
৭১ এর স্মৃতি ৩৮ ( কুলাউড়া -৪)
সৈয়দ শাকিল আহাদ
১৯৭১ সালের ৬ ই মে র কথা , যখন পাকিস্তানি হানাদারেরা কুলাউড়া এসে পড়েছে , সেদিন সবাই হন্তদন্ত হয়ে দিগ্বিদিক ছুটছিল তখন ১০ টা ১১টার দিকে আমার ছোট মামা মনির আলম কাকে যেন বলে দক্ষিন বাজার থেকে একটি রিক্সা নিজে চালিয়ে নিয়ে এসেছিলেন , বাড়ি থেকে মুল্যবান ট্রাংক গুলো নিরাপদ স্থান অর্থাৎ আমাদের এক নানা মানে হাসিমপুরের মকবুল আলী (মহরী )নানার বাড়ীতে পৌছানোর জন্য । তিনটি বড় বড় ট্রাংক , জমিজমার দলিলাদি মুল্যবান কাগজপত্র , গয়নাগাটি সহ , আমাকে সাথে নিয়ে ছোট মামা রিকশাওয়ালা সেজে পাকিদের সামনে দিয়ে এই দক্ষিন বাজারের উপর দিয়ে হাসিমপুর মকবুল আলী নানার বাড়িতে গিয়েছিলাম , যুদ্ধের সময় বেশ কিছুদিন আমরা সেখানে নিরাপদে ছিলাম ।
দক্ষিন বাজারকে তাই সর্বদাই মনে পড়ে ।কুলাউড়াতে কাটানো শৈশবের সেই দিনগুলোতে তো আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয় তবে সেই স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য আমার সাথে অনেকেই আছেন যারা ঘাপটি মেরে চুপচাপ বসে আছেন , মাঝে মাঝে নিজেদের মোবাইল বা সেলফোনটি নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে থাকেন শৈশবের স্মৃতি মনে করে , বন্ধু বান্ধবদের খোঁজেন , কিছু কথা বলার জন্য এবং পুরোনো স্মৃতি রোমমন্থন করো আনন্দ নেবার জন্য , কোন একটা ভাল লাগা নিয়ে তো সময় কাটাতে হবে ? তাদের জন্য কিছু একটা করতে ইচ্ছে হয় , সেই দায় থেকেই আমার চেষ্টা , কিছু একটা লিখে রাখতে পারলে হয়তো আগামীতে কারো না কারো কাজে লাগবে । কি কাজে লাগবে ? কিভাবে লাগবে ? কেন লাগবে ? কখন লাগবে সেটা ভেবে কোন সুরাহা করতে পারবো বলে মনে হয় না । কিন্তু আমি বিশ্বাস করি কিছু লেখে রাখা ভাল , কিন্তু লিখবো কি করে ? লেখা তো আসে না , লিখতে হলে পড়তে হয় । সময় করে মনোযোগ দিয়ে পড়তে হয় , কখন পড়বো ? পড়ার সময় কোথায় ? গত কিছু কালে যে পরিমান বই পেয়েছি পড়ার জন্য , যদি আজ থেকেই পড়া শুরু করি ,এক নাগাড়ে পড়লেও কমপক্ষে বিশ বছর সময় লাগবে শেষ করতে , এর ভিতর তো আগামীতে আরো বই সংগ্রহ হবে , মাঝে কয়েক বছর আগে ভেবে রেখেছিলাম এক নাগারে প্রথমে এক সপ্তাহ বই পড়বো তারপরে এক মাস তার পর তিন মাস তারপর এক বছর ক্রমান্নয়ে বই পড়বো , কি হবে জানিনা ইহজীবনে সেই ইচ্ছার “ বই পড়া হবে কিনা ? বই পড়ার ইচ্ছা ছিল ছোট বেলা থেকে , পারিনি তা পুরন করতে , আগামীতে তা পুরণ হবে কিনা তারও কোন নিশ্চয়তা নেই ।
একটু একা থাকলেই শুধু মনে পড়ে অতীতের কথা , পুরোনো দিনের কথা ঃ-
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন “
“পুরানো সেই দিনের কথা
ভুলবি কিরে হায়
ও সেই চোখের দেখা প্রাণের কথা
