
‘আমেরিকার সৌন্দর্য’ (American Beuty) কথাটির মধ্যে এমন এক অদ্ভূৎ গভীরতা আছে, যা চোখে দেখা যায় না, কেবল অন্তর দিয়ে অনুভব করা যায়। এই সৌন্দর্য কেবল আকাশচুম্বী অট্টালিকা, বিশাল বিশাল হাইওয়ে বা সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তি নয়- এটি এক জীবনদর্শন। এমন এক দর্শন, যেখানে মানুষ নিজের মতো বাঁচতে পারে, নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে এবং পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে গড়ে নিতে পারে নিজ ও পরিবারের ভাগ্য।
আমেরিকার সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হলো- সমান সুযোগের স্বাধীনতা। এখানে কেউ আপনাকে বলবে না- আপনি কী হতে পারবেন, আর কী হতে পারবেন না। আপনি যদি পরিশ্রমী, সাহসী, কর্মঠ আর দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হন, তাহলে আপনার জন্য অসংখ্য পথ তৈরি হবে, হয়তো ধীরে- কিন্তু হবেই। এখানে জন্ম কিংবা বংশপরিচয়ে মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হয় না, আপন কর্মগুণেই মানুষ সফল কিংবা ব্যর্থ হয়। আমি নিজে একজন অভিবাসী হিসেবে এই সত্য গভীরভাবে অনুভব করেছি। শূন্য হাতে একটি অনুন্নত দেশ থেকে এখানে এসে আমি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি, তৈরি করেছি নিজের শক্ত অবস্থান। মাত্র বারো বছরে সেইসব স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি, যা অন্য কোথাও হয়তো কল্পনাতীত।
আমেরিকার আইনি কাঠামো, প্রশাসনিক প্রক্রিয়া এবং সামাজিক মূল্যবোধ মানুষকে একটাই বার্তা দেয়- তুমি পারবে, যদি চেষ্টা করো। এখানে কেউ কারো কণ্ঠরোধ করতে পারে না, কেউ কারো স্বপ্নের প্রতিবন্ধক হতে পারে না বা হয় না। বরং এখানকার সমাজ, পরিবেশ আপনাকে উৎসাহ দেয় নিজের সীমা ভাঙতে, নিজের সামর্থ্যকে ছুঁতে। যে কারণে কমিউনিটি মেম্বার থেকে শুরু করে প্রেসিডেন্ট হওয়ার রাস্তা পর্যন্ত সবার জন্য খোলা। এটাই আমেরিকার প্রকৃত শক্তি- এখানে কোনো ভয় নয়, বরং আকাঙ্খাই অসীম সম্ভাবনা (Land of opportunity) হিসেবে কাজ করে।
আমেরিকার গণতন্ত্র ও মুক্ত সমাজের সৌন্দর্য প্রকাশ পায় তার প্রতিদিনের সাধারণ জীবনের মধ্যেই। আপনি নিঃশঙ্কচিত্তে নিজের মত প্রকাশ করতে পারেন, অবাধে সরকারের যৌক্তিক সমালোচনা করতে পারেন, প্রয়োজনে আদালতের আশ্রয়ও নিতে পারেন- এই স্বাধীনতাই আমেরিকার প্রাণ। এখানে কেউ আপনার কণ্ঠরোধ করতে পারে না, কেউ আপনার ভোটাধিকার কেড়ে নিতে পারে না। এই দেশের শক্তি তার বাকস্বাধীনতায়, আর সেই স্বাধীনতার ওপর দাঁড়িয়েই টিকে আছে গণতন্ত্র। কিন্তু এই সৌন্দর্যের পেছনে গভীর ত্যাগও আছে- আর সেই ত্যাগ আমাদের মতো অভিবাসীদের কাছে সবচেয়ে স্পষ্ট।
আমরা যখন স্বপ্নে বিভোর হয়ে নতুন জীবনের খোঁজে আমেরিকায় আসি, তখন ফেলে আসি এক বিশাল জগৎ- পরিচিত মুখ,
