স্টাফ রিপোর্টার।। কুলাউড়ার দর্পণ
কুলাউড়া উপজেলার কালা পাহাড়, জুড়ি উপজেলার হারাগাছা এবং সিলেট জেলার জৈন্তাপুরে মাটির নিচে দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে মূল্যবান খনিজ ইউরেনিয়াম। দেশে ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মতো ইউরেনিয়ামের সন্ধান মিললেও আজ অবধি তার উত্তোলনে নেয়া হয়নি কোনো বাস্তব উদ্যোগ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইউরেনিয়াম উত্তোলন করে দেশের অভ্যন্তরীণ বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিদেশে রফতানি করেও বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। জাপান, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলো ইউরেনিয়ামের বড় গ্রাহক। এক সময় ইউরেনিয়াম উত্তোলনের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বর্তমানে তা নেই। তারপরও বাংলাদেশে ইউরেনিয়াম উত্তোলনে দৃশ্যমান অগ্রগতি না থাকায় হতাশা প্রকাশ করছে সচেতন মহল।
বিশ্বের যেসব খনি থেকে ইউরেনিয়াম উত্তোলন করা হয়, সেগুলোর মাটিতে ইউরেনিয়ামের মাত্রা থাকে ৩০০ থেকে ১০০০ পার্টস পার মিলিয়ন (পিপিএম)। অথচ হারাগাছা ও জৈন্তাপুর থেকে সংগৃহিত মাটির পরীক্ষায় ইউরেনিয়াম প্রাপ্তির হার ধরা পড়েছে ৫০০ থেকে ১৩০০ পিপিএম। এতে স্পষ্ট, বাংলাদেশে পাওয়া ইউরেনিয়ামের মান ও ঘনত্ব বিশ্বমানের চেয়েও ভালো।
ইতিহাসের পেছনে ফিরে দেখা
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ ভূতত্ত্ববিদ ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ দল জুড়ি উপজেলার হারাগাছা পাহাড়ে অনুসন্ধান চালিয়ে ইউরেনিয়ামের উপস্থিতি নিশ্চিত করেন। পরে ওই পাহাড়কে তেজস্ক্রিয় এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু দেশে ইউরেনিয়াম উত্তোলনের অনুমতি না থাকায় প্রকল্পটি আর এগোয়নি।
এর এক দশক পর, ১৯৮৫ সালে ফের আলোচনায় আসে হারাগাছার ইউরেনিয়াম। তখন কমিশন সম্ভাব্যতা যাচাই করে এবং সিলেটের জৈন্তাপুরে নতুন অনুসন্ধান চালায়। ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের সহায়তায় করা এ অনুসন্ধানে জৈন্তাপুরেও ইউরেনিয়ামের উপস্থিতি পাওয়া যায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধের কারণে সেখানে গবেষণা আর এগোয়নি।
১৯৯১ সালে আবারও হারাগাছায় শুরু হয় অনুসন্ধান কাজ। সংগৃহিত আকরিক জাপানে পাঠিয়ে উন্নতমানের ইউরেনিয়ামের উপস্থিতি শতভাগ নিশ্চিত হয়। কয়েকটি কূপ খননও করা হয়, কিন্তু আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধের বেড়াজালে প্রকল্প থেমে যায়।
বিধিনিষেধ উঠে গেলেও উদ্যোগ নেই
পরবর্তীতে বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতির সঙ্গে সঙ্গে ইউরেনিয়াম উত্তোলনের বিধিনিষেধ উঠে যায়। ২০০৯ সালের ২৯ নভেম্বর মৌলভীবাজার সফরে এসে তৎকালীন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এনামুল হক ঘোষণা দেন, শিগগিরই ইউরেনিয়াম উত্তোলন শুরু হবে। একইভাবে ২০১০ সালের ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনকালে বলেন, দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হবে।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের এক সেমিনারে তৎকালীন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ কে এম ফজলে কিবরিয়া জানান, সিলেট ও মৌলভীবাজার অঞ্চলে ইউরেনিয়ামের ঘনত্ব অনেক বেশি। দ্রুত উদ্যোগ নিলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানিও সম্ভব।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও সতর্কতা
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড পলিমার সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মুহিবুল আলম জানান, ইউরেনিয়াম উত্তোলন অত্যন্ত সেনসেটিভ। সঠিক প্রযুক্তি ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি ছাড়া উত্তোলন করা হলে জীববৈচিত্র্যের উপর ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে।
তিনি বলেন, “এই আধুনিক প্রযুক্তি বর্তমানে আমাদের কাছে নেই। রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের কিছু দেশ এই কাজে অভিজ্ঞ। তাদের সহায়তা নিয়ে ইউরেনিয়াম উত্তোলন করলে তা রাষ্ট্রের জন্য বিশাল লাভজনক হবে।”
তিনি আরও বলেন, “দেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউরেনিয়াম ব্যবহারের পাশাপাশি উন্নত বিশ্বে রফতানির সম্ভাবনাও রয়েছে। তবে কী পরিমাণ ইউরেনিয়াম মজুত আছে এবং তা উত্তোলনযোগ্য কি না—এসব দ্রুত যাচাই করা দরকার।”
আশ্বাস বহু, উদ্যোগ নেই
২০০৯ সালে নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়ার পর একাধিকবার উচ্চপর্যায়ের আশ্বাস মিললেও আজও ইউরেনিয়াম উত্তোলনের কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। প্রতিবছর বৈশ্বিকভাবে ইউরেনিয়ামের চাহিদা বেড়েই চলছে। অথচ বাংলাদেশে থাকা মূল্যবান এ খনিজ বছরের পর বছর ধরে পড়ে আছে অব্যবহৃত অবস্থায়।
সচেতন মহলের প্রশ্ন, “যেখানে দেশের বিদ্যুৎ সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে—সেখানে সরকারের এই নিস্ক্রিয়তা কেন?”
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।