হুজুর ছিলেন আমাদের মক্তবের কঠোর—তবুও স্নেহমাখা এক প্রতিচ্ছবি। ওনার চকচকে হলুদ-ধূসর রঙের বেতের একটুখানি পরশেই আমরা আলিফের মতো সোজা হয়ে যেতাম। মিথ্যে বলা, কারো দূর্ণাম করা, মিলাদের পর হুজুরের চোখ ফাঁকি দিয়ে ‘ম্যাকগাইভার’ সেজে দু’তিনবার তবরুক নেয়ার দুঃসাহস, কিংবা জামাতে নামাজে অনুপস্থিত থাকা—এসব ছোটখাটো অপরাধের জন্য পরদিন হুজুরের বেতটি সপাং-সপাং নেচে উঠলে, আমরা শৈশবের কিছু ডানপিটেরা ভয় আর লজ্জার মিশেলে একেকটি শৃঙ্খলে অভ্যস্ত হয়ে উঠতাম।
তারপরও আমাদের মধ্যে ছিল কিছু দারুণ সাহসী শিশু—যারা সুযোগ পেলেই হুজুরের বেত চুরি করে লুকিয়ে ফেলত, কখনো আবার সেটা লুকিয়ে মসজিদের পুকুরে ভাসিয়ে দিত। বেতটি তখন জলের ঢেউয়ের উপর ভেসে থাকতো; ভোরের সোনালি আলোয় সোনালি ঝিকিমিকি করতো, যা দেখে আমাদের হৃদয় খুশিতে নেচে উঠত। সেদিন হুজুর যখন বেত খুঁজে পেতেন না, আমরা তখন হালকা স্বস্তি নিয়ে নিঃশব্দে দোয়া করতাম—
“আল্লাহ, আজ যে বেত লুকিয়েছে, তাকে শহরের সেরা চোর বানিও।”
এ দোয়া ছিল শিশুমনের খেলা, কিন্তু তার মধ্যে লুকিয়ে ছিল ভয়, হাসি আর একরাশ চাতুর্যের স্নিগ্ধ মিশ্রণ।
আরবিতে আমার ফ্লুয়েন্সি ভালো হওয়ায় হুজুর প্রায়ই আমাকে পড়া চালিয়ে নেবার দায়িত্ব দিতেন। একদিন তিনি বাইরে গেলে আমি পড়া ধরছিলাম, আর কৌতূহলবশত হুজুরের বেত হাতে নাড়াচাড়া করছিলাম। কিন্তু কিছু ‘প্রতিপক্ষ’ সহপাঠী হুজুরের কানে লাগিয়ে দিল—আমি নাকি বেত দিয়ে সবাইকে পিটিয়েছি, এমনকি হুজুরের ভূমিকাও নাকি অনুকরণ করেছি!
হুজুর তখন অগ্নিশর্মা। বললেন, “তিনজন স্বাক্ষী আনো। মনে রেখো, মক্তবে মিথ্যে স্বাক্ষী দিলে হাশরের ময়দানে জিহবা জ্বলবে।”
ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু আল্লাহর রহমে সেদিন বেঁচে যাই। আর পরেরদিন ফুটবল মাঠে সেই মিথ্যাচারকারীর উপর আমাদের ‘ক্যামেরুনীয় ফাউল’টা একটু বেশি জোরেই পড়ে যায়—হয়তো সেটাই ছিল আমাদের শিশুসুলভ ন্যায়বোধের প্রকাশ।
প্রতিদিন পড়া শেষে হুজুর একই দোয়া করতেন—
“হে আল্লাহ, আমার এ বাচ্চাদের মানুষ বানিয়ে দাও। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার নয়—আগে ভালো মানুষ হওয়া।”
হুজুর আজ আর নেই; কিন্তু তাঁর সেই দোয়া, তাঁর স্নেহের পরশ আজও আমাদের অন্তরে বাজে। ওনার কঠোরতা ছিল আসলে জীবনের মাড়ে চাবুকের মতো—ব্যথা দিত, তবু দিকনির্দেশ করত।
আজ ভাবি—যাদের জন্য আমরা একসময় দোয়া করতাম “শহরের সেরা চোর” হবার, সেই বুদ্ধিমান শিশুরাই আজ জীবন্ত কিংবদন্তি; কারও নাম দেশ পেরিয়ে বিদেশে আলো ছড়ায়।
এখন আর কাকডাকা ভোরে দল বেঁধে মক্তবে যাওয়া দেখা যায় না। শিশুরা ঘুম থেকে উঠে হাতে নেয় মোবাইল, ডুবে থাকে পাবজি আর ফ্রি ফায়ারে। শহরে গড়ে উঠছে ‘কিশোর গ্যাং’; তাদের সময় কাটে মাদক, চুরি আর ছিনতাইয়ে।
সেই পুরনো মক্তব-দিনগুলো আজ স্বপ্নের মতো মনে হয়। মনে হয়—হুজুরের বেত, তাঁর কঠোরতা আর তাঁর দোয়া—এই তিনটিই ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান শিক্ষা। আজও তার বড় প্রয়োজন।
ডা. সাঈদ এনাম
সহযোগী অধ্যাপক সাইকিয়াট্রি
ইন্টারন্যাশনাল ফেলো
আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।