আত্মীয়স্বজনের সান্নিধ্য, প্রিয় শহরের গন্ধ, গ্রামের মাটি, ভাষার উষ্ণতা। আমাদের সন্তানেরা এখানে বড় হয়, কিন্তু অনেক সময় তাদের কাছে আমার/আমাদের মাতৃভূমির গল্পটা কেবল স্মৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তারা হয়তো ইংরেজিতে পারদর্শী, কিন্তু বাংলায় অনুভূতির গভীরতা বোঝে না। আমরা হয়তো অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হই, কিন্তু মনের এক কোণে রয়ে যায় একধরনের শূন্যতা- যা শুধুই দেশের ভালোবাসা দিয়ে পূরণ করা যায়। তবু সত্যিকার অর্থে এই শূন্যতার চেয়ে প্রাপ্তিই অনেক বেশি।
আমেরিকা আমাদের দিয়েছে নিরাপত্তা, মর্যাদা আর আত্মবিশ্বাস- যদি আমরা পরিশ্রম করি, তাহলে সহজেই সফল হওয়া সম্ভব। এখানে মানুষকে তার কাজের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়- ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতি, সম্প্রদায় কিংবা বংশমর্যাদা দিয়ে নয়। এই বিশ্বাসই একজন অভিবাসীকে সাহসী করে তোলে, তাকে সমাজের মূলধারায় স্থান করে দেয়। এর জ্বলন্ত উদাহরণ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কাউন্সিলর শাহানা হানিফ, ২৭ বছর আগে আসা উগান্ডায় জন্ম নেয়া ইলেক্ট মেয়র জোহরান মামদানি কিংবা আফ্রিকান বংশোদ্ভূত সাবেক সফল প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
শুধু কি তা-ই? গত ৪ নভেম্বরের রাতটি আমেরিকার গণতন্ত্রে লিখে গেলো এক নতুন অধ্যায়। ইতিহাস গড়লেন নারী, মুসলিম ও তরুণ নেতৃত্ব। ভার্জিনিয়া থেকে নিউইয়র্ক, নিউজার্সি থেকে ক্যালিফোর্নিয়া- যেখানেই তাকানো যায়, দেখা মিলেছে নতুন ইতিহাসের।
ভার্জিনিয়ার অ্যাবিগেইল স্প্যানবার্গার হয়েছেন স্টেটের প্রথম নারী গভর্নর, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এবং নিউইয়র্কের কুইন্সের প্রথম মুসলিম বিচারপতি হিসেবে নিউইয়র্ক স্টেট সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নির্বাচিত হয়েছেন সোমা এস সাঈদ, নিউজার্সিতে আবারও আস্থা পেয়েছেন ফিল মারফি- মানবিক নেতৃত্বের প্রতীক হয়ে। টেক্সাসে রোসা গার্সিয়া প্রথম ল্যাটিন সিনেটর, মিশিগানে ড্যানি ব্রুকস সমকামী অ্যাটর্নি জেনারেল, ওহাইও পেয়েছে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ সিনেটর মাইকেল হেনরি আর ক্যালিফোর্নিয়ায় ইতিহাস গড়েছেন এমিলি ট্রান, প্রথম এশীয়-আমেরিকান লেফটেন্যান্ট গভর্নর হিসেবে।
এক বিশ্লেষকের ভাষায়, ‘আমেরিকা এখন শুধু মেল্টিং পট নয়- এটি রঙে, ভাষায় ও মানবিকতায় ভরপুর এক জীবন্ত চিত্র।’
আমেরিকার সৌন্দর্য ঠিক এখানেই- এই দেশ আপনাকে নিজের রঙে রাঙিয়ে দেয় না; বরং আপনার রঙকেই উদ্ভাসিত হতে দেয়। এখানে আপনি নিজের পরিচয়ে বাঁচতে পারেন, গর্বের সঙ্গে নিজের ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি লালন-পালন করতে পারেন। আমি নিজেও এই মাটিতে বাস করে গর্বের সঙ্গে নিজ দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারছি। বাংলাদেশি পরিচয় আমার কাছে কোনো বোঝা নয়, বরং সম্মানের প্রতীক।
