
৭১ এর স্মৃতি – পর্ব ৪০ ( কুলাউড়া -৬)
সৈয়দ শাকিল আহাদ
ইদানিং মনে পড়ছিল শুধু আমার মায়ের কথা ,
ভাষাসৈনিক ছালেহা বেগমের কথা ,
যুদ্ধের ৯ মাস সময় আমার আম্মার উছলাপারাতে দিনগুলো
কী তীব্র এক মানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়েই না কেটেছিল ?উনার বাবা অর্থাৎ আমার নানা , এ এম আশরাফ আলী , জেলা রেজিষ্টার ( সাব রেজিষ্টার সাহেব নামে পরিচিত ) কিছুতেই বাড়ি ছেড়ে যাবেন না এবং যান ও নাই , নিজের লাইসেন্সর করা বন্দুক কাছে নিয়ে নিজ বাড়িতেই ছিলেন । “ইনশাআল্লাহ আমার জীবন থাকতে আর বন্দুকের গুলী থাকতে তোমাদের কিছুই অনিষ্ট হবে না , মরতে হয় এ বাড়িতেই মরবো , কাপুরুষের মত পালিয়ে গিয়ে ভিনদেশে মরবো কেন ? “। উনার মা বা আমার নানি মনিরুন্নেছা খাতুন ( কুটি বিবি ) , ছোট দুই ভাই আমির আলী , মনির আলম , ও তিন সন্তান অর্থাৎ আমরা তিন ভাইবোন তখন আম্মাসহ ঐ কুলাউড়াতে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে দুর্বিসহ সময় অতিবাহিত করেছি ।
মাঝে কয়েকটি দিন হাসিমপুরের মকবুল আলী মহুরী নানার বাড়ীতে গিয়ে পরিবারের কয়েকজন কিছুদিন আস্রয়ে ছিলাম , ভয়াবহতা কমে গেলে আবার ঐ বাড়ীতেই ফিরে আসি ।
সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় পাক সেনা আর রাজাকারদের তাণ্ডবের কথা সকলের মুখে মুখে শুনে আম্মা খুউব উৎকন্ঠায় থাকতেন আব্বার কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছিল না , তিনি ঢাকায় ছিলেন , ঢাকার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল , রেডিও ই একমাত্র ভরসা ছিল ঢাকা সহ সারাদেশের খবর জানার , তা ও লুকিয়ে লুকিয়ে শুনতে হতো ।নানাবাড়িতে নানা ছাড়া কোন পুরুষ থাকতে পারতো না , কটাই মিয়া নামে চাতলগাও গ্রামের এর এক লোক সারাক্ষন গরু কয়েকটির খেয়াল রাখতো এবং সন্ধা হলে গরুগুলিকে গোয়ালে তুলে সে পশ্চিম দিক দিয়ে চাতল গাও এ তার বাড়ীতে চলে যেতো । “আবিরী” নামে এক কাজের মহিলা সব সময় নানা বাড়ীর কাজ করতো , মামারা হানাদার ও রাজাকারদের ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে থাকেন। বড় মামা আমির আলী মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন বলে রাজাকাররা ঘন ঘন বাড়ীতে আসতে থাকে আর বেশ কয়েকবার বাড়িতে এসে বড় মামাকে না পেয়ে , বাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়েছিল । সকলেই উৎকন্ঠায় থাকতে হতো কারন প্রতিদিনই পাকিদের জন্য রাজাকার ও কিছু চিন্হিত স্বাধীনতা বিরোধীদের দের দ্বারা স্থানীয় লোকদের ধরে এনে নির্যাতন শেষে রেল লাইনের পুর্বপাশে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হতো , ছিল হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের নিদর্শন বা বধ্যভুমি ।
নানা তার লাইসেন্স করা বন্দুক হাতে তাদের রুখেছিলেন ।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের তথ্য , ভারতে প্রশিক্ষণ, সম্মুখ যুদ্ধের বিবরণ এবং সহযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ এই সকল বিষয়বস্তু নিয়ে আগে কখনই ভাবি নাই লেখবো , তবে ততকালীন কিছু নেতার নেতৃত্বগুণ এবং যুদ্ধ কৌশল সামনা-সামনি না দেখে থাকলেই পারিবারিক ভাবে সংযোগে ছিলাম বিধায় , আঁশে পাশের অনেক শাহাদাত বরণের সময়ের কিছু মুহুর্ত, ইতিহাস ,উপস্থিত ঘটনা সম্পর্কে পরষ্পর শুনে তা হ্রদয়ে গেথে আছে , লেখা হয়ে আছে মনের মনিকোঠায় , সেই গৌরবের চিত্র একজন লেখক হিসাবে কিছু লিখে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছি । যা সত্বিই মারাত্বক
উপলব্ধিকর । সেই চিত্র ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে তার পাশে উপস্থিত থাকার মতই উপল্ব্ধি অনুভুত হচ্ছে সেই অমূল্য ঘটনা সমুহের ।
৭১ সালের কুলাউড়ার কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতার কথা অনেকেরই অজানা এবং তা নিয়ে কোন আলোচনা সমালোচনার অবকাশ আছে বলে তা মনে হয় না , কিছু কিছু লেখক গবেষকের চেষ্টা করেছেন তাদের নাম নিতে ও অবদান তুলে আনতে তাও খুবই সীমিত , এই লেখাটি থেকে এই গ্রুপের পাঠকেরা বা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম সেই ৭১ এর ঘটে যাওয়া ঘটনা সমুহের কিছুটা আভাস পাবেন বলে আমি দৃড় বিশ্বাস করি , যদিও আমি তেমন ভাল একজন বর্ননাকারী বা
উপস্থাপনকারি নই ।
এই গ্রুপে রয়েছেন হরেক রকম লোক , তাদের কেউ কেউ বয়সের ভারে কিছুটা নুয়ে পড়েছেন , কারো কারো রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল গভীরভাবে।
কেউবা রাজনীতি বিমুখ। অধ্যয়ন পর্যায় অতিবাহিত করছেন অধিকাংশ লোকের কেউ কেউ , আবার কেউ প্রবেশ করেছেন কর্মজীবনে এবং উঁচ্চ শিক্ষায় বিদেশ বিভুইয়ে । সকলের কাছেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আমার অসাবধানতাবশত কোন ভুল বা ব্যাখ্যায় কেউ মনে কষ্ট পেয়ে থাকলে , প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন ।
পাঠকদের মধ্যে আছেন অনেক শিক্ষক শিক্ষিকা ও বিভিন্ন শ্রেনীপেশীর সমাজে স্বীকৃত ব্যক্তিত্ব ,তাঁদের মধ্যেও কেউ কেউ সামরিক কেউ বা আধা সামরিক বাহিনীতে কর্মরত। পেশাজীবী, ও ব্যবসায়ী রয়েছেন । উল্লেখ্য কবি, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী সব শ্রেণী-পেশার মানুষ মিলেই হয়েছিল মুক্তিবাহিনী।
যাদের মধ্যে রয়েছেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, সাহিত্যিক। এক কাতারে দাঁড়িয়েছিলেন আদালত প্রাঙ্গণ ছেড়ে আইনজীবী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারি। চা কারখানার শ্রমিক, ক্ষেতের মজুর- সবাই একই কাফেলায়। সকল পরিচয় মুছে দিয়ে পরিচিতি পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। যুদ্ধ করেছেন স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনার জন্য। সেই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কয়েকজনকে বাছাই করা হয়েছে নানা দিক বিবেচনা করে , ঘুরে ফিরে হয়তো তাদের নামই বার বার সকলের সামনে আসছে তারাই পরিচিত হচ্ছেন বেশি বেশি তবে নাম না জানা অনেক বীরদের আত্বত্যাগ এবং বীরাঙ্গনা দের অবদান রয়েছে , রয়েছে সম্ভ্রমহানীর মত মর্মান্তিক ঘটনাও আমাদের এই অহংকারের বিষয়ে , যার নাম “ মুক্তিযুদ্ধ “ ।
মুক্তিযুদধ চলাকালিন সময়ে কুলাউড়ার আসে পাশে অনেক ছোট বড় সম্মুখ যুদ্ধ হয়েছিল । যার মধ্যে একটির জায়গায় কথা আমার বেশ মনে হচ্ছে, সেটি হলো “ চাতলাপুর “ যা উল্লেখ করতে পেরে আমি আপ্লুত হচ্ছি ।
আমার নানীর এক ভাই যার ডাক নাম ছিল ছুটই মিয়া ,ভাল নাম কুতুবুল হাসান চৌধুরী তিনি চিরকুমার ছিলেন , চাকরী করতেন চাতলাপুর চা বাগানে , সেখানে যে কয়জন টিলাবাবু ছিলেন , তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম , ঐ সময় নানী তার এই ভাইকে নিয়ে সর্বদা চিন্তিত থাকতেন আর আল্লাহপাকের কাছে তার জন্য দোওয়া চাইতেন , কারন চাতলাপুরে তখন যুদ্ধ চলছিল । পরবর্তীতে ঐ নানার মুখেই শোনা অনেক ঘটনার মাঝে একটি ছিল পল্কি সেতু ধংসের ইতিহাস যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় লেখা রয়েছে ।,
চাতলাপুর চা বাগান আর মুরইছড়া চা বাগানের দুরত্ব ছিল ১২/১৩ কিলোমিটার , চাতলাপুর বাগানটি শরীফপুর ইউনিয়নভুক্ত ছিল ।ঐ টুকু দুরত্বের মাঝে পাকিস্তানী মিলিটারীরা ও স্হানীয় যোগসাজেশকারী রাজাকারেরা সবসময় টহল দিত কারন এই পথে ভারত থেকে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা এদেশে প্রবেশ করতে পারতো ।
পাশ্ববর্তী ক্যাম্প থেকে এসে এই অন্চলে পাকিস্তানী বাহিনীর টহল ও চলাফেরার কারনে এদেশের অনেক সাধারন গ্রামবাসী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগকারী সোর্সদের মারাত্মক অসুবিধা হচ্ছিল বিধায় পাকিদের বিতারিত করার লক্ষ্যে এবং এই অন্চলের মুক্তিকামীদের কেউ কেউ কৌশলে বাধাগ্রস্ত করার উদ্দ্যেশ্যে ভিন্নপন্থা খোজে এবং তা হলো পল্কি সেতু । এই পল্কি সেতু ধ্বংস করার সিদ্ধান্তে উপনীত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দলে বিভক্ত হয়ে ২৬ জন সমর যোদ্ধা সেটি সম্ভবত ২৭সে মে রাত আড়াইটার সময় ।শফিকুর রহমান ও আব্দুস সালাম নামে দুইজন কমান্ডারের নেত্বৃত্বে দুইটি দলে বিভক্ত হয়ে ঐ পল্কি ব্রিজে ডিনামাইট চার্জ করে ব্রিজটি গুড়িয়ে দেওয়া হয় । প্রচন্ড শব্দের সাথে সাথেই পাকিস্তানী হানাদার ও মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে উভয়দিক থেকে গুলিবিনিময় দ্বারা শুরু হয় যুদ্ধ , ঐ যুদ্ধে তাৎক্ষনিক ভাবে একজন পাকিস্তানী হাবিলদার ও একজন রাজাকার নিহত হয় , আহত হয় অনেকেই তাদের মধ্যে অনেকের নাম বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গবেষকের লেখায় উঠে এসেছে , আমিও কয়েকজনের কথা স্বরন করছি , যেমন দেবেন্দ্র রায় , আরশাদ আলী , আহমদ আলী শাহ , আজবর আলী শাহ , সুন্দর আলী , আঁশই মিয়া , প্রমুখ ।
শ্রদ্ধা জানাই সেই সময়ে উপস্থিত সকল বীর সেনাদের ।( চলবে)
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।