বাংলাদেশে প্রতি নির্বাচনে কোটি কোটি মানুষ ভোট দেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো—সব দলের ভোট কি সমানভাবে সংসদে প্রতিফলিত হয়? এক দল ১৫% ভোট পেয়েও একটিও আসন পায় না, আরেক দল ৩০% ভোটে ২০০টির বেশি আসন জিতে নেয়। এ ব্যবস্থায় কিছু দল স্থায়ী ক্ষমতায় থেকে যায়, অন্যরা বারবার বাদ পড়ে। এর ফলে গণতন্ত্র একরকম পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ে—ভোট তো দিলাম, কিন্তু তার মূল্য কী?
বিশ্লেষকদের মতে, কিছু দল সারাদেশে গড়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ভোট পেলেও সংসদে তাদের কোনও প্রতিনিধিত্ব থাকে না, কারণ আসনভিত্তিক একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার পদ্ধতিতে তারা জিততে পারে না। এই কথার মধ্যেই লুকিয়ে আছে দীর্ঘদিনের নির্বাচনী অসাম্য। আর এ থেকেই উঠে এসেছে এক বিকল্প পদ্ধতির কথা—আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা, সংক্ষেপে PR পদ্ধতি।
কী এই আনুপাতিক পদ্ধতি?
এই পদ্ধতিতে, একটি দলের মোট ভোটের অনুপাতে তাদের সংসদে আসন বরাদ্দ হয়। অর্থাৎ, যদি কোনো দল জাতীয়ভাবে ২০% ভোট পায়, তবে তারা সংসদের মোট আসনের ২০% পাবে। এতে করে প্রতিটি ভোটের গুরুত্ব বেড়ে যায়, ছোট দলগুলোরও প্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়, আর সাধারণ মানুষের রায় আরো সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়।
বর্তমানে পৃথিবীর ১৭০টি দেশের মধ্যে প্রায় ৯১টি দেশে এই পদ্ধতি চালু রয়েছে। ইউরোপে জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, নরওয়ে, স্পেন, ইতালি, সুইজারল্যান্ড ও ফিনল্যান্ড সহ বহু দেশে এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এই পদ্ধতিতে জনগণের বিশ্বাস, অংশগ্রহণ ও রাজনৈতিক ভারসাম্য অনেক বেশি নিশ্চিত হয়, কারণ এতে সংসদে আসন সংখ্যা শুধুমাত্র ক্ষমতাবানদের জন্য নয়—ভোটারদের প্রকৃত রায়ের প্রতিফলন ঘটে।
আমাদের বর্তমান পদ্ধতির সমস্যাগুলো কী?
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত প্রথম আসন জয়ী (First-Past-The-Post) পদ্ধতিতে যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পায়, সে-ই বিজয়ী হয়—বাকি ভোটগুলো “হারিয়ে যায়”। যেমন: কোনো আসনে একজন প্রার্থী ৩৫% ভোট পেয়ে জিতে গেলে বাকি ৬৫% ভোট কার্যত মূল্যহীন থেকে যায়। ফলে যিনি জেতেন, তিনি হয়তো মোট জনগণের সংখ্যালঘু অংশের প্রতিনিধিত্ব করেন, কিন্তু তিনিই হয়ে যান সেই এলাকার একমাত্র কণ্ঠস্বর।
এই পদ্ধতিতে ছোট ও মাঝারি রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে সংসদে জায়গা পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। জনগণের একটি বড় অংশের মতামত কার্যত অপ্রকাশিত থেকে যায়। এর ফলে গণতন্ত্র হয় একচোখা, এবং ভোটারদের হতাশাও বাড়ে।
আনুপাতিক পদ্ধতির সুবিধা
গত এক দশকে নির্বাচন বিশ্লেষকরা বারবার এ পদ্ধতি পরিবর্তনের কথা বলে আসছেন। তাদের মতে, বর্তমানে ব্যবহৃত পদ্ধতিতে একটি দল সহজেই একচ্ছত্র ক্ষমতা নিয়ে স্বৈরাচারি হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু PR পদ্ধতিতে সব দলেরই অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়, যা রাজনৈতিক ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতা তৈরি করে।
এই পদ্ধতি চালু করতে সংবিধানে কিছু সংশোধন লাগতে পারে, তবে সেটি খুব জটিল নয়। বরং রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এটি বাস্তবায়ন সম্ভব এবং দেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তি আরও মজবুত হবে।