সে কি ভোলা যায় ?”সত্বিই ভোলা যায় না , যেমনি ভুলতে পারছি না কুলাউড়ার পাঠশালার কথা , পাঠশালা বলতে দক্ষিন বাজার বি.এইচ ( বশিরুল হুসেন ) প্রাইমারী স্কুলকেই বুঝাতে চেষ্টা করছি ।
১৯৭২ সালে আমার নানা মরহুম এ এম আশরাফ আলী খান সাহেব যাকে কুলাউড়ার জনগন সাবরেজিষ্টার সাহেব বলতো , আমাকে ঐ স্কুলে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করান ও ভর্তি করিয়ে ফেরত আশার সময় একটি কাঠের শ্লেট ও চকপেন্সিল এবং কমলা / গোলাপী রংগের বাল্যশিক্ষা বই কিনে দিয়েছিলেন ।ফেরার পথে মোড়ে মোমিনের দোকান থেকে কাঁচের বয়ামে রক্ষিত ছিল , লুডুর ছক্কার মত রং বেরং এর ছোট ছোট কয়েকটি চকলেট ও লেবেন চুস কিনে দিয়েছিলেন । সেই মমিন সাহেবের দোকানের সামনেই রাস্তার মুখে একটি ছোট কালভার্ট ছিল যা অনেকের হয়তো মনে আছে , দুই পাশ্বে চারজন লোক বসার উপোযোগী একটু উচুকরে বাঁধানো পাকা করা ওয়ালও ছিল । মমিন সাহেবেরা দুই ভাই ঐ দোকানে বসতেন , উনাদের ব্যবহার অনেক ভাল ছিলো এবং সব ভাল ভাল জিনিষ পাওয়া যেতো তাদের দোকানে , উনারা নোয়াখালীর লোক ছিলেন এবং কুলাউড়ায় এসে ব্যবসা শুরু করেন এবং ঐখানে অনেক দিন ভাল ব্যবসা করেছেন , হারিস নামে তাদের দোকানের একজন সহযোগী ছিল যিনি পরবর্তীতে দুইটা দোকান পরে আরেকটি দোকান শুরু করেছিলেন । যুদ্ধের সময় একমাত্র উনাদের দোকানই সবসময় খোলা পাওয়া যেতো এবং তারা সকলকেই ততকালীন সেই কঠিন সময়ে কুলাউড়াবাসীদের অনেক সহযোগীতা করেছেন । এই রাস্তাই ঐ দিকে অর্থাৎ মনুর , মইন্তাম , আমতৈল , কাদিপুর , ব্রাহ্মনবাজার ,কিয়াতলা , পেকুর বাজার , হাসিমপুর ,বরমচাল , ভাটেরা ইত্যাদি জায়গায় যাবার জন্য অন্যতম রাস্তা ছিল , তাও ইঁটের হেরিংবুন দেওয়া রাস্তা মাগুরার পর্যন্ত ছিল এর পরে তা সম্পুর্নই মাটির রাস্তাই ছিল ।মমিনের দোকানের পুবপাস্বে মক্তোদিন নানার রাইস মিল ও রেশনের দোকানের পাশ দিয়ে একটি চিপা গলি রেল ষ্টেশনের দিকে গিয়েছে , ঐ রাস্তায় ও রেলের খালের উপর একটি কালভার্ট ছিল , সেই ইঁটের রাস্তা যোগে রেলওয়ে হাসপাতালের পাশদিয়ে সহজে ষ্টেশনে গিয়ে পৌছানো যেত ।
মমিনের দোকানের পরেই কয়েকটি দোকান ছিল তারপর ছিল কালীবাড়ী পাশ্বেই ছিল একটি টিউবঅয়েল যা থেকে স্বচ্ছ খাবার পানি বের হতো এবং আঁশে পাশের বেশ কয়েকটি বাড়ী দোকানপাট ও হোটেল সমুহে এই টিউবঅয়েল এর পানি নিয়ে পানির চাহিদা পুরণ হতো । সাপ্লাই থেকেও সারাক্ষন খাবার পানি আসতো এমনি একটি কল ছিল ইউনিয়ন অফিসের পশ্চিম পাশে কুলাউড়া থানার উত্তরে মোবারকের হোটেলের পাশ্বে ।
বিপরীতে দক্ষিন বাজার বা সকালের বাজার ছিল , বিকাল বেলা বাজার বসতো উত্তর বাজারে । দক্ষিন বাজারের গলির মুখে লাগোয়া একটি ছোট্ট মিষ্টির দোকান ছিল , যেখানে গরম গরম পরটা সুজীর হালুয়া বা তুষা শিরনী ও রং বেরং এর বুন্দিয়া বা বুরিন্দা পাওয়া যেতো ।
মাঝে মাঝে জিলাপী ও সমুচা ও বিক্রি হতো । সেই দোকানের সামনেই ছিল লাকড়ীর চুলা । সবসময় একটা ধুয়া ধুয়া পরিবেশ লক্ষ্যনীয় ছিল ।
বি এইচ স্কুলের সাথীদের মধ্যে , বুলন , নান্টু , মতিন এরা উত্তর বাজারের দিক থেকে আসতো আর আমাদের পাশ্বের বাড়ীর ফখরু ( মোকাবি্বর হোসেন ) সাফী , ও লষ্করপুরের মামুনের কথা বেশ মনে আছে । মনে আছে কনা স্যারের কথা , মুনিম স্যারের কথা , শহীদ স্যারের কথা , শহীদ স্যার একটু গাট্টাগুট্টা টাইপের ছিলেন , হাটতেন বেত হাতে নিয়ে । তিনি রেলওয়ে স্কুল থেকে বদলী হয়ে বি এইচ স্কুল বা পাঠশালায় এসেছিলেন ।
আরো মনে আছে বড় দা র কথা এবং আমিরুননবী সারের কথা , তিনি অনেক ফিটফাট থাকতেন এবং আরবী পড়াতেন ।
স্কুল থেকে ফেরার পথে মাঝে মাঝে মিষ্টির দোকান থেকে জিলাপী কিনতাম তাও আবার বাকিতে , মামা পরে পয়সা দিয়ে দিবেন এই রকম প্রতিশ্রুতিতে বাকি পাওয়া যেতো আর তখন সব দোকানীরাই কুলাউড়ার সকলকেই চিনতো । একটি বেকারীর বিস্কিট ই ছিল ভাল কিছু খাবার । যা কিনে বাড়িতে এনে খেতে হতো , তাও মচা বা ঠোংগায় ভরে , তখন তো আর পলিথিনের ব্যাগ ছিল না , খাকী কাগজের ঠোংগাই ছিল অন্যতম ভরসা ।
শৈশবের সেই ফেলে আসা দিনগুলোতে টাকার অভাবে অনেক স্বপ্ন পুরন করা হয়নি , ইতিমধ্যে অনেক স্বপ্নই মরে গেছে, আজ টাকা আছে বটে কিন্তু সেই স্বপ্নও নেই এবং তা পূরণের ইচ্ছেটা আর নেই ।
ফেলে আসা সেই শৈশবের সময় যেন বিকেলের স্মৃতি, এখন সময় চলে একমুখী হয়ে এক দেয়ালের ভেতরে সারাক্ষন মোবাইল টিপে মাঝে মাঝে খোলা আকাশের দিকে তাকালে মন ছুটে যায় বৃষ্টি ভেজা সেই দিনে যেদিন টাকার অভাবে ফুটবল কিনতে পারি নাই আমরা অনেকেই , মাঠে খেলায় নাম লেখাতে পারি নাই বুট কেনা ছিল না বলে , আমাদের অনেক স্মৃতি , বৃষ্টিতে ভিজে জাম্বুরা কে ফুটবল বানিয়ে কামাল ভাই , মলাই ভাই , রহমান ( লন্ডন প্রবাসী ) , রুমেল , সুলতান দের সাথে নিয়ে কাদায় ফুটবল খেলতাম বাড়ীর পিছনের বন্দে । আহারে কি সেই মধুর স্মৃতি
খুব ইচ্ছে হয় শৈশবের সেই বেলায় ফিরে যেতে। ইচ্ছে হয় সেই সব সাথী বন্ধুদের ডেকে বলি , চলনা আবার হারিয়ে যাই স্মৃতিগুলো কুড়িয়ে সঙ্গে করে সেই শৈশবে।
আসলে শৈশবকাল হল মানুষের এমন একটি সময় যেখানে থেকে যায় শুধু স্মৃতি এবং সেই সময়েই একটি শিশু চায় তার জীবনের মূল লক্ষ্যের দিকে যাওয়ার সঠিক পথ বেছে নিতে। আমার মনে নেই তখন কেউ কি আমাদেরকে বলেছিল কিনা যে তোমরা এই পথ বেছে নাও .. এভাবে চল .
শুধু সবাই বলতো ভাল করে পড়ালেখা কর , বড় হও , বড় হলে ডাক্তার ইন্জিনিয়র হতে পারবে , মানুষের মত মানুষ হতে পারবে ।
কুলাউড়ার সেই ময়মুরব্বী , বড়দের কথা , উপদেশ আজও কানে বাজে , তাদের অধিকাংশরাই আজ বেচে নেই , তাদের আত্বার শান্তি ও জান্নাত কামনা করছি । আমিন ।( চলবে)
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।