এই দেশে দীর্ঘ সময় থেকে আমি দেখেছি- কাজই মানুষের প্রকৃত পরিচয়। আপনি কে, কোন বংশে জন্মেছেন, কোন ধর্ম মানেন- এসব কোনো ফ্যাক্টর নয়; আপনি কী অবদান রাখছেন, সেটাই মুখ্য। তাই এখানে শ্রমিকের ঘাম, শিক্ষকের নিষ্ঠা বা উদ্যোক্তার সাহস- সবকিছুরই মূল্য আছে।
আমেরিকার গণতন্ত্রের সৌন্দর্যও (American Beuty) এই দর্শনেরই সম্প্রসারণ। ১৭৭৬ সালের স্বাধীনতার ঘোষণায় লেখা হয়েছিল, ‘We the People’- ‘আমরা জনগণ’। এই বাক্য কেবল একটি রাজনৈতিক স্লোগানই নয়, এটি একটি নৈতিক প্রতিশ্রুতিও।
রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, শাসক নয়- এই ধারণা থেকেই জন্ম নিয়েছে আমেরিকার রাজনৈতিক আত্মা (Political Soul)। প্রেসিডেন্ট, কংগ্রেস, আদালত- এই তিনটি স্তম্ভ একে অপরকে ভারসাম্যে রাখে, নিয়ন্ত্রণ করে। কোনো প্রেসিডেন্টই একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী নন; আদালত তার সিদ্ধান্ত বাতিল করার ক্ষমতা রাখেন, গণমাধ্যম তাকে জবাবদিহির আওতায় আনতে পারে, আর সবশেষে জনগণ ভোটের মাধ্যমে তাকে হোয়াইট হাউস থেকে বিতাড়িতও করতে পারে। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাহী অনেক আদেশও আদালত কর্তৃক আটকে দেওয়ার নজির রয়েছে।
এই Checks and Balances ব্যবস্থাই যুক্তরাষ্ট্রকে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী ও স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।
এখানে বিরোধিতা মানে শত্রুতা নয়; এটি অংশগ্রহণের এক রূপ। আপনি সরকারের সমালোচনা করতে পারেন, তবু আপনি দেশের অংশ। এই মুক্ত পরিবেশই মানুষকে সক্রিয় নাগরিক হতে শেখায় এবং সমাজকে আত্মসমালোচনার ক্ষমতা দেয়।
আমেরিকার আরেকটি অসাধারণ গুণ হলো- এটি নিজের ভুল স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হয় না। এক সময় এ দেশেও ছিল দাসপ্রথা, নারীদের ভোটাধিকার-বঞ্চনা, বর্ণবৈষম্যের অভিশাপ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানামুখী আন্দোলন এবং শিক্ষিত ও সচেতন নাগরিকদের প্রচেষ্টায় আমেরিকা নিজেকে সংশোধন করেছে। এটাই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শক্তি- নিজেকে বদলানোর সাহস।
তাই আমেরিকার গণতন্ত্র নিখুঁত না হলেও জীবন্ত। এর সৌন্দর্য ধন-সম্পদে নয়, বরং বিশ্বাসে- প্রতিটি মানুষ নিজের ভোট, মতামত ও প্রতিবাদের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে পরিবর্তন করতে পারে। ক্ষমতার সীমা আর নাগরিকের সাহস- এই দুইয়ের সমন্বয়েই দাঁড়িয়ে আছে আমেরিকার গণতন্ত্রের চিরন্তন আকর্ষণ। আমি একজন অভিবাসী হিসেবে এই সৌন্দর্যকে জীবনের প্রতিটি ধাপে অনুভব করছি।
আমেরিকা আমাকে শুধু আশ্রয়ই দেয়নি; দিয়েছে আত্মমর্যাদা, দিয়েছে সেই বিশ্বাস যে- এখানে পরিশ্রমই পরিচয়, আর যোগ্যতাই মর্যাদা। আমি দেখেছি, একজন সাধারণ মানুষও কেবল সততা ও শ্রম দিয়ে নিজের ভাগ্য বদলাতে পারে। আমেরিকার সৌন্দর্য কোনো পতাকায় বা স্লোগানে নয়- এটি মানুষের অন্তরের স্বাধীনতায়। এটি এমন এক বিশ্বাস, যা প্রতিদিন নতুন করে জন্ম নেয় কর্মের মাধ্যমে, সাহসের মাধ্যমে, সততার মাধ্যমে।
এদিকে নিউইয়র্ক কেবল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আর সিটির ইলেক্ট মেয়র জোহরান মামদানির শহর নয়- চার শতাব্দী প্রাচীন অথচ সর্বদা চাকচিক্যময় এ শহর বিশ্বরাজধানীর খেতাব পেয়েছে অসংখ্য কীর্তিমানের কৃতিত্বে। এটি একটি শহরের অন্তরাত্মার গল্প।
আজকের নিউইয়র্ক সিটি হাজারো অভিবাসীর ঘাম, শ্রম আর অশ্রু দিয়ে গড়া- আজ সেই শহরই দাঁড়িয়ে আছে দুই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মাঝখানে। একদিকে জার্মান থেকে অভিবাসী হয়ে আসা ফ্রেড্রিক ক্রিস্ট ট্রাম্প (ফ্রেড ট্রাম্প)-এর সন্তান বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, জন্মসূত্রে নিউইয়র্কের সন্তান, যিনি একসময় এই শহরকে নিজের সাফল্যের প্রতীক বানিয়েছিলেন। অন্যদিকে জোহরান মামদানি, এক উগান্ডা থেকে আসা অভিবাসী পরিবারের সন্তান, যিনি সেই একই শহরে মানুষের আশার প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
সদ্য সমাপ্ত সিটি নির্বাচনে মামদানির প্রতিদ্বন্দ্বী কেবল অ্যান্ড্রু ক্যুমোই ছিলেন না। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং কয়েকজন মার্কিন বিলিয়নিয়ারও তার জয়ের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রেসিডেন্টের মতো সর্বোচ্চ পদে বসে ট্রাম্প প্রকাশ্যে ক্যুমোকে বিজয়ী করার জন্য নিউইয়র্কবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। শুধু তা-ই নয়, ক্যুমো প্রেসিডেন্টের বরাতে প্রচারণা চালান যে, মামদানি মেয়র নির্বাচিত হলে নিউইয়র্কের ফেডারেল সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিও দেন। আর মামদানির বিজয় ঠেকাতে মার্কিন বিলিয়নিয়াররা কয়েক মিলিয়ন-মিলিয়ন ডলার অপচয় করেন! কিন্তু রাষ্ট্রশক্তি ও অর্থশক্তির এই জমাট দেয়াল ভেঙে নিউইয়র্কবাসীর ভোটে মেয়র নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন জোহরান মামদানি।
এখানেও জয় হয়েছে গণতন্ত্রের, জয় হয়েছে ব্যক্তিস্বাধীনতার, জয় হয়েছে ভালোবাসার। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তির চোখরাঙানি কিংবা দাপুটে বিলিয়নিয়ারদের অর্থশক্তিকে উপেক্ষা করে নিউইয়র্কের ভোটাররা সাহসিকতার সঙ্গে নগরপিতা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তাদের আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক মামদানিকে। সিটি মেয়রের চেয়ারে বসে মামদানি সেই আস্থার মর্যাদা কতটুকু রাখতে পারবেন- তা কেবল ভবিষ্যতেই বলতে পারে।
কিন্তু অনেকের মনেই সংশয় থেকে যায়, মামদানি মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় ট্রাম্প তার কথামতো যদি নিউইয়র্কে ফেডারেল সহায়তা সত্যিই বন্ধ করে দেন, তাহলে নগরবাসীর কী হবে? দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, হাউজিং সমস্যাসহ এমনিতেই নানা সমস্যায় জর্জর সিটির নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। ফেডারেল সহায়তা বন্ধ হলে তারা নিঃসন্দেহে আরো বিপাকে পড়বেন। তবে আমার বিশ্বাস, দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প নিশ্চয়ই শেষ পর্যন্ত তার এমন রাজনৈতিক স্থুল বক্তব্য থেকে সরে আসবেন।
আমরা জানি, আমেরিকার গণতন্ত্রে প্রতিহিংসার স্থান নেই। যে কারণে সারা বিশ্ব আমেরিকার গণতন্ত্রকে আদর্শ মানে, সমীহ করে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলেন সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ও মর্যাদাবান ব্যক্তি। কিন্তু প্রতিহিংসার বশে ট্রাম্প যদি নিউইয়র্কের ফেডারেল সহায়তা বন্ধ করে দেন, তাহলে কেবল নিউইয়র্কবাসী বিপাকে পড়বেন না; ক্ষুণ্ন হবে মার্কিন গণতন্ত্রের সৌন্দর্য, লঙ্ঘিত হবে মানবাধিকার। ৪০০ বছর ধরে মার্কিনিরা যে গণতন্ত্র নিয়ে গর্ব করে, তাতে কিছুটা হলেও কালিমা লেপন হবে। তবে আমার বিশ্বাস, ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই পথে হাঁটবেন না। এটা মার্কিন গণতন্ত্র এবং ট্রাম্প- উভয়ের জন্যই মঙ্গলজনক হবে।
যদিও কেউ কেউ বলেন, কঠোরতা ছাড়া দেশ টেকে না, আবার কেউ বলেন সহানুভূতি ছাড়া শহর বাঁচে না। কিন্তু হয়তো সত্যিটা মাঝখানেই- যেখানে নীতির সঙ্গে মানবতা, শক্তির সঙ্গে করুণা আর নেতৃত্বের সঙ্গে ভালোবাসা মিশে যায়।
নিউইয়র্কের রাস্তায় আজও ভোরে ট্যাক্সি চালকেরা নামেন, সন্ধ্যায় দোকানের আলো জ্বলে ওঠে, সকালে শিশুদের স্কুলের ব্যাগে মায়ের স্বপ্ন গুছিয়ে রাখা হয়। এসব জীবনের মাঝেই লুকিয়ে আছে শহরের প্রকৃত মুখ- যা রাজনীতির নয়, মানুষের।
ট্রাম্প আজও বলেন, ‘আমেরিকা দুর্বল হচ্ছে’। আর মামদানি বলেন, ‘না, আমেরিকা বদলাচ্ছে- আর সেই বদলে আছি আমরা সবাই’। এ কথার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক গভীর সত্য- যে শহরে ভিন্ন পৃথিবীর মানুষ নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারে, পরস্পরকে শুনতে পারে, সেখানেই গণতন্ত্র এখনো বেঁচে আছে।
নিউইয়র্ক আজ এক নীরব কিন্তু গভীর আবেগে মোড়া শহর- যেখানে অতীতের গর্ব আর ভবিষ্যতের আশা একসঙ্গে শ্বাস নেয়। কারণ পৃথিবী এখনো তাকিয়ে আছে সেই দেশটির দিকে, যে দেশটির অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন তাঁর ঐতিহাসিক ‘গেটিসবার্গ ভাষণে’ গণতন্ত্রের বিখ্যাত সংজ্ঞা দিয়েছিলেন। ১৮৬৩ সালে লিংকন বলেছিলেন : ‘Government of the people, by the people, for the people shall not perish from the earth.’
ষোড়শ প্রেসিডেন্টের এই বিখ্যাত উক্তি আজও অমর হয়ে আছে। ১৬২ বছর পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অমর বাণীকে ধারণ করে চলেছে।
এই ছোট্ট একটি বাক্য শুধু ইতিহাস নয়, এটি আমেরিকার নৈতিক চেতনার প্রতীক। যতদিন এই বিশ্বাস অমলিন থাকবে, ততদিন আমেরিকা শুধু একটি রাষ্ট্র নয়- গোটা বিশ্বের জন্য আলোর দিশা হয়ে থাকবে। আর সেই দিশা মনে করিয়ে দেয়- গণতন্ত্র টিকে থাকে ক্ষমতায় নয়, মানুষের আস্থায়; অস্ত্রের জোরে নয়, ন্যায়ের শক্তিতে।
লেখক : সাবেক সাংসদ ও ঠিকানা’র সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।