👉 যেমন ধরা যাক—একটি দল সারা দেশের মোট কাস্টেড ভোটের ১০ শতাংশ পেলে, তারা সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ৩০টি আসন পাবে। আর যদি তারা ১৫ শতাংশ ভোট পায়, তাহলে পাবে ৪৫টি আসন। এটি একটি ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতি, যেখানে সবার ভোটের মর্যাদা থাকে। কেউ ভোট দিয়েও ভাববে না, “আমার ভোট বৃথা গেল।”
বাস্তবতা ও ভবিষ্যতের ভাবনা
তবে এ পদ্ধতির কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। যেমন, আনুপাতিক ভোটে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এর মানে, এককভাবে কোনো দল সরকার গঠন করতে পারে না—ফলে বাধ্যতামূলকভাবে জোট সরকার গঠন করতে হয়। আর বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে জোট সরকারের স্থায়িত্ব ও কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
তাছাড়া, অনেক ছোট ছোট দল সংসদে ঢুকে পড়ে সরকার গঠনে অতিরিক্ত চাপ তৈরি করতে পারে, যা কখনো কখনো স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়। তাই এই পদ্ধতি চালুর আগে বাস্তবতা ও রাজনৈতিক ঐক্যের গুরুত্ব অপরিসীম।
ভোটের মর্যাদা, ভোটারের মর্যাদা
সব সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও একথা বলতেই হয়—বর্তমান পদ্ধতি দিয়ে যে সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। জনগণের রায় যাতে আরও সমানভাবে প্রতিফলিত হয়, তার জন্য আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক পদ্ধতির দিকে এগিয়ে যাওয়া জরুরি।
এটি বাস্তবায়নের জন্য দরকার রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতা ও সম্মিলিত ঐকমত্য। একক দল নয়, সমষ্টির গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই হতে পারে ভবিষ্যতের পথ। তাহলে হয়তো সেই দিন আসবে, যখন একজন ভোটার জানবেন—“আমি যাকে ভোট দিয়েছি, তার কণ্ঠস্বর সংসদে পৌঁছেছে।”
আনুপাতিক পদ্ধতি মানে সব ভোটের মূল্য দেওয়া, ছোট দলকেও সুযোগ দেওয়া, এবং একচেটিয়া ক্ষমতার রাশ টেনে ধরা। এটি শুধু একটি নির্বাচনী পদ্ধতি নয়—এটি গণতন্ত্রের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নতুন ভাষা।
এবার সবচেয়ে কম ভোট পাওয়া একটি রাজনৈতিক দলের বৈষম্যের দিকে আলোকপাত করি,
জামায়াতে ইসলামীর ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোট শতকরা হার ছিলো অংশগ্রহণ কারী রাজনৈতিক দল গুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। সে অনুযায়ী আনুপাতিক পদ্ধতিতে তারা কতটি আসন পেত বিপরীতে তারা কতটি পেয়েছিলো তার একটা তুলনা দেখি।
১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতে, বিএনপির সাথে জোটবদ্ধ ভাবে অংশ নিয়ে আসন ভাগাভাগি করে এবং জামায়াত ইসলামীর প্রাপ্ত ভোট ছিল সর্বনিম্ন, প্রায় ১২.১৩%। যদি সেই নির্বাচনে আনুপাতিক পদ্ধতি চালু থাকত, তবে তাদের সংসদে আসন হতো প্রায় ৩৬টি। কিন্তু বাস্তবে তারা পেয়েছিল ১৮টি আসন।
১৯৯৬ সালে তারা বর্তমান নিষিদ্ধ দল আওয়ামিলীগ এর সাথে জোটবদ্ধ ভাবে অংশ নিয়ে আসন ভাগাভাগি করে ভোট পেয়েছিল প্রায় ৮.৬১%, যার আনুপাতিক হিসাব করলে আসন হওয়ার কথা প্রায় ২৬টি, কিন্তু বাস্তবে পায় মাত্র ৩টি।
আবার ২০০৮ সালে একক ভাবে নির্বাচন করে এবং জামায়াতের প্রাপ্ত ভোট ছিল প্রায় ৪.৬৫%, যার আনুপাতিক হিসাব অনুযায়ী তাদের পাওয়ার কথা ছিল ১৪টি আসন, কিন্তু তারা পেয়েছিল মাত্র ২টি।
এই তুলনা থেকেই স্পষ্ট হয়, বর্তমান আসনভিত্তিক নির্বাচনী ব্যবস্থায় একটি দলের সার্বিক ভোট শতাংশ সংসদে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয় না। কেউ কেউ কম ভোট পেয়েও বেশি আসন পায়, আবার কেউ জাতীয়ভাবে লক্ষণীয় ভোট পেলেও সংসদে প্রতিনিধিত্ব পায় না।
সুতরাং বলা যায় আনুপাতিক পদ্ধতি চালু হলে প্রতিটি ভোটের মূল্য বাড়বে, ভোটার তার ভোটের মর্যাদা বুঝবে এবং প্রতিনিধিত্ব আরও ন্যায্য হবে।
( লেখক: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।