
যে শিক্ষা মানুষের মনে সহানুভূতি সৃষ্টি করতে পারে না, সেই শিক্ষা শুধুমাত্র মস্তিষ্কে থাকে, অন্যের হৃদয় স্পর্শ করতে পারে না। কিন্তু অধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল হান্নান তার আন্তরিক সহানুভূতির মাধ্যমে ছাত্র, শিক্ষক, সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন এবং রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে সক্ষম ছিলেন। কুলাউড়া সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি ২৪ জানুয়ারি ২০২৫ ইহলোক ছেড়ে অদৃশ্য জগতে পাড়ি জমান, ৫৬ বছর বয়সে।
জন্ম ও পরিবার
অধ্যক্ষ আব্দুল হান্নান ১৯৬৮ সালের ১৪ মার্চ কুলাউড়া পৌরসভার কাছিম নগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হাজী আব্দুল করিম এবং মাতা হাজী সৈয়দা জমিরুন নেছার পঞ্চম সন্তান হিসেবে তার জীবন শুরু হয়। তিনি বিবাহিত ছিলেন এবং দুই সন্তানের বাবা ছিলেন। পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের প্রতি তার আন্তরিক ভালোবাসা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী।
শিক্ষা জীবন
শিক্ষাজীবন শুরু হয় কুলাউড়া বশিরুল হোসেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। ১৯৮৩ সালে কুলাউড়া নবীনচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি সম্পন্ন করেন। এরপর কুমিল্লা কলেজ থেকে এইএসসি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্ব ও বাংলা সাহিত্যে স্নাতক এবং স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রিও অর্জন করেন।
কর্মজীবন
অধ্যক্ষ হান্নানের কর্মজীবন শুরু হয় শ্রীপুর জালালীয়া মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে। পরে তিনি ভাটেরা কলেজের প্রভাষক এবং ২০০৬ সালে কুলাউড়া কলেজের উপাধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হন। ২০২১ সাল থেকে তিনি আমৃত্যু কুলাউড়া সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি যেকোন মানুষকে আপন করে নেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।
কলেজ শিক্ষকদের সংগঠনের জেলার দায়িত্বেও দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া এসএসসি ৮৩ ব্যাচের কুলাউড়ার সকল সহপাঠীদের মাসিকভাবে একত্র করে ভুরিভোজ আয়োজন করতেন।
সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় অবদান
অধ্যক্ষ আব্দুল হান্নান ছিলেন নানামুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তার লেখা “ইয়াছিন শাহের জীবন ও আধ্যাত্মিক ঘটনাবলী (১৮৫০–১৯৩৫)” গ্রন্থে তার প্রতিভার ছাপ দেখা যায়। ২০০৬ সাল থেকে তিনি “সাপ্তাহিক হাকালুকি” পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন। এছাড়া তিনি কুলাউড়া প্রেসক্লাবেরও সদস্য ছিলেন।
রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড
কুলাউড়া নবীনচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে তিনি ছাত্রদলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। কুলাউড়া এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে ছাত্রদলের বিভিন্ন পদে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কুলাউড়া কলেজ সরকারি হবার পূর্বে তিনি কুলাউড়া উপজেলা ও জেলা বিএনপির বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং কুলাউড়া বিএনপির সভাপতি হিসেবেও ছিলেন। এছাড়া তিনি কুলাউড়া পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা
অধ্যক্ষ হান্নান তার দীর্ঘ শিক্ষাজীবনে শিক্ষকতা ও সমাজসেবার জন্য বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। তার মানবিক ও শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ড কুলাউড়া অঞ্চলের মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী ছাপ ফেলেছে।
ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীদের প্রতিক্রিয়া
ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীরা অধ্যক্ষ হান্নানকে স্মরণ করেন এক উদার ও সহানুভূতিশীল ব্যক্তি হিসেবে। শিক্ষার্থীরা বলেন, “অধ্যক্ষ সাহেব শুধু জ্ঞান দিতেন না, আমাদের মনে সহানুভূতি এবং মানবিক মূল্যবোধও গড়ে তুলতেন।” সহকর্মীরা উল্লেখ করেন, “তিনি যেকোনো সমস্যা সমাধানে সব সময় পাশে থাকতেন এবং মানুষের প্রতি তার আন্তরিক ভালোবাসা সবসময় স্পষ্ট ছিল।”
ব্যক্তিত্ব
অধ্যক্ষ হান্নান শুধু একজন শিক্ষাবিদই ছিলেন না, তিনি মানবিক সহানুভূতির প্রতীক। শিক্ষার্থী, সহকর্মী এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে মানুষকে তিনি সমানভাবে গ্রহণ করতেন এবং তাদের প্রতি আন্তরিকভাবে সহানুভূতিশীল ছিলেন।
কুলাউড়ার পথে প্রান্তরে
লেখক: ওয়াহিদ মুরাদ
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।