🧠 আকস্মিক বিভৎস কোনো দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা কী কী মানসিক সমস্যার ঝুঁকিতে থাকেন?
সম্মুখে হঠাৎ ঘটে যাওয়া ভয়ংকর কোনো দুর্ঘটনা—যেমন গাড়ি দুর্ঘটনা, ট্রেন দুর্ঘটনা, আগুনে পুড়ে যাওয়া কিংবা কাছের কোনো প্রিয়জনের মৃত্যু—প্রত্যক্ষদর্শীদের মনে একটি গভীর মানসিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। এ ধরনের ভয়াবহ ঘটনা দেখার পর, কিংবা নিজের জীবনে এমন কিছু ঘটলে, কেউ কেউ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তীব্র ভয়, আতঙ্ক, দুঃস্বপ্ন, নিদ্রাহীনতা, স্মৃতিবিভ্রাট, অস্থিরতা বা স্তব্ধ হয়ে পড়ার মতো মানসিক উপসর্গে আক্রান্ত হতে পারেন।
এসব লক্ষণ যদি ঘটনার ৩ দিন থেকে ১ মাসের মধ্যে দেখা দেয়, তাহলে সেটিকে বলা হয় এক্যুট স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (Acute Stress Disorder – ASD)।
⚠️ এক্যুট স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের (ASD) প্রধান লক্ষণসমূহ:
১. আতঙ্ক ও ঘন ঘন ভয় লাগা
২. বারবার সেই দুর্ঘটনার কথা মনে পড়া (Flashbacks)
৩. দুঃস্বপ্ন বা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখা
৪. বাস্তবতাকে অস্বাভাবিক বা অদ্ভুত লাগা (Derealization)
৫. নিজের শরীর বা চিন্তা থেকে বিচ্ছিন্ন লাগা (Depersonalization)
৬. অতিরিক্ত উত্তেজনা বা চঞ্চলতা (Hyperarousal)
৭. মনোযোগ ধরে রাখতে সমস্যা হওয়া
৮. ঘুমের সমস্যা বা নিদ্রাহীনতা
৯. দুর্ঘটনার বিষয় বা স্থান এড়িয়ে চলা (Avoidance)
১০. মেজাজ খিটখিটে বা রাগপ্রবণ হয়ে যাওয়া
🔁 পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD): দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ
যদি এই মানসিক কষ্ট বা যন্ত্রণা এক মাসের বেশি সময় স্থায়ী হয়, কিংবা অনেক পরে আচমকা শুরু হয় তখন য়াকে বলা হয় পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD)।
😔 PTSD-র সাধারণ লক্ষণ:
১. ট্রমাজনিত ঘটনা বারবার মনে পড়া (Intrusive memories)
২. দুঃস্বপ্ন ও ঘুমের ভেতর আতঙ্ক (Nightmares)
৩. বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন অনুভব (Emotional numbing)
৪. ভয় জাগানো স্থান, ব্যক্তি বা সময় এড়িয়ে চলা (Avoidance)
৫. অতিরিক্ত সতর্কতা ও আতঙ্কজনিত প্রতিক্রিয়া (Hypervigilance)
৬. রাগের বিস্ফোরণ ও মেজাজে গুরুতর পরিবর্তন
৭. ছোট শব্দ বা দৃষ্টিতে হঠাৎ চমকে ওঠা (Exaggerated startle response)
৮. মনোযোগে ঘাটতি ও স্মৃতিভ্রষ্টতা
৯. হতাশা, অপরাধবোধ বা আত্মঘৃণা
১০. জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা
👧 শিশুদের ক্ষেত্রে ASD ও PTSD-এর ঝুঁকি:
শিশুদের মানসিক গঠন বড়দের মতো পরিপক্ব হয় না। তাই ট্রমার প্রভাব তাদের ওপর পড়ে আরও গভীর ও দীর্ঘস্থায়ীভাবে। ভয়াবহ কোনো দুর্ঘটনা বা সহিংসতার পর অনেক শিশু ASD বা PTSD-তে আক্রান্ত হয়। তারা হঠাৎ চুপ হয়ে যেতে পারে, আগের মতো খেলাধুলা বা পড়ালেখায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, রাতে ঘুমাতে ভয় পায়। অনেক সময় শিশুরা বোঝাতেই পারে না কী ঘটেছে বা কেন তারা এমন আচরণ করছে।
শিশুদের মধ্যে ASD বা PTSD হলে তাদের মানসিক বিকাশে বড় ধরণের বাধা সৃষ্টি হয়। তারা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে চায় না, স্কুলে মনোযোগ দিতে পারে না। ঘুমের সমস্যা, উদ্বেগ, বিষণ্ণতা দেখা দেয়। কারও কারও মধ্যে আত্মঘাতী চিন্তা, মাদকাসক্তি বা আইনি জটিলতার প্রবণতা গড়ে ওঠে। যদি পরিবারে মানসিক রোগের জেনেটিক ঝুঁকি থাকে, তাহলে সমস্যা আরও তীব্র হয়।
📊 পরিসংখ্যান কী বলছে?
বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী, ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর শিশুদের মধ্যে ASD (Acute Stress Disorder) দেখা দেয় প্রায় ১০%–৩০% ক্ষেত্রে। এই শিশুদের ৫%–১৫% পরবর্তীতে PTSD (Post-Traumatic Stress Disorder)-তে রূপ নেয়। যদি ট্রমাটি হয় যুদ্ধ, যৌন নির্যাতন বা পারিবারিক সহিংসতার মতো ভয়াবহ, তবে PTSD-এর ঝুঁকি বেড়ে দাঁড়ায় ৩০%–৬০%। তাই বড় ট্রমার পর শিশুদের মানসিক অবস্থা নিয়মিত খেয়াল রাখা জরুরি।
🚸 🕊️ সমাধানের পথ:
ভয়ের কিছু নেই, আবার চুপ থেকেও চলবে না। শিশুদের মানসিক আঘাত কাটিয়ে উঠতে প্রাথমিক পর্যায়ে সহায়তা জরুরি। পরিবারকে ভালোবাসায় ভরপুর পরিবেশ তৈরি করতে হবে। শিক্ষকদেরও সচেতন থাকতে হবে। আচরণে পরিবর্তন দেখলে অবহেলা নয়, দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সাইকিয়াট্রিস্ট বা সাইকোলজিস্টের পরামর্শ নিতে হবে।
✍️ লেখক:
ডা. মু. সাঈদ এনাম
(এসোসিয়েট প্রফেসর, স্নায়ু ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ)
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।