেশি সেই এলাকা দুটি নিয়ে দুটি ভিন্ন দেশ না হয়ে পাকিস্তান নামে একটি দেশ এবং ১৫ আগস্ট বাকি অঞ্চলটিকে ভারত নামে অন্য একটি দেশে ভাগ করে দেয়া হলো। পাকিস্তান নামে পৃথিবীতে তখন অত্যন্ত বিচিত্র একটি দেশের জন্ম হলো, যে দেশের দুটি অংশ দুই জায়গায়। এখন যেটি পাকিস্তান সেটির নাম পশ্চিম পাকিস্তান এবং এখন যেটি বাংলাদেশ তার নাম পূর্ব পাকিস্তান। মাঝখানে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্ব এবং সেখানে রয়েছে ভিন্ন একটি দেশ- ভারত।
আরো উল্লেখ্য
“ মানুষের যতগুলো অনুভুতি আছে তার মাঝে সবচেয়ে সুন্দর অনুভুতি হচ্ছে ভালোবাসা। আর এই পৃথিবীতে যা কিছুকে ভালোবাসা সম্ভব তার মাঝে সবচেয়ে তীব্র ভালোবাসাটুকু হতে পারে শুধুমাত্র মাতৃভূমির জন্যে। যারা আজ কুলাউড়ায় বেচে নেই তাদের আত্বার শান্তি কামনা করছি যারা বর্তমানে বিদেশে কখনো নিজের মাতৃভূমির জন্যে ভালোবাসাটুকু অনুভব করেনি তাদের মতো দুর্ভাগা আর কেউ নেই। আমাদের খুব সৌভাগ্য আমাদের মাতৃভূমির জন্যে যে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিল তার ইতিহাস হচ্ছে গভীর আত্মত্যাগের ইতিহাস, অবিশ্বাস্য সাহস ও বীরত্বের ইতিহাস এবং বিশাল এক অর্জনের ইতিহাস। যখন কেউ এই আত্মত্যাগ, বীরত্ব আর অর্জনের ইতিহাস জানবে, তখন সে যে শুধুমাত্র দেশের জন্যে একটি গভীর ভালোবাসা আর মমতা অনুভব করবে তা নয়, এই দেশ, এই মানুষের কথা ভেবে গর্বে তার বুক ফুলে উঠবে।
আমাদের দুঃখী এই দেশটি আমাদের বড় ভালোবাসার দেশ, বড় মমতার দেশ।
যাঁরা জীবন বাজি রেখে এই স্বাধীন দেশটি আমাদেরকে এনে দিয়েছেন তাঁদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞাতার শেষ নেই।
৭১ এর সেই ভয়াবহ সময়ে যারা কিংবদন্তী হয়ে আছেন তাদের অন্যতম কয়েক জন হলেন ,রাজা সাহেব , জুবেদ চৌধুরী , জব্বার মিয়া , জয়নাল আবেদিন , আব্দুল লতিফ , গিয়াস উদ্দিন , সৈয়দ জামাল উদ্দিন প্রমুখ । আজকে যারা কুলাউড়ার নেতা , পিতা এরা বা এদের মাতা পিতা এক সময় কুলাউড়া থেকে দুরে
ভিভিন্ন গাঁও /পুর থেকে , পায়ে পেক মাথায় লুংগী হাতে জুতা নিয়ে কুলাউড়ায় এসে বিভিন্ন পুকুরে হাত পা ধুয়ে মজলীসে বসতে দেখা যেতো ।
আর তখন যেসব স্বাধীনতা বিরোধী, বিশ্বাসঘাতক, যুদ্ধাপরাধী এই স্বাধীন রাষ্ট্রটিকে গলা টিপে হত্যা করার চেষ্টা করছে তাদের জন্যে রয়েছে অত্নহীন ঘৃণা। আজ থেকে একশ বছর কিংবা হাজার বছর পরেও যতদিন বাংলাদেশ টিকে থাকবে, এই দেশের মানুষ স্বাধীনতা বিরোধী, বিশ্বাসঘাতক, যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করবে না।
আমরা চাই বর্তমান প্রজন্ম ঐ সকল জঘন্য ঘৃনিত ব্যাক্তিদের নিন্দা জানাক কিন্তু এই নিন্দা জানাতে গিয়ে তাদের পরবর্তী নিরঅপরাধ উত্তরসুরীদের অবজ্ঞা বা অবহেলা করাটা বোধ হয় সঠিক হবে না ।
আমরা স্বপ্ন দেখি আমাদের নতুন প্রজন্ম মাতৃভূমিতে ঘুরে ঘুরে অভিমানী মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করে তাদের হাত স্পর্শ করে বলবে, আমাদের একটি স্বাধীন দেশ দেয়ার জন্যে তোমরা যে সংগ্রাম করেছো যে ভালোবাসা দেখিয়েছে তাতে আমরা গর্বিত এবং তারা মুক্তিযোদ্ধাদের চোখের দিকে তাকিয়ে কোমল গলায় বলবে, আমরা তোমাদের কথা দিচ্ছি, তোমরা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলে আমরা সেই বাংলাদেশকে গড়ে তুলব।
তোমাদের রক্তের ঋণ আমরা শোধ করব।
এই কুলাউড়ার এক কৃতি সন্তান যিনি সামরিক বাহিনীর অবসবপ্রাপত মেজর নুরুল মান্নান চৌধুরী ( তারাজ ) এমনি একটি মহৎ কাজ করে যাচ্ছেন , গবেষনা করছেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি যখনই সময় পান , ছুটে যান তার কুলাউড়ার প্রত্যন্ত্য অন্চলে , খুঁজে ফিরেন জীবিত বা মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের , ভাল মন্দ খোঁজ খবর নেন তাদের পরিবারের , শ্রদ্ধা জানাই তার এই উদ্দোগকে ।
আমাদের সকলেরই খেয়াল রাখা দরকার আমাদের চারপাশে বয়সের ভারে নুয়ে পড়া স্বাধীনতার সপক্ষের বীরদের সামনে মোটর সাইকেলের উচ্চশব্দের হর্ন বাজিয়ে বীরত্ব দেখানো আর আগাছা পরগাছার মত হটাৎ গজিয়ে উঠা হাইব্রীড নেতাদের সাথে সেলফী তুলে নিজেকে ভাইরাল হওয়ার সংস্কৃতি পরিহার করে নিজের এবং পরিবারের অতীত ইতিহাস ঐতিয্যকে ভুলে বিবেক বর্জিত কার্যকলাপে জড়িত থাকার মাঝে কোন বাহাদুরী নেই , তাই আমি বিশ্বাস করি আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম সুগঠিত হবে , কতিপয় অসাধু উসৃংখল উঠতি তরুণদের সামাজিক শালীনতায় সুশৃংখল পর্যায়ে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হবে ।( চলবে )
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।