ওসিডি (OCD): এক অদৃশ্য শৃঙ্খলে আবদ্ধ সময়
ওসিডি (Obsessive-Compulsive Disorder) এমন এক মানসিক রোগ, যেখানে রোগী বারবার একই রকম চিন্তা বা কাজ করতে বাধ্য হয়।
জীবাণু বা ময়লা লাগার ভয় পেয়ে ঘন ঘন হাত ধোয়া বা গোসল করা, তালা, চাবি বা গ্যাস বন্ধ আছে কিনা তা বারবার পরীক্ষা করা—এসব সাধারণ লক্ষণ। কেউ সংখ্যা গোনে, সব কিছু একদম ঠিকঠাকভাবে সাজিয়ে রাখতে চায়—সামান্য অগোছালো থাকলেই অস্বস্তি বোধ করে এবং অস্বস্তি কাটাতে বারবার গুছায়।
মাথায় অবাঞ্ছিত বা ভয়ানক চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে; ধর্মীয় বা নৈতিক বিষয়ে ভুল হয়েছে কিনা, তা নিয়েও অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা দেখা যায়।
অনেকে অপ্রয়োজনীয় জিনিস ঘরে জমিয়ে রাখে। এসব আচরণ যে অযৌক্তিক, তা জানলেও থামাতে পারে না—ফলে উদ্বেগ ও মানসিক কষ্টে ভোগে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক উপসর্গ হলো—রোগী অযথা বাথরুমে ধুয়েমুছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেয়; অথবা মিটিং, অফিস বা কোথাও যেতে প্রস্তুতি নিতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যায়। কখনও ফ্লাইট মিস হয়, ট্রেন-বাস চলে যায়—ফলে তার প্রাত্যহিক জীবনে বিশৃঙ্খলা ও ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়।
রোগী জানেন এসব আচরণ অযৌক্তিক, এমনকি তিনি এগুলো করতে চান না—তবুও নিজেকে থামাতে পারেন না। এটাই ওসিডির আসল যন্ত্রণা।
ওসিডি সাধারণত কৈশোর ও টিনএজে বেশি দেখা যায়। কারণ, এই বয়সে মস্তিষ্কের ফ্রন্টো-স্ট্রায়াটাল সার্কিট বা “নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র” দ্রুত বিকাশ লাভ করে এবং হরমোনজনিত পরিবর্তনে উদ্বেগ বাড়ে। ফলে সংবেদনশীল, পারফেকশনিস্ট ও চিন্তাশীল কিশোর-কিশোরীরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়।
জেনেটিক প্রবণতা, পারিবারিক চাপ ও মানসিক স্ট্রেসও এর অন্যতম কারণ।
বিশ্বজুড়ে প্রায় ২–৩% মানুষ ওসিডিতে ভোগেন—অর্থাৎ প্রতি ১০০ জনে অন্তত ২–৩ জন। এটি এক নিঃশব্দ কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী ব্যাধি, যা পড়াশোনা, কাজ ও সামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।
চিকিৎসায় এখন এসেছে বৃহৎ অগ্রগতি। প্রথম সারির চিকিৎসা হলো Cognitive Behavioral Therapy (CBT)—বিশেষ করে Exposure and Response Prevention (ERP) পদ্ধতি, যা ভয় ও বাধ্যতামূলক আচরণের চক্র ভাঙতে সাহায্য করে। পাশাপাশি SSRI শ্রেণির ওষুধ (যেমন ফ্লুওক্সেটিন, সারট্রালিন) বেশ কার্যকর।
সবশেষে এসেছে TMS (Transcranial Magnetic Stimulation)—একটি আধুনিক, ওষুধবিহীন থেরাপি, যা মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশে চৌম্বক তরঙ্গ প্রেরণ করে নিউরনের কার্যক্রম স্বাভাবিক করে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৪০–৬০% রোগী এই পদ্ধতিতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি পান। এটি ওসিডি চিকিৎসায় এক আশাব্যঞ্জক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে—যেখানে মুক্তির সম্ভাবনা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি।
ডা. সাঈদ এনাম
সহযোগী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি)
সিলেট মেডিকেল কলেজ।
ইন্টারন্যাশনাল ফেলো